মোহন মিয়া, মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ

মোহন মিয়া এক কালজয়ী নেতা, মহান ব্যক্তিত্ব, তাকে ভোলা যায় না। তার কাছে দেশবাসীর ঋণ সীমাহীন। মোহন মিয়া মানেই এক আপসহীন সংগ্রামী নেতা। স্বদেশের কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

ডা: ননীগোপাল সাহা

ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশিষ্ট নাম। প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যে যুগে মোহন মিয়া জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেন সেটি ছিল সাফল্যের যুগ। সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি কোনো ক্ষেত্রেই শূন্যতা ছিল না। অভাব ছিল না যোগ্য নেতৃত্বের।

সে দিনের রাজনৈতিক অঙ্গনে মোহন মিয়া ছিলেন সুযোগ্য ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন এই বাংলার মাটি ও মানুষকে। তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল মানবতাবাদ। বর্তমান এই পুঁজিবাদ প্রভাবিত বিশ্বে চূড়ান্ত মানবতাবাদের স্তরে হয়তো কোনো দিনই আমরা পৌঁছাতে পারব না। এই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসে তাকে জানার কিছুটা সুযোগ হয়েছিল। মোহন মিয়া পুঁজিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ কোনোটিতেই বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রে।

১৯৪৫-৪৭ সালে ফরিদপুরে স্কুলজীবনে তাকে দেখেছি। বিরাট মিছিলের পুরো ভাগে মাল্যভূষিত একটি সৌম্য শান্ত মানুষ অম্বিকা ময়দানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনিই ফরিদপুরের জনপ্রিয় নেতা মোহন মিয়া। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বার ঢেউ দিল্লি থেকে তখন সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফরিদপুরের সেই গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইউসুফ আলী মোহন মিয়া। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দিনটিতে মোহন মিয়া ফরিদপুরে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। মুসলিম লীগে থাকলেও তিনি ভাষা আন্দোলনে নূরুল আমিনের কার্যক্রম সমর্থন করেননি। ওই সময় মোহন মিয়া ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা জানান।

১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে নেতাজি সুভাষ গেট, গান্ধী গেট তৈরি করে বিতর্কিত হন এবং পাকিস্তানিদের বিরাগভাজন হন। এ সময়ই তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ এবং সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে দীর্ঘ কয়েক বছর রাজনৈতিক কার্যক্রম একেবারেই স্তিমিত হয়ে পড়ে। স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বা পৃথকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

ষাটের দশক থেকেই ধীরে ধীরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ১৯৬২ সালের জুন মাসে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে সব বিরোধী দলের নেতারা একমত হন। তারা একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করেন, যেটি ৯ নেতার বিবৃতি নামে পরিচিত। ৯ নেতার মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মুসলিম লীগ নূরুল আমিন, ন্যাপ থেকে মাহমুদ আলী, নেজামী ইসলাম থেকে পীর মোহসিন উদ্দিন এবং কৃষক পার্টি থেকে হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) ও ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া।

মোহন মিয়াদের এই বিবৃতি গণসমর্থন লাভ করে। জনগণের মধ্যে একটা আশার আলো সঞ্চারিত হয়। আইয়ুব খান রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের ৩০ জুন জাতীয় পরিষদে একটি বিল আনেন। সংক্ষেপে এবডো নামের এ আইনে যেকোনো রাজনৈতিক নেতাকে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে, তিনি কোনো দল গঠন করতে পারবেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সব বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করেন।

এই জোটে ৫৪ জন নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। তার মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ ৯ নেতার সবাই ছিলেন যেমন ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, নুরুল আমিন, আজিজুল হক, আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ।

মোহন মিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কর্মবহুল দিন ছিল ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে আইয়ুববিরোধী প্রচারণার দিনগুলো। মোহন মিয়ার জনপ্রিয়তা ছিল সবার শীর্ষে, সাধারণ মানুষকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন অত্যন্ত আপনজনের মতো। সাধারণ মানুষও তাকে দেখতেন প্রিয়জনের মতো।

আইয়ুব খানের সামনে সব পথ তখন অবরুদ্ধ। উপায়ন্তর না দেখে তিনি দ্রুত ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন।

মোহন মিয়া এক কালজয়ী নেতা, মহান ব্যক্তিত্ব, তাকে ভোলা যায় না। তার কাছে দেশবাসীর ঋণ সীমাহীন। মোহন মিয়া মানেই এক আপসহীন সংগ্রামী নেতা। স্বদেশের কল্যাণই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।