নির্বাচনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে; সেই সাথে একের পর এক নির্বাচনী জরিপ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মনস্তত্তে¡র স্পন্দন ধরতে চাইছে। এ জরিপগুলোর মধ্যে একটি বিশেষভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে আকৃষ্ট করেছে, যা প্রকাশ করেছে দলটি বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পাচ্ছে। সংখ্যাটি জামায়াত ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ জাগিয়েছে। তবে সবাই এতটা আশ্বস্তও নন। ১৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখের প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি মতামত নিবন্ধ এ অনুমানকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ ও ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। উৎসাহ ও সংশয়ের এ প্রেক্ষাপটে কৌতূহল শুধু এই নয় যে, উল্লিখিত সংখ্যা কতটা নির্ভরযোগ্য; বরং এটিও যে, এই জরিপ আদৌ কি নির্বাচনে জামায়াতের সম্ভাব্য আসনসংখ্যা সম্পর্কে কার্যকর কোনো পূর্বানুমান দেয়?
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইনোভিশন কনসালটিং দেশব্যাপী পরিচালিত একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে, যা দ্রুত রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। জরিপের ফলে দেখা গেছে, দেশের জনসংখ্যার আনুমানিক ৪১ শতাংশ বিএনপিকে সমর্থন করছে, যেখানে জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ সমর্থন। ২০২৫ সালের মার্চ মাসের জরিপের তুলনায় উভয় দল- বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জনসমর্থনের দিক থেকে এ জরিপে জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। বিপরীতে একই সময়কালে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ সমর্থনের পরিসংখ্যানটি জামায়াতে ইসলামীর কাছে রাজনৈতিক সাফল্যের প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়েছে। জামায়াত-সমর্থকদের মুখে এখন ৯০ থেকে ১০০ আসনের জয়ধ্বনি; আর আশাবাদের শিখরে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ খোলাখুলি স্বপ্ন দেখছেন- পরবর্তী সরকার গঠনের মঞ্চে তাদের পদচারণা।
ঠিক এখানে রয়েছে মূল ভ্রান্তিটি। বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ব্যবস্থা নেই, যেখানে ভোটের শতকরা হার অনুযায়ী সংসদীয় আসন নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যবস্থাটি হলো- ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট, যেখানে জয় নির্ভর করে ভোটের সামগ্রিক হার নয়; বরং আসনভিত্তিক বণ্টনের ওপর। ইতিহাস থেকে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ- উভয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু ফল ছিল ভিন্ন : বিএনপি লাভ করেছিল ১৪০টি আসন, আর আওয়ামী লীগ ৮৮টি। জাতীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর এ হার ছিল ১২ শতাংশ, অর্থাৎ বিএনপির ভোটের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেলেও তারা মাত্র ১৮টি আসন পায়, যা বিএনপির আসনের এক-তৃতীয়াংশের ধারে কাছেও না। আবার ১৯৯৬ সালে বিএনপির ভোটের হার ৩ শতাংশ বেড়েছিল; কিন্তু আসন সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১১৬-তে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পায়। কিন্তু ফলে দেখা যায়, বিএনপি ১৯৩টি আসন লাভ করে, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৬২। বার্তাটি স্পষ্ট, বাংলাদেশে ভোটের হার বাড়লে সংসদে আসন বাড়বে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই; বরং উল্টো অনেক সময় ভোট বাড়লেও আসন সংখ্যা কমে যেতে পারে। সুতরাং, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ৩০ শতাংশ ভোট প্রাপ্তিকে ১০০টি আসন বা সরকার গঠনের নিশ্চয়তা হিসেবে বিবেচনা করা বাস্তবতাবর্জিত- এটি পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি, একধরনের আশাবাদী কল্পনা।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) আরেকটি বড় জরিপ পরিচালনা করে, যার ফল ইনোভিশনের জরিপ থেকে বেশ ভিন্ন বার্তা দেয়। যখন ভোটদানের অভিপ্রায় নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়, তখন ১২ শতাংশ উত্তরদাতা বিএনপিকে ভোট দেয়ার কথা জানান, আর ১০ দশমিক ৪ শতাংশ জানান, তারা জামায়াতকে সমর্থন করবেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ভোটদানের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তহীনতার কথা জানান। কিন্তু একই ব্যক্তিদের কাছে যখন নিজ নির্বাচনী এলাকায় সম্ভাব্য বিজয়ী সম্পর্কে মতামত চাওয়া হয়, তখন দৃশ্যপট উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়- ৩৮ শতাংশ বিএনপির বিজয়ের পূর্বাভাস দেন এবং ১৩ শতাংশ বলেন জামায়াতে ইসলামীর কথা। এ বৈপরীত্য নির্দেশ করে, প্রশ্ন করার পদ্ধতি জরিপের ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। সরাসরি ‘আপনি কাকে ভোট দেবেন?’ এ প্রশ্নে প্রতিফলিত হয় ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পছন্দ; কিন্তু ‘আপনার এলাকায় কে জিতবে?’ এ প্রশ্নে প্রতিফলিত হয় স্থানীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে ভোটারদের উপলব্ধি ও মূল্যায়ন। শিক্ষাটি হলো জাতীয় পর্যায়ের মোট ভোটের শতকরা হিসাব আসলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির প্রকৃত চিত্রকে অনেক সময় ছোট করে দেখায়, অথবা ভুলভাবে উপস্থাপন করে। মোট ভোটের পরিসংখ্যানের তুলনায় নির্বাচনী আসনভিত্তিক বিশ্লেষণ বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ের রাজনৈতিক শক্তির বাস্তব রূপ অনুধাবনে বেশি কার্যকর।
পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ফল জরিপের তথ্য থেকে অনুমান করার ক্ষেত্রে তিনটি বড় সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের ইতিহাসে এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে এক অভূতপূর্ব নজির। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে, দেশের অন্যতম বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। দলের বহু নেতা এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। সেই সাথে দলটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ ও অপরাধের দায় স্বীকার বা ক্ষমা চাওয়ার কোনো অর্থবহ উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। গত কয়েক দশক ধরে আওয়ামী লীগ জাতীয় ভোটের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পেয়ে এসেছে। এমন একটি বিশাল শক্তি হঠাৎ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে হারিয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়- দলটির সমর্থকরা এবার কী করবেন? আওয়ামী লীগের ভোটাররা কি একযোগে বিএনপির দিকে ঝুঁকবেন, যেটি বর্তমানে বৃহৎ জাতীয় দল? নাকি কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করবেন, যে দলটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার সাংগঠনিক শক্তি ফিরিয়ে আনছে? অথবা আওয়ামী লীগের অনুগত ভোটাররা কি নির্দিষ্ট আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা গোপনে মনোনীত প্রতিনিধিদের ভোট দেবেন? আরেকটি সম্ভাবনা হলো দলটির ভোট বিভিন্ন দলে আনুপাতিক হারে ভাগ হয়ে যাবে। সত্য হলো, এ মুহূর্তে কেউ এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবেন না। এ কারণে আওয়ামী লীগের প্রচলিত ভোটব্যাংককে পরিসংখ্যানগত বা গাণিতিক কোনো মডেলের মাধ্যমে অন্য দলে পুনর্বণ্টন করা কার্যত অসম্ভব। শুধু এ কারণে ২০২৬ সালের নির্বাচনের যেকোনো জরিপভিত্তিক পূর্বানুমানকে খুব সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে- ‘আপনি কাকে ভোট দেবেন’-এ ধরনের প্রশ্ন দলভিত্তিক ভোট শতাংশের একটি মোটামুটি ধারণা দিতে পারে; কিন্তু তা আসনপ্রাপ্তির সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম নয়। তবে এটি কোনোভাবে প্রতিটি দল কতটি আসন পাবে তার ইঙ্গিত দেয় না। এখন পর্যন্ত কোনো জরিপ আসনভিত্তিকভাবে পরিচালিত হয়নি, ফলে কোন দল কতটি আসন পেতে পারে, সে বিষয়ে এ জরিপগুলো কোনো স্পষ্ট ধারণা দেয় না।
তৃতীয়ত, শুধু এ জরিপগুলোর প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী করা গণিতিক বিচারে অযৌক্তিক। সম্ভাব্যতা তত্তে¡ টমাস বেয়সের উপপাদ্য একটি মৌলিক অথচ গভীর ধারণা হিসেবে পরিচিত, যা বেশির ভাগ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকে বা অন্তত পরিচিতির পর্যায়ে থাকে। এ উপপাদ্য ব্যবহার করা হয় কোনো ঘটনার সম্ভাবনা নির্ণয়ে; যেখানে অতীতের অভিজ্ঞতা বা জানা তথ্য (যাকে বলা হয় প্রায়র) এবং নতুন পাওয়া তথ্য একত্রে বিবেচনা করে কোনো ঘটনার সম্ভাব্যতা পরিমাপ করা হয়। সহজভাবে বললে, নতুন তথ্য আসলে কিভাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে পূর্বাভাস সংশোধন করতে হয়, বেইসের উপপাদ্য তা শেখায়।
এবার নির্বাচন প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশের ৩০০টি আসন রয়েছে, যার প্রতিটির রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, জনতাত্তি¡ক গঠন, আর ভোটের ধারা। জাতীয় পর্যায়ের একটি ছোট জরিপ, যেখানে কয়েক হাজার মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয় তারা কাকে ভোট দিতে পারেন- এটি কেবল একটি মুহূর্তের ক্ষুদ্র ছবি, যা প্রতিটি আসনের বাস্তব গতিশীলতা ধরতে পারে না। কাজটি যথাযথভাবে করতে হলে প্রতিটি আসনে কয়েক হাজার মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে হতো। এ সীমাবদ্ধতায় অপরিশোধিত জরিপ-তথ্য প্রায়ই পরিসংখ্যানগতভাবে অনির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে।
‘বেয়সীয়’ বিশ্লেষণ পদ্ধতির মূল কার্যপ্রণালী হলো প্রতিটি নির্বাচনী আসনের পূর্ববর্তী ফলকে প্রায়র হিসেবে গ্রহণ করে এবং নতুন জরিপ তথ্য বা রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভিত্তিতে সেই পূর্বানুমানকে পরিমার্জন করে সম্ভাব্য ফল নিরূপণ করা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে আমরা আগের তথ্যের সাথে সদ্য প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণাকে ক্রমাগত পরিশীলিত করি। যদি তথ্যের ধারাবাহিক হালনাগাদ না হয়, তাহলে জরিপের ফল হয়ে ওঠে দিশেহীন ঢেউ- এলোমেলো নমুনার খেয়ালে ভেসে কখনো আশার ভেলায় ভাসায়, কখনো ডুবিয়ে দেয় বিভ্রান্তির অতলে। বিপরীতে বায়েসীয় মডেল অনেক বেশি বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরে- বিশেষত কোন দল কোন আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা রাখে, তা নিরূপণে।
সর্বোপরি ইনোভিশন কিংবা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ থেকে পাওয়া ভোটের প্রাথমিক উপাত্তের শতকরা হারকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাভাস হিসেবে গ্রহণ করা বিভ্রান্তিকর হবে। এসব জরিপ মূলত একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের জনমত প্রতিফলিত করে, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্লেষণ করলে তা বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার বহুমাত্রিক ও জটিল গতিশীলতা যথাযথভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। এসব জরিপকে স্বতন্ত্রভাবে ভবিষ্যদ্বাণীর হাতিয়ার হিসেবে নয়; বরং অতীতের ভোটাভ্যাস থেকে, যা জানা আছে তার সাথে নতুন তথ্য যোগ করে হালনাগাদ করার কাজে ব্যবহার করা উচিত। এটি মূলত বেয়সীয় দৃষ্টিভঙ্গির সারকথা- ইতিহাসকে নতুন তথ্যের সাথে সমন্বয় করে যুক্তিসঙ্গত পূর্বাভাস তৈরি করা।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি।