রাজীব হুমায়ুন ১৯৪৭ সালে সন্দ্বীপের একটি আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সন্দ্বীপ নোয়াখালীর অধীনে ছিল। এ কারণে সেখানে আলেমদের আধিপত্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো- রাজীব হুমায়ুন আওয়ামীপন্থীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি ‘অতি বাঙালিপনার সমস্যা’ নামে বই লিখেছিলেন। তাই তাকে আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীরা স্মরণ করেন না।
ভারত থেকে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। আমি পড়তাম পাশের বিভাগে ইংরেজিতে এমএ ক্লাসে। ছিলাম ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী। রাজীব হুমায়ুন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে চাকসুর বার্ষিক সাহিত্য প্রতিযোগিতা সম্পর্কে কিছু পরামর্শ চাইলাম। তিনি মন খুলে পরামর্শ দিলেন। ভারত থেকে তিনি ‘রাজীব’ নাম নিয়ে আসাতে বোঝা গিয়েছিল যে তিনি ভারতপন্থী। কলকাতা থেকে তিনি ডক্টরেট করেছিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে পরামর্শ দিতে দ্বিধা করেননি। বলেছিলেন, তিনি থাকলে অনেক পরামর্শ দিতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারছেন না বিধায় আরো উপদেশ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তার নাম ছিল আসলে হুমায়ুন কবীর। একজন মৌলভিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভারতে গিয়ে ‘রাজীব’ নাম গ্রহণ করেছিলেন। এতে বোঝা যায় তিনি কতটুকু ভারতপন্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হন। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রধান ছিলেন ড. জাহাঙ্গীর তারেক। রাজীব হুমায়ুন সন্দ্বীপের ভাষা ও সমাজের ওপর লিখেছিলেন। তার বই থেকে আমরা শিখেছি বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির পূর্বপুরুষ সন্দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন।
সন্দ্বীপের সাথে নোয়াখালীর সম্পর্ক আছে। ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত কবি আবদুল হাকিম (১৬০৭-৮০)। তিনি সুধারামের কবি ছিলেন। সুধারাম তার সময়ে সন্দ্বীপের অধীন ছিল। বর্তমানে নোয়াখালী সদর থানার নাম সুধারাম। কবি আবদুল হাকিম সুধারামের বাসিন্দা ছিলেন। ‘দেশী ভাষাবিদ্যা যার মনে ন জুড়ায়, নিজ দেশ ত্যাগী কোন বিদেশ ন যায়’ তার বিখ্যাত কবিতা ‘বঙ্গবাণী’র অংশ।
ড. আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ নোয়াখালীর ভাষা নিয়ে লিখেছেন। তিনি ছিলেন রাজশাহীর লোক। যেমন, চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে লিখেছিলেন ড. মনিরুজ্জামান। তিনি ছিলেন নরসিংদীর লোক। রাজীব হুমায়ুনের বইতে প্রথম দেখি, বিএনপির মন্ত্রিপরিষদ সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল আকবর হোসেনের পূর্বপুরুষ সন্দ্বীপের ছিলেন। প্রচলিত আছে যে, আকবর হোসেনের পরিবার কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থানায় বসবাস করেন। এটি নোয়াখালী জেলাসংলগ্ন। আকবর হোসেনের এক ভাই আমাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। তিনি বলতেন চৌদ্দগ্রামে থাকার কথা। আকবর হোসেনের বাবা হোসেন আলী মোক্তার কুমিল্লার বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন। তিনি পরে কুমিল্লা শহরে গিয়ে বসতি গড়েন। রাজীব হুমায়ুন কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার বই থেকে আরো জানা যায়, তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পূর্বপুরুষও সন্দ্বীপের। এ ছাড়া বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম নেতা কাজী জাফরের দলের এমপি এবং পরে জাতীয় পার্টি দলের এমপি আশরাফ উদ্দিন খান ইমুর পূর্বপুরুষও সন্দ্বীপের। পরে ঢাকার সাভারে বসতি স্থাপন করেন।
এভাবে আমার মতো বাইরের লোকেরাও রাজীব হুমায়ুনের বইয়ের ভক্ত হয়ে ওঠেন। তিনি সন্দ্বীপ সম্পর্কে অনেক তথ্য পরিবেশন করেছেন। সন্দ্বীপের ভাষার ওপর বিশেষ আলোকপাত করেছেন।
‘অতি বাঙালিপনার সমস্যা’ নামক বই লিখেছেন রাজীব হুমায়ুন। এ বই লিখে আওয়ামী-শিবিরের রোষানলে পড়েন। এ জন্য তাকে স্মরণ করা হয় না ঠিকমতো। অতি মুসলমান হওয়ার সমস্যা নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রচার করে। তারা প্রচার করে যে, পাকিস্তানিরা অতি মুসলমান ছিলেন। অতি মুসলমান হওয়ার অর্থ ধর্মকে অতিরিক্ত আঁকড়ে ধরা। আর অতি বাঙালিপনার অর্থ হচ্ছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে মাত্রাতিরিক্ত আঁকড়ে ধরা। এ দু’টির একটি আরেকটির বিপরীত। কিন্তু রাজীব হুমায়ুনের চোখ এড়ায়নি তা।
২০১৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন ৭০ বছর বয়সে। মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তিনি যেরকম খ্যাতিমান ‘শিক্ষক’ হিসেবে, সেভাবে তাকে স্মরণ করা হয় না। এর কারণ আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের অনীহা। তারা কতজনকে স্মরণ করেন, কিন্তু রাজীব হুমায়ুনকে স্মরণ করেন না। এর কারণ হচ্ছে, তিনি উপরি-উল্লিখিত বিইটি লিখে তাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তাদের মহলের আর কেউ এমন বই লেখার সাহস করেননি।



