বিপুল বিস্তৃত প্রাণিসম্পদ খাতে যে সব উদ্যোক্তা কাজ করছেন তাদের উদ্বুদ্ধ করা, এই সেক্টরে তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা এবং এই খাতের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করা, প্রাণিসম্পদ খাতে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে তা উপস্থাপন করা, আকর্ষণীয় স্থানীয় উন্নত জাতের গবাদিপশু ও পোলট্রির প্রদর্শন করা এবং বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যবাহী ও বাহারি প্রাণিজ খাবারের সাথে সবাইকে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে ‘জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫’ পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ হিসেবে এ বছরই প্রথম এ আয়োজন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ ব্র্যান্ডিং হবে, আরো অনেক মানুষ এ খাতের সাথে সম্পৃক্ত হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, জীবনমান উন্নত হবে, সর্বোপরি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রাণিসম্পদ খাত এক অনন্য ভূমিকা পালন করছে। দেশে প্রায় ১৫ লাখ প্রান্তিক খামারি তাদের দৈনিক জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ২-৩টি করে পশু পালন করে থাকেন। কোরবানিকে কেন্দ্র করে প্রায় ৮ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারি গবাদিপশু লালন-পালন করেন। দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। পোলট্রি খাতে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১.৮১ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.১৯ শতাংশ। কৃষিজ জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১৬.৫৪ শতাংশ। দেশে বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটি গরু, ১৫ লাখ মহিষ, তিন কোটি ছাগল-ভেড়া এবং ৪০ কোটি হাঁস-মুরগি রয়েছে। এসব গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মাধ্যমে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৫৫ লাখ মেট্রিক টন দুধ, ৮৯.৫৪ লাখ মেট্রিক টন মাংস এবং ২৪৪০ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর প্রান্তিক খামারিদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, বাচ্চা সরবরাহ, খাদ্য, ভ্যাকসিন ও ওষুধ প্রদানের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত পোলট্রি শিল্প। এই খাতে বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতাধীন ৫০টি হাঁস-মুরগির খামার থেকে বছরে ৩৫ লাখ একদিনের বাচ্চা সরবরাহ করা হয়। বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২.৭২ লাখ অনগ্রসর জনগোষ্ঠী/নৃ-গোষ্ঠী/চরাঞ্চলের প্রান্তিক খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও উৎপাদন উপকরণ বিতরণ এবং ২,৬১১টি কৃষক সংগঠন ও ৬,৫০০টি উৎপাদনকারী সংগঠন সৃজন হয়েছে।
দেশে পোলট্রি ও ডেইরি খাতের উন্নয়নের সাথে সাথে বাণিজ্যিক পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিকাশ লাভ করেছে। দেশে বছরে প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস্যখাদ্য উৎপাদন হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর নিবন্ধিত ফিড মিলের সংখ্যা ৩৪২টি। মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ এবং পশুখাদ্য বিধিমালা, ২০১৩ অনুসরণ করে এসব খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ এবং পশুখাদ্য বিধিমালা, ২০১৩ এর আওতায় ফিড মিল, পশুখাদ্য উপকরণ এবং খাদ্য আমদানি ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়েছে ৭৪৬৮৯টি; পশুখাদ্য নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৭৭৩টি; মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে ১৪২৬টি; জব্দকৃত ও বিনষ্টকৃত ভেজাল পশুখাদ্য ৯৮১ মেট্রিক টন; কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে ৫৪ জনকে এবং আদায়কৃত জরিমানার পরিমাণ ৫৫.৯৪ লাখ টাকা।
দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির অপর একটি খাত হলো দেশের ডেইরি খাত। বর্তমানে দেশে প্রায় ২.৫ কোটি গবাদিপশুর মধ্যে ৮৬ লাখ দুগ্ধবতী গাভী রয়েছে, যার মধ্যে ৪৫ লাখ দেশীয় গাভি এবং ৪১ লাখ সঙ্কর জাতের গাভী। দুগ্ধ খাতে শতকরা ৮০ ভাগ খামারি প্রান্তিক, ভূমিহীন কৃষক ও নারী, যারা মোট উৎপাদিত দুধের শতকরা ৭০ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে। আমাদের দেশী জাতের গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উন্নত জাতের গবাদিপশুর সিমেন সংগ্রহ করে অনুমোদিত নীতিমালার ভিত্তিতে দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজননকার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র, উপকেন্দ্র ও পয়েন্টের মাধ্যমে হিমায়িত ও তরল সিমেন ব্যবহার করে কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে যা একটি সফল কার্যক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর লাখ লাখ বেকার যুবক, যুব মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনে সম্পৃক্ত করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর মোট ২ লাখ ৭২ হাজার জন বেকার যুবক, যুব মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন, খাদ্য বিক্রেতা ও ঘাস চাষের ওপর এবং ১৮,২৪৫ জন মাংস প্রক্রিয়াজাতকারীগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে নিরাপদ পণ্য উৎপাদন ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নেও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর কাজ করছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরে মহিষের প্রাপ্যতা ও উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। সরকারি তিনটি মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামার (বাগেরহাট মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামার, টাঙ্গাইল মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামার এবং মহিষ প্রজনন ও উন্নয়ন খামার, সাভার, ঢাকা) হতে ভর্তুকিমূল্যে এসব হাওর ও বিভিন্ন অঞ্চলে খামারিদের মধ্যে মহিষের বাচ্চা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে উঠা নিত্য নতুন চর ও সরকারি খাস জমি খামারিদের মাঝে চারণভূমি হিসেবে ব্যবহারের জন্য সমবায়ভিত্তিক বন্দোবস্ত প্রদান করার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকগণের সাথে কাজ করা হচ্ছে যাতে এসব অঞ্চলের সাধারণ জনগোষ্ঠী মহিষ পালনে আরো উৎসাহী হয়।
প্রাণিস্বাস্থ্যের উন্নয়নে একটি বাধা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই। এসব রোগ প্রতিরোধে প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে প্রতি বছর ১৭টি রোগের প্রায় ৩৪ কোটি ডোজ গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টিকা উৎপাদন ও বিতরণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি উদ্ভূত গবাদিপশুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (খঝউ) রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে প্রায় ১৭ লক্ষ মাত্রা টিকা মাঠ পর্যায়ে প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, গবাদিপশুর অন্যতম ক্ষুরা রোগ মুক্ত অঞ্চল তৈরির লক্ষ্যে দেশের চারটি জেলায় (সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ ও ভোলা) টিকাদান কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে যা চলমান রয়েছে। সারা দেশ থেকে ছাগলের মারাত্মক সংক্রামক রোগ পিপিআর (চচজ) নির্মূলে প্রায় ৬ কোটি ডোজ টিকা সাম্প্রতিক সময়ে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়ায় এরকম সংক্রামক যেমন- এ্যানথ্রাক্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জলাতঙ্ক, নিপা ভাইরাসসহ অনেক রোগ পরীক্ষণে ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ ল্যবরেটরির স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি ট্রান্সবাউন্ডারি প্রাণিরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণকল্পে দেশের জল, স্থল ও বিমানবন্দরসমূহে মোট ২৪টি কোয়ারেন্টাইন স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় একটি জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুরে একটি বিনোদন উদ্যান চিড়িয়াখানা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা ১৯৬৪ সালে মিরপুর, ঢাকায় প্রায় ১৮৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৩৫ প্রজাতির ৩৩২৫টি প্রাণী রয়েছে। বছরে প্রায় ৪০-৪৫ লাখ দর্শনার্থী এ চিড়িয়াখানা দর্শন করে। এ চিড়িয়াখানা থেকে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। জনসাধারণের জন্য নির্মল চিত্তবিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম ছাড়াও চিড়িয়াখানা আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যেমন: ক) দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির পশু-পাখি পালন, সংরক্ষণ ও প্রজননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি, খ) ছাত্র-ছাত্রী ও শিশু-কিশোরদের বন্যপ্রাণী বিষয়ে শিক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা এবং গ) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের গবেষণাকাজে সহায়তা করা।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতর রোগ প্রতিরোধক টিকা বীজ বিক্রয়, কৃত্রিম প্রজনন ফি, ফার্ম ও কোম্পানিসমূহের রেজিস্ট্রেশন ফি, চিড়িয়াখানা ও সরকারি খামারসমূহ হতে আয় এবং টেন্ডারসহ অন্যান্য খাত থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির পরিমাণ ৮৫ কোটি ২৩ লাখ ২১ হাজার টাকা। রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে তৈরী পোশাক ও হিমায়িত চিংড়ি রফতানির পরই অবস্থান চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের। প্রতি বছর বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি রফতানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে।
বর্তমানে সীমিত আকারে গরু এবং ছাগলের গোশত, প্রাণী উপজাত দ্রব্যাদি যেমন হাড়, নাড়ি-ভুঁড়ি, জেনিটাল অর্গান রফতানি শুরু হয়েছে। এছাড়াও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি যেমন দই, মিষ্টি রফতানি করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মূল্যায়নে ছাগল পালনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থান এবং ছাগলের গোশত উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। ইতোমধ্যে বাণিজ্য বাধা দূরীকরণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে একটি ট্রেড উইং স্থাপন করা হয়েছে।
জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫ সব জেলা ও উপজেলায় পালিত হবে। এ উপলক্ষে ২৬, ২৭, ২৮ নভেম্বর ঢাকার শেরেবাংলা নগর পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে মেলা ও উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এতে থাকবে ঐতিহ্যবাহী ও বাহারি খাবার, বিভিন্ন খাবারের রেসিপি প্রতিযোগিতা, পোষা প্রাণী ও গবাদিপশু প্রদর্শনী, পোলট্রি ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রদর্শনী, প্রাণী পালন সম্পর্কিত আধুনিক প্রযুক্তি, চামড়াজাত পণ্য এবং প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষার বিভিন্ন উপকরণ। এর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ ব্র্যান্ডিং হবে।
লেখক : সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়



