ওসমান হাদি : বিপ্লবের মহাবিস্ফোরণ

শহীদ ওসমান হাদি আমাদের শিখিয়ে দিলেন কিভাবে জীবন দিয়ে একটি মৃত জাতিকে জীবিত করা যায়। হাদির এ মহাবিস্ফোরণ স্তব্ধ হবে না; বরং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

আকাশের গহিনে তখন কৃষ্ণপক্ষের মেঘ জমছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে এক অশুভ নিস্তব্ধতায়। ঠিক সেই মুহূর্তে এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে গেল একটি জীবন। অথবা বলা ভালো একটি জাতির সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। শহীদ শরিফ ওসমান হাদি তখন নিথর। তার কপালে লেপ্টে থাকা রক্তের আল্পনা যেন এক ক্যালিগ্রাফি। সেই রক্ত কেবল একটি ধমনীর ছিন্ন হওয়া নয়; বরং তা ছিল কয়েক দশকের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার এক মহাকাব্যিক প্রারম্ভিকা। জনপদ তখন স্তব্ধ হয়ে দেখল, এক সাধারণ যুবকের দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে অসাধারণ এক সুবাস। মুমিন হৃদয়ের বিশ্বাসে যা জান্নাতি খুশবু, শাহাদতের অমিয় অম্লান সুধা।

হাদি জানতেন না, তার এই নিষ্ক্রমণ আসলে একটি দীর্ঘকালীন দম্ভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া রচনা করবে। তার নিথর দেহটি যখন রাজপথের ধুলোয় শয়ান, তখন চারদিকে এক বিচিত্র নীরবতা। সেই নীরবতা কোনো ভয়ের বহিঃপ্রকাশ ছিল না; বরং তা ছিল এক মৌন বিপ্লবের গর্জন। ঠিক যেন প্রলয়ের আগের থমথমে মুহূর্ত। ঘাতক ভেবেছিল, একটি বুলেট বুঝি একটি কণ্ঠকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু তারা অনুধাবন করতে পারেনি, হাদির রক্ত যখন বাংলার পলিমাটিতে মিশল, তখন সেই মাটি থেকে অঙ্কুরিত হলো সহস্র কোটি দ্রোহের বীজ। ইসলামের ইতিহাসের সেই শাশ্বত সত্য যেন আবারো মূর্ত হয়ে উঠল, শহীদের রক্ত বৃথা যায় না। তা বরং জালেমের সিংহাসনের পায়াগুলো কুরে কুরে খায়। হাদির শাহাদত যেন এক আধ্যাত্মিক সংযোগ তৈরি করল আপামর জনতার হৃদয়ে। যারা এতদিন বিভক্ত ছিল, হাদির সেই শান্ত মুখচ্ছবি তাদের সবাইকে এক সুতোয় গেঁথে দিলো।

ইতিহাসের পাতায় মাঝে মধ্যে এমন কিছু মাহেন্দ্রক্ষণ আসে, যখন একটি সাধারণ মৃত্যু হয়ে ওঠে অসাধারণ এক রাজনৈতিক ভূমিকম্প। শহীদ ওসমান হাদির নিথর দেহটি যখন জনসম্মুখ দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়নি ঠিকই; কিন্তু প্রতিটি মানুষের বুকের ভেতর এক অদৃশ্য কম্পন অনুভূত হচ্ছিল। ঘাতক চক্রের দীর্ঘকাল ধরে লালিত যে দম্ভ, যে আধিপত্যের সুউচ্চ প্রাচীর তারা নির্মাণ করেছিল, হাদির এক ফোঁটা রক্তে সেই প্রাচীরে প্রথম ফাটল ধরল। জালেম যখন ভাবে সে চূড়ান্ত বিজয়ী, ঠিক তখনই মজলুমের রক্ত এক অলৌকিক শক্তির সঞ্চার করে। হাদির মৃত্যু যেন সেই অদৃশ্য শক্তির এক পার্থিব প্রকাশ।

সমগ্র জনপদ তখন এক অদ্ভুত মোহনায় এসে থমকে দাঁড়াল। হাদির শাহাদত কোনো দলের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকল না; বরং তা হয়ে উঠল প্রত্যেক মুক্তিকামী মানুষের অভিন্ন পরিচয়। আমরা দেখলাম এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। যারা গতকাল পর্যন্ত আদর্শিক দ্ব›েদ্ব লিপ্ত ছিলেন, যারা মুখ ফিরিয়ে ছিলেন পরস্পর থেকে, হাদির রক্তমাখা শার্টটি তাদের সবাইকে এক পতাকাতলে নিয়ে এলো। এটিই সেই ‘মৌন বিপ্লব’ যা কোনো ব্যানার বা স্লোগান ছাড়াই মানুষের অন্তরে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। হাদির এ নীরব আত্মত্যাগ যেন এক অমোঘ সত্যের দিকে আঙুল তুলে দেখাল, জুলুমের আয়ু চিরকাল সীমিত। হাদির রক্তমাখা রাজপথ আজ কেবল একটি পথ নয়, এটি আজ মুক্তির এক মহাসড়ক।

শহীদ ওসমান হাদির শাহাদত কোনো বিচ্ছিন্ন জাগতিক ঘটনা নয়; বরং এটি ছিল এক আধ্যাত্মিক বিস্ফোরণ। যখন পাপাচার ও জুলুমের ঘনঘটা একটি জনপদকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তখন মহান রব এমন কিছু আত্মাকে মনোনীত করেন; যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে জাতির ঝিমিয়ে পড়া চেতনা পুনরুজ্জীবিত করেন। হাদি ছিলেন সেই নির্বাচিত মর্দে মুমিন। তার শাহাদত যেন সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মানদণ্ড হয়ে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হলো। একপাশে দাঁড়িয়ে রইল পাশবিক মদমত্ততা, অন্যপাশে এক শান্ত অথচ ইস্পাতকঠিন ঈমানি দৃঢ়তা।

এ বৈপ্লবিক যাত্রায় হাদি যে নীরবতার আশ্রয় নিলেন, তা ছিল সহস্র তূর্যধ্বনির চেয়েও প্রখর। ইসলামের ইতিহাসে যেমন দেখা যায়, কারবালার প্রান্তরে জিলহজ মাসের সেই তপ্ত বালুকারাশিতে শুয়ে থাকা নিথর দেহগুলো ছিল জালেমের পরাজয়ের মূল কারণ; ঠিক তেমনি বাংলার রাজপথে হাদির শয়ান শরীরটি হয়ে উঠল আধুনিক সময়ের এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। ঘাতকের বুলেট তার মস্তিষ্ক ভেদ করলেও তার আদর্শকে স্পর্শ করতে পারেনি; বরং সেই রক্তকণাগুলো যখন মাটির সংস্পর্শে এলো, তখন সেখান থেকে বিচ্ছুরিত হলো এক অতিপ্রাকৃত আলো। মানুষের মন থেকে মুছে গেছে পার্থিব ভয়ের গ্লানি। হাদির এ ত্যাগে এক অদ্ভুত রুহানি শক্তি সঞ্চারিত হলো সাধারণ মানুষের ধমনীতে।

মহাকালের আবর্তে নশ্বর দেহ বিলীন হলেও সত্যের আলোকবর্তিকা কখনো নির্বাপিত হয় না। শহীদ ওসমান হাদি আজ কেবল একটি নাম কিংবা একটি স্মৃতিমাত্র নন; তিনি আজ এক ধারাবাহিক উত্তরাধিকার। হাদির শাহাদত প্রমাণ করল, যখন কোনো জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উৎসর্গ করতে শেখে, তখন সেই জাতির ললাট থেকে পরাজয়ের গ্লানি চিরতরে মুছে যায়। হাদির এই আত্মদান যেন এক নতুন ঊষার পূর্বাভাস, যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ হবে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। একটি জনপদের মুক্তি কামনায় হাদি যে বীজ বপন করে গেলেন, তার ফসল একদিন ঘরে তুলবে পুরো বাংলাদেশ। হাদির সেই শান্ত অথচ দৃঢ় সঙ্কল্প আজ কোটি তরুণের ধমনীতে দ্রোহের আগুন হয়ে জ্বলছে।

হাদি চলে গেছেন ঠিকই; কিন্তু রেখে গেছেন এক অজেয় ইস্পাত-দৃঢ় জাতীয় ঐক্য। হাদির রক্তে আজ ধুয়ে-মুছ গেছে সব অপশক্তির দাম্ভিকতা। সেই স্থানে এখন অঙ্কুরিত হচ্ছে এক নতুন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে প্রত্যেক মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাবেন, যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি হবে বিগত অতীত।

ইতিহাসের গতিপথ কখনো সরলরেখায় চলে না; বরং তা অন্যায়ের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে এক সময় আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ে। আমরা যখন সময়ের নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ করি, তখন স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, হাদির রক্ত কেবল রাজপথ রঞ্জিত করেনি; বরং তা একটি শাসকগোষ্ঠীর কয়েক দশকের রাজনৈতিক বিনিয়োগকে মুহূর্তে দেউলিয়া করে দিয়েছে। শহীদ হাদি আজ আধিপত্যবাদী দর্শনের কফিনে শেষ পেরেক। এটি কেবল একটি লাশের ভার ছিল না, এটি ছিল কয়েক যুগের পুঞ্জীভূত পাপের এক অসহনীয় বোঝা, যা বহন করার ক্ষমতা কোনো রাজনৈতিক শক্তির থাকে না।

রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির নিছক পাটিগণিত দিয়ে হাদির এ আত্মত্যাগ পরিমাপ করা যাবে না। ঘাতক পক্ষ ভেবেছিল, হাদিকে স্তব্ধ করলে তাদের ভবিষ্যতের রাজনীতি নিষ্কণ্টক হবে। অথচ তাদের এ হঠকারী ও অমানবিক সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে নিজেদের অস্তিত্বের মূলে আঘাত হেনেছে। হাদি আজ একটি আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছেন, যেখানে জাতি তার নিজের ললাটে আঁকা অপশক্তির কঙ্কাল দেখতে পেয়েছে। হাদি চলে গেছেন সত্য; কিন্তু তিনি রেখে গেছেন এমন এক অজেয় এবং ইস্পাত-দৃঢ় জাতীয় ঐক্য, যা ইতঃপূর্বে এই জনপদে ছিল বিরল। আজ বাংলার ঘরে ঘরে যে হাহাকার, তা কেবল এক হাদির জন্য নয়; তা হলো হারানো গণতন্ত্র এবং ভূলুণ্ঠিত মানবিক মর্যাদার পুনর্জন্মের জন্য।

শাশ্বত ন্যায়বিচার ও রক্তের উত্তরাধিকার

হাদির প্রয়াণ আজ আমাদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, অস্ত্রের আস্ফালন দিয়ে কখনো আত্মা দমন করা যায় না। পতিত স্বৈরাচারী শোষকের তূণীরে হয়তো অগুনতি বিষাক্ত শর থাকতে পারে; কিন্তু মজলুমের রক্তের একেকটি ফোঁটা যখন মাটির গভীরে প্রবেশ করে, তখন তা এক অপার্থিব প্রতিশোধের ইশতেহার তৈরি করে। ওসমান হাদি আজ সেই ইশতেহারের অমর রচয়িতা। তার এ আত্মত্যাগ জাতির নৈতিক মেরুদণ্ড নতুন করে শক্তিশালী করেছে। ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস এই, যারা রক্ত দিয়ে ক্ষমতা সুসংহত করতে চেয়েছিল, সেই রক্ত আজ তাদের পতনকে অনিবার্য করে তুলেছে।

আগামীর ইতিহাসে হাদি বেঁচে থাকবেন এক কালজয়ী অধ্যায় হিসেবে। তার রক্তে ভেজা রাজপথ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছে এক কলঙ্কমুক্ত বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। হাদির এ নীরব মহাবিস্ফোরণ আজ প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের কাছে এক চিরন্তন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে- আমরা কি এ ত্যাগের মর্যাদা রক্ষা করতে পারব? এ রক্তের উত্তরাধিকার আমাদের কাঁধে যে গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে, তা হলো এমন এক ভূখণ্ড নির্মাণ করা; যেখানে আর কোনো হাদিকে বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিতে হবে না। হাদির শাহাদত আমাদের জাতীয় সংহতির সেই স্বর্ণশিখর, যা দীর্ঘকাল অবধি ন্যায়ের আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলবে।

পরিশেষে বলতে চাই, শহীদ ওসমান হাদি আমাদের শিখিয়ে দিলেন কিভাবে জীবন দিয়ে একটি মৃত জাতিকে জীবিত করা যায়। হাদির এ মহাবিস্ফোরণ স্তব্ধ হবে না; বরং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক