আগে দাঁড়াতে দিন

মহান মুক্তিযুদ্ধে মানুষ রক্ত দিলো, সামাজিক সুবিচার, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অথচ স্বাধীনতার প্রথম চার বছরে দেখা গেল স্বৈরাচারের আস্ফালন এবং অ-মুক্তিযোদ্ধাদের মাতব্বরি। কার বিজয় কে ছিনিয়ে নিলো। প্রতিবাদকারীদের কচুকাটা করা হলো

ঢাকা থেকে সাতক্ষীরাগামী সোহাগ পরিবহনের বিলাসবহুল বাসের যাত্রী পারুলিয়ার পারভেজ সরদার। তিনি আপ্যায়ন ও অবকাশ কেন্দ্র ‘সাম্পান’ এ নেমে দেখতে পান ‘শতবর্ষী আমগাছে’ দিকনির্দেশক বিজ্ঞপ্তি। ৭৫ বছর বয়সী পারভেজ সরদার ভাবেন, তার চেয়ে ২৫ বছরের বেশি বয়সী আমগাছটার কাছে তার যাওয়া দরকার। বাসের সুপারভাইজার মৌতলার মুকুল মুনশীকে বলে তিনি গেলেন গাছটির কাছে। আশ্চর্য! পারভেজ সরদারকে দেখেই গাছটির ডালপালা একটি আলোড়ন জাতীয় ভঙ্গি করে যেন অভ্যর্থনা জানাল। জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখায় পারভেজরা ছোটবেলায় পড়ে জেনেছিল গাছেরও প্রাণ আছে। আজ তার মনে হলো, গাছেরা কথাও বলে। আল কুরআনের সূরা রহমানের ৬ নং আয়াতে আছে, ‘নক্ষত্রমালা আর বৃক্ষরাজি সৃষ্টিকর্তাকে সিজদা করে’। ব্যস মিলে গেল। শতবর্ষী আমগাছটির জবান যেন খুলে গেল। হিপনোটাইজড পারভেজকে সে গড় গড় করে যা বলতে লাগল, আশ্চর্যের বিষয়, তা যেন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ভোল পাল্টানের পদাবলী। গাছটি বলে চলল, ‘দেখো বাপু- আমার বয়স বর্তমানে ১১০-১২ হবে। আমাকে ত্রিকালদর্শী (ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) বলতে পারো। আমি নামীদামি, শক্ত সমর্থ্য, হোমরা চোমরা দল বা জোট বা প্রজাতির কেউ নই, অনেকটা নামহীন গোত্রহীন পরিবারে আমার জন্ম। যে মহাসড়ক দিয়ে সবাই এখন ঢাকা-খুলনা-বেনাপোল-কলকাতায় যাতায়াত করে এসব রাস্তা সেসময় ছিল স্বপ্নেরও অতীত। দূরের নদীপথে সবাই যাতায়াত করত। রাস্তাঘাট হওয়াতে এখানে এখন অনেকেই থামে- তাদের সাথে আমার সাক্ষাতের সম্ভাবনায় এমনকি শলাপরামর্শের জন্য ময়মুরুব্বি জ্ঞানে এই শতবর্ষী আমাকে দেখানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে আমার চেয়েও বয়সে অনেক বড় বৃক্ষ হয়তো আছে; কিন্তু কেউ তাদের এভাবে দেখতে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে অন্তত আমি শুনিনি।

শুনব কিভাবে, ইউটিউব ফেসবুক নামের কত কি আজকাল ঘরদোরের সব খবরাখবর এমনভাবে ছড়াতে ছিটাতে পারে, কিছুদিন আগেও যা সম্ভব ছিল না। এখন শুনছি চ্যাট জিপিটি, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কি যেন একটা এসেছে যা সবার মনের কথাও ফাঁস করে দিতে পারে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নের উত্তরও পর্যন্ত পাঠিয়ে দিতে পারে। কি ভয়ঙ্কর কথা! এবারে এই সেদিন এইসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। ফলাফল নাকি নাহিদ মিয়ার জিকিরে জাগরিত বন্যার লাহান পাশের প্লাটফরম ৭০ ডিগ্রি উল্টিয়ে গিয়েছে। অন্তত কয়েক শ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজনও নাকি পাস করেনি। আবার শুনতে পাই এই এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য অনশন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হায়রে, যাদের ট্যাক্সের টাকায় তারা বেতন ভাতা পায় তাদের পোলাপানরে পড়ানোর বেলায় মন নাই- নিজেদের বেতন বাড়ানোয় ব্যস্ত। আচ্ছা, তারা কি ভেবে দেখেছে এই মাঝখানের সরকার তাদের বেতন বাড়াবে বা কথা দেবে কিভাবে- তাদের কাছ থেকে লেখাপড়া বুঝে নেবে কারা? লাখ লাখ টাকা খেয়ে যারা তাদের এমপিও বানাইছে তারা কই? তাদের হাতে রাখার জন্য যারা একসময় ফাল পাড়ত তারা তো বর্তমানের এই নিরীহ সরকারের কাজে কামে নেই।

কিছুটা বিরক্ত পারভেজ সরদার বলল, হে প্রাচীন বৃক্ষ তোমার কাছে বস্তাপচা কথা শোনার সময় নেই, বাস আমাকে ছেড়ে চলে যাবে- আমাকে সাতক্ষীরার পারুলিয়ায় ফিরতে হবে। সেখানে রাস্তা বড় করার কাজ শুরু হয়েছে- ভোমরায় কাস্টমস হাউজ হওয়ার ঘোষণা এসেছে। হে বৃক্ষ, আপনি আজকালের আন্দোলন অর্থনীতি রাজনীতি নিয়ে যা জানেন তা বলেন। গাছটি হেসে বলল, সরদার! তোমার মাথায় এসব বিষয় বেশ জট পাকাচ্ছে বিলকুল বুঝতে পারি। তুমি শুনে রাখো, এ সবে বিচলিত বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এসব দরকষাকষি শয়তানি বাঁদরামির সূত্রপাত হয়েছে সেই স্বর্গবাসের কাল থেকে। শয়তান যদি কুমন্ত্রণা না দিত আর বাবা আদম এবং মা বিবি হাওয়া নিষিদ্ধ গাছের ফল যদি না খেতেন তাহলে আমরা সবাই এতদিন বেহেশতেই থাকতাম। যা হোক, যা হওয়ার তাই হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়া শয়তানের সেই কর্মসূচি ঠিকই অব্যাহত আছে। যদিও শয়তানের বিজয় ঠেকানোয় মানুষের চেষ্টা প্রচেষ্টাও থেমে নেই। টাইব্রেকারে জয়-পরাজয় দেখার জন্য অপেক্ষারও শেষ নেই।

আবেগে তাড়িত ভাববাদী আমাদের এই জনপদে বিদেশীদের আগমন ধ্যান ভাঙানোর জন্য শুধু নয় আমাদের কূটকৌশলে পরাস্ত করতে, মোদ্দাকথায় পদাবনত রাখতে, আমাদের নিজেদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতেই ‘বিশ্বাসঘাতকদের হাত করেই ঘটেছে এখানে বিদেশীদের আগমন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগও কিন্তু বিদেশী শক্তির কূটচালের পরিণতি এবং নিজেদের মধ্যে ঐকমত্যের ওজস্বিতা নয় মতানৈক্যের মাসুল দিতেই হয়েছে। ব্যক্তি বা সম্প্রদায়গত স্বার্থসিদ্ধির ঘোরটেপে ভারত বিভাগ- তারপর দু’দুটি বিবদমান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। উভয়েই চেয়েছে পরস্পরকে রুখে দিতে- যেটা চেয়েছিল এবং এখনো চাচ্ছে বহিরাগত শক্তি। বারবার নিজেদের মধ্যে স্বৈরাচার সৃষ্টির সুযোগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, একজনের যৌথ সংসার ভাঙে, তাতে লাভ হয় পাড়া-প্রতিবেশীর। ভূরাজনীতির ভায়েরা ভাই সবসময় ওঁৎ পেতে আছে। পাকিস্তানের ভাঙা ভাঙতি ভারতকে শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশের উদ্ভব ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্যারম বোর্ড খেলার মতো একে অন্যের ঘুঁটি গর্তে ফেলার তালে আছে। শতবর্ষী আমগাছ এ খবরও রাখে। আফগানিস্তান তার পরম বন্ধু পাকিস্তানকে আক্রমণ করে আত্মঘাতী অবস্থার সৃষ্টি করেছে কার মদদে। পেশাদার কূটনীতিকদের মতো শতবর্ষী গাছ বেশি কিছু খোলাসা করতে চাইলেন না। দেশিক রাজনীতিতে সমঝোতা শব্দটি দিন দিন দুর্বল হতে হতে তলানিতে ঠেকেছে। মর্লি মিন্টো সংস্কার, ক্রিপস মিশন, বাউন্ডারি কমিশন, মুজিব-ইয়াহিয়া সমঝোতা সংলাপ, স্বাধীন বাংলাদেশের তারানকোর সমঝোতা, বার্নিকাট, পিটার হাসদের দৌড়ঝাঁপ কম দেখেনি এ দেশের মানুষ। এখন জুলাই সনদ প্রণয়নের সময়কার মাহফিলগুলো থেকে একই কিম্ভূতকিমাকার ফলাবর্তন বেরিয়ে আসছে। মনে নেই? মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনায় মাঝে মধ্যে আশার আলো হাতছানি দিতে চেয়েও দেখা দেয়নি। কেননা উভয়ের পেছনে শয়তানের প্ররোচনা প্রবল ছিল, সক্রিয় ছিল দুরভিসন্ধি। অসম্ভব সব শর্ত একে একে সামনে আসছিল উভয় পক্ষ থেকে। দুইপক্ষের নেতাদের স্বার্থবাদী রাজনৈতিক জেদাজেদিতে শেষমেশ সাধারণ জনগণকেই রক্ত দিতে হয়েছিল। ভারত ভাগের সময় ঐক্যবদ্ধ বাংলা এবং পাঞ্জাব দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মর্মান্তিক দাঙ্গায় মারা গিয়েছিল অতি সাধারণ মানুষ ও পরিবার। ’৭১-এ এক নদী রক্ত পেরিয়ে, ২৪-এর জুলাইয়ে শত সহস্র্র ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়ে যে বিজয় তাকে ধারণ করতে হবে মননে। ব্রিটিশের সেই প্রবাদ ‘গরিবেরা রাঁধে বাড়ে বড়রা খেয়ে শেষ করে’।

মহান মুক্তিযুদ্ধে মানুষ রক্ত দিলো, সামাজিক সুবিচার, মানবিক মর্যাদা, আইনের শাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অথচ স্বাধীনতার প্রথম চার বছরে দেখা গেল স্বৈরাচারের আস্ফালন এবং অ-মুক্তিযোদ্ধাদের মাতব্বরি। কার বিজয় কে ছিনিয়ে নিলো। প্রতিবাদকারীদের কচুকাটা করা হলো। প্রতিক্রিয়া সবংশ নির্মূল হওয়ার জোগাড়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ঐক্যবদ্ধ, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হলেও ছয় বছরের মাথায় ছদ্মবেশী স্বৈরাচার আবার এলো। আবার আট বছর অপেক্ষা, গণতন্ত্র এলো কিন্তু টিকতে দেয়া হলো না- দেশ ও জাতি ও অর্থনীতিকে চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, দ্বিধাবিভক্ত এবং বৈষম্যের বিবরে ঠেলে দিয়ে গণরোষের সামনে টিকতে না পেরে পতিত স্বৈরাচার বিদায় নিলো। কিন্তু ষড়যন্ত্রের এমন বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেল- ঐকমত্যকে অসম্ভব করে তোলার জন্য সমঝোতার বাড়া ভাতে ছাই দিতে যেন অনেকেই তৎপর। পতিত স্বৈরাচার আড়ালে হাসছে। এ নাটকীয় মুহূর্তে বৈষম্যের শিকার সেই স্বজনহারা, নিপীড়িত শোষিত বঞ্চিত ছাত্র-জনতা কোথায়? বড় বড়রা শলাপরামর্শ করে দরকষাকষি করে জনগণকে স্বস্তি দেয়ার পথে বাগড়া দিচ্ছে কারা। এক সনদে একসাথে সব পেতে চাওয়ায় অনেক কিছুই না পাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ বুঝতে চাচ্ছে না যে, দাঁড়াতে না দিলে অর্থনীতি সমাজ রাজনীতি দৌড়াবে কী করে?

স্বর্গচ্যুত সেই শয়তান যে মানুষের মনে মরীচিকার মোমবাতি জ্বালিয়ে সুখকে স্থায়ী করার জন্য আর দুঃখে ভেঙে পড়ে হিতাহিত জ্ঞান হারাবার কত কনসালট্যান্সি ওরফে শলাপরামর্শই না দিয়ে চলেছে। সুখ সন্ধান আর তার স্থায়িত্বকরণের উগ্র আকাক্সক্ষায় মাত্রাতিরিক্ত প্রয়াস প্রচেষ্টা প্রকৃতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের পরিপন্থী। ক্ষেত্র ও পাত্রভেদে অনেক কিছুতে মাত্রাতিক্রমণের ফলে বিপরীত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। যেমন অধিক মাত্রায় সাহস হঠকারিতায়, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত হতে পারে। কথায় বলে বীপবংং ড়ভ ধহুঃযরহম রং ধষধিুং নধফ. বৈধ-অবৈধতার রুলস অব বিজনেস সবার ঠিকমতো জানা না থাকায় অবৈধতার অব্যাহত অগ্রযাত্রা দেখে অনেকে নিজের প্রতি নিজের আস্থা অটুট রাখার ক্ষেত্রে বেসামাল বোধ করেন। ইতিহাসের পাতার দিকে নজর দেয়ার সময় হয় না বলেই হয়তো শুক্রবারে জুলাই সনদের শর্তসাবুদ নিয়ে সবাই সব কিছু ভাবার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। শুক্র শনিবারের পর রোববার আছে সোমবার আসবে একথা মানলে ক্রমে বাকি অপূর্ণতার পূর্ণতায় স্থায়িত্ব ধারণকল্পে আরজি পেশ করার সুযোগ থাকবে। দেবহাটার পিয়ার আলীকে এখনো অনেকে চেনে না। তাকে নিয়ে এ যাত্রায় টানাটানি না করে তাকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

শতবর্ষী আমগাছটি যখন জাপানের সেই প্রবাদ (বা উপদেশ ‘একসাথে পাঁচ ইদুর ধরা যায় না, ধরতে যেতে নেই’) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল তখনই সম্বিৎ ফিরে আসে পারভেজ সরদারের, সোহাগ পরিবহনের সুপারভাইজার মৌতলার মুকুল মুনশী তাকে ধরে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছে।

লেখক : অনুচিন্তক