সংগ্রাম-সাহসের প্রতীক খালেদা জিয়া

এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, খালেদা জিয়ার নাম বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে স্থায়ীভাবে লেখা থাকবে।

সমগ্র বাংলাদেশ আজ শোকাহত। একটি দীর্ঘ, সংগ্রামী ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। তার বিদায়ে শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নয়, বরং পুরো জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হলো।

খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য উপস্থিতি। তিনি ক্ষমতার শীর্ষে যেমন ছিলেন দৃঢ়, তেমনি বিরোধী রাজনীতিতে ছিলেন অনমনীয়। ছিলেন আপসহীন নেত্রী। এ অভিধা কেবল রাজনৈতিক ¯েøাগান ছিল না; দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন, কারাবরণ ও চাপের মুখেও গণতান্ত্রিক অবস্থানে অটল থাকার মধ্য দিয়ে এই পরিচয়ের জন্ম।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়ার উত্থান এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে যেভাবে তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন, তা শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়- এটি সমাজ, রাজনীতি ও সময়কে অতিক্রম করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট। তার পারিবারিক নাম ছিল খালেদা খানম, ডাকনাম পুতুল। বিয়ের পর তিনি খালেদা জিয়া নামে পরিচিত হন। রাজনীতির সাথে তার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল না। স্বামী জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময়েও তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। পরিবার, সন্তান ও সংসার- এই ছিল তার জগত।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর ৩৭ বছর বয়সে বিধবা হন তিনি। দুই সন্তান নিয়ে তার জীবন এক মুহূর্তে বদলে যায়। সেই সময় বিএনপি ছিল নেতৃত্বহীন, বিভক্ত এবং রাজনৈতিকভাবে বিপর্যন্ত। দলের অনেক নেতা সামরিক শাসক এরশাদের সাথে আপসের পথে হাঁটেন। এ সঙ্কটকালে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে দলের প্রবীণ নেতাদের অনুরোধে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন।

১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। প্রথমে ভাইস চেয়ারম্যান, পরের বছর-১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এটি কোনো স্বাভাবিক উত্তরাধিকার নয়; বরং একটি পুরুষশাসিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার কঠিন সূচনা।

এরশাদের সামরিক শাসনের সময় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি সাতদলীয় জোট গঠন করে ৯ বছর ধরে রাজপথে ছিলেন। নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত, বারবার গ্রেফতার, রাজনৈতিক চাপ- সবমিলিয়ে এ সময়ে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ওই সংসদে তার নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৬ বছর পর সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। এটি তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর একটি।

পরবর্তী সময়েও তিনি ক্ষমতা ও বিরোধী রাজনীতির উভয় ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে ক্ষমতা ছাড়েন। ২০০১ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের পর দীর্ঘ সময় বিরোধী রাজনীতিতে থেকে আন্দোলন করেছেন, কারাবরণ করেছেন, ক্ষমতার বাইরে থেকেছেন।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা প্রমাণ করে, নেতৃত্ব শুধু প্রস্তুতির ফল নয়- পরিস্থিতি, সাহস ও সঙ্কল্পের সমন্বয়েও নেতৃত্ব জন্ম নেয়। একজন গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে পৌঁছানো তার এ যাত্রা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ কারণে খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি একটি সময়ের প্রতীক।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন সহজ ছিল না। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই, ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা- সব পর্বে তাকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। নানা প্রতিকূলতা সত্তে¡ও পিছু হটেননি তিনি। এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তাতে অবিচল থাকার মানসিকতাই তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতা নয়-রাজনীতি মানে অবস্থান। সেই অবস্থান যদি গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থের পক্ষে হয়, তাহলে আপসের প্রশ্ন আসে না।

খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম ছিল উচ্চকণ্ঠ নয়, দৃঢ়। তিনি বলেছেন, ‘দেশের বাইরে আমি যাবো না। কারণ দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। আমার কোনো কিছু নেই। এই দেশেই আমি থাকব। এই দেশেই আমার জন্মস্থান। এই দেশেই আমার মৃত্যু হবে।’ এ বক্তব্য কেবল আবেগ নয়, এটি ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ। দেশ ঘিরে তার সব সিদ্ধান্ত, সব অবস্থান। আধিপত্যবাদ, পরনির্ভরতা কিংবা আপসের রাজনীতির প্রতি তার অনীহা এখান থেকে উৎসারিত।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনে বিতর্ক ছিল। সমালোচনা ছিল। ভিন্নমত ছিল। এটা স্বাভাবিক। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলে বিতর্ক অনিবার্য। কিন্তু তার দেশপ্রেম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। একজন রাষ্ট্রনায়ককে মূল্যায়ন করতে হয় তার সামগ্রিক ভূমিকার ওপর। গণতন্ত্রের প্রশ্নে তিনি ছিলেন দৃঢ়। বিরোধী রাজনীতির অধিকার রক্ষায় ছিলেন অবিচল। ক্ষমতার বাইরে থেকেও রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এ সাহস তাকে সবার থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

কেন খালেদা জিয়াকে দেশের মানুষ মনে রাখবেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু মানুষ আছেন, যাদের নাম সময়ের সাথে সাথে মুছে যায় না। বেগম খালেদা জিয়া সেই বিরল মানুষদের একজন। ক্ষমতার শীর্ষে থাকুন বা বিরোধী রাজনীতিতে থাকুন- তিনি ছিলেন দৃশ্যমান, প্রভাবশালী এবং সিদ্ধান্তে দৃঢ়। এ কারণে তাকে মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবেন।

প্রথমত, খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শুরু করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ইতিহাসে স্বীকৃত। তিনি এমন এক সময় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যখন গণতন্ত্র ছিল সঙ্কটে। সেই সঙ্কটময় সময়ে তিনি জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে আপস করেননি।

দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক। রাজনৈতিক সুবিধা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কিংবা ক্ষমতার লোভ- কোনোটি তাকে নীতিগত অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। একাধিকবার কারাবরণ করেছেন, শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপের মুখেও মাথা নত করেননি। এ দৃঢ়তা তাকে সমর্থকদের চোখে যেমন বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছেও তাকে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে।

তৃতীয়ত, খালেদা জিয়ার দেশপ্রেম ছিল বাস্তব ও স্পষ্ট। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, দেশের বাইরে তার কোনো ঠিকানা নেই। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তিনি দেশে থাকতে চেয়েছেন। এ অবস্থান প্রতীকী ছিল না; এটি ছিল তার রাজনীতির গভীর দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। দেশের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেননি।

চতুর্থত, নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের মতো পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একজন নারী হিসেবে দীর্ঘদিন জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সহজ ছিল না। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই সীমাবদ্ধতা ভেঙেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্ব লিঙ্গনির্ভর নয়; নেতৃত্ব নির্ভর করে সাহস, সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ববোধের ওপর।

পঞ্চমত, বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্যেও তিনি রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। তার রাজনৈতিক জীবনে ভুল, বিতর্ক ও সমালোচনা ছিল- এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকার সক্ষমতা দেখিয়েছেন।

সবশেষে বলা যায়, খালেদা জিয়াকে মানুষ মনে রাখবেন, কারণ তিনি শুধু ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ ছিলেন না; ছিলেন সংগ্রামের রাজনীতির প্রতীক। গণতন্ত্র, দেশপ্রেম ও আপসহীন অবস্থানের যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গৌরবময় অংশ হয়ে থাকবে। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন, ন্যায়বিচারমুখী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এটা ছিল তার অটল বিশ্বাস।

খালেদা জিয়ার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শূন্যতা তৈরি করল। এ শূন্যতা শুধু নেতৃত্বের নয়, এটি অভিজ্ঞতা, সংগ্রাম ও প্রতিরোধের শূন্যতা। আজ তার দল শোকাহত। শোকাহত তার অনুসারীরা। শোকাহত একটি দেশ, যে দেশ তার রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু মতপার্থক্যের মধ্যেও তাকে একজন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী নেত্রী হিসেবে দেখেছেন।

এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, খালেদা জিয়ার নাম বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে স্থায়ীভাবে লেখা থাকবে। তিনি চলে গেছেন। কিন্তু তার সংগ্রাম, তার অবস্থান এবং আপসহীনতার গল্প থেকে যাবে। রাজনীতি বদলাবে। প্রজন্ম বদলাবে। কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই করার যে সাহস, খালেদা জিয়া সেই সাহসের একটি প্রতীক হয়ে ইতিহাসে থাকবেন। এটা তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয়।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন