চলমান সময়ে ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে আসছে বহুল উচ্চারিত একটি প্রবাদবাক্য, সেটি হলো- ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না’। একটি জড় পদার্থ থেকে এমন প্রতীকী প্রবাদটি প্রাণীকুলে অর্থাৎ- মনুষ্য সমাজে প্রতিস্থাপিত হলে তার ব্যাখ্যা হতে পারে- ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জন্ম থেকে যে আচার-আচরণকে ‘ইনহেরেন্ট’ করে, সে কাজটি মন্দ হলেও তা কাউকে কখনো ফেরানো যায় না। তা নিয়ে লোকসমাজে যতই নিন্দা-মন্দ হোক, তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। কোনো অনুশোচনাও তাদের থাকে না। তারা মনে করে, তাদের আচরণই সঠিক এবং উপযুক্ত। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, প্রবাদটি বড় বেশি ‘হার্শ’। তাদের মনে রাখতে হবে আরেকটি ইংরেজি ফ্রেজ- ‘টিট ফর ট্যাট’। অর্থাৎ ‘বিমারটা’ (অসুখ) যদি জবরদস্ত হলে, ‘দাওয়াইও’ হতে হবে ধনন্তরী। যাই হোক, আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে এক অবাঞ্ছিত ও গর্হিত ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যারা এই দুষ্কর্মে জড়িত, তারা এবং তাদের পূর্বসূরিরা বহুকাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে এমন নোংরামি ও অপকর্মে জড়িত ছিল। এমন অপকর্ম নিয়ে তাদের আনন্দের সীমা থাকে না। এমন সব অপকর্ম এরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। যে সংগঠনের ‘সাইনবোর্ড’ নিয়ে তারা বহুকাল থেকে একের পর এক এমন অপকর্মগুলো করছে সেটি তাদের ‘ডিএনএ’তে প্রোথিত আছে। অতীতে তাদের পূর্বসূরিরা এভাবেই ভিন্নমতের সভা-সমিতি ভেঙে দিয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, বহু আগে ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে তাদের পূর্বসূরিদের ঘটানো লঙ্কাকাণ্ড। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার শাহেদ আলীর মৃত্যুর করুণ ইতিহাসও মনে পড়ে। প্রতিপক্ষকে মারধর ও গালমন্দ করা, নিরীহ পথচারীকে বিবস্ত্র করার মতো বর্বর ও অশ্লীল ঘটনার তারা হোতা। প্রকাশ্য রাজপথে নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা, হাঙ্গামা-হুজ্জত করা, মা ও বোনদের অসম্মান করা, সম্মানিতদের অপদস্ত করা- এমন সব কুশিক্ষা তাদের ‘কুষ্ঠিতে’ লেখা আছে।
মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা- ইত্যাদি সেই গোষ্ঠীবিশেষের অনুসৃত ও আচরিত চেতনার রাজনীতি। ভীরু এসব দুষ্কৃতকারীরা জনসমক্ষে এসে মোকাবেলার সাহস রাখে না। কাউকে একা পেয়ে চোরাগোপ্তা হামলা করাই তাদের অনেক দিনের অনুসৃত আচরণ। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে এমন শিক্ষা পেয়ে সেটি গভীর মমতার সাথে এখনো লালন করছে তাদের উত্তরসূরিরা।
গুরুজনদের সাথে দেশের বাইরে প্রদর্শিত এমন আচরণ প্রমাণ করে- অতীতের কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের এতটুকু অনুশোচনা নেই, হিতাহিত কোনো চিন্তাও নেই। তাদের পূর্বাপর আচরণ পর্যালোচনা থেকে বারবার এটিই প্রমাণ হয়েছে, তারা কখনোই বদলায় না, আর ভবিষ্যতেও বদলাবে না। বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের কখনো কোনো বিষয় নিয়ে অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তাভাবনার প্রয়োজন পড়ে না। এমন বুদ্ধিহীনতা নিয়ে এরা ঘরে-বাইরে বিচরণ করে। কখনো নিজের ঘটে টোকা মেরেও দেখে না প্রকৃতপক্ষে সূর্যটা কোনদিক থেকে উঠেছে। যা শুনেছে, যা তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে, তার বাইরে তাদের চোখের পাতাও নড়ে না। শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেও শিখিয়ে দেয়া বয়ানের বাইরে তারা কখনো যায় না। বারবার সুতার টানেই নেচে-গেয়ে দিবস-রজনী পার করে দেয়। যেমন- নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের কথিত সেই কূটনৈতিক পালের গোদারা। যারা নেপথ্য থেকে নির্দেশ পেয়ে তাদের শিক্ষা-দীক্ষা বিবেচনাবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। নেপথ্যের নির্দেশদাতাদের প্রতি শতভাগ কমিটমেন্ট থাকলেও দেশের প্রতি তাদের আনুগত্য শূন্যের কোঠায়। দেশের মান-মর্যাদা এদের জন্য কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে হিসাব কখনো তাদের বিবেচনায় আসে না। নিজের ক্যারিয়ারকে কোন বেদিতে বিসর্জন দিচ্ছে তা নিয়েও তাদের কখনোই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লক্ষ করা যায়নি; বরং দলের অনুগামীদের জন্য কতটা স্পেস দিতে পারে তাতেই তাদের মনস্তুষ্টি। এ জন্যই ঢাকা-নিউ ইয়র্কের দলপ্রয়াসী কূটনীতিকদের ভয়ঙ্কর ও দেশবিরোধী কূটকৌশলের কোনো আছর ঢাকার সেগুনবাগিচায় পড়ার কোনো আলামত এখনো দেখা যায়নি। এমন ছাড় দিতে দিতে এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে।
মনে রাখতে হবে, নিউ ইয়র্কের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশ-বিদেশে এরা জানান দিচ্ছে, আমরা আছি, থাকব। আমাদের শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। যেমন- আগাছার শিকড় কখনো নিঃশেষ হয় না। তবে আগাছা নির্মূল হয় না এমন ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। উপযুক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ করলে নিমিষে সবই নির্মূল করা সম্ভব। এখন সঠিক বালাইনাশকটাই বেছে নিতে হবে। সময় কিন্তু কারো জন্য বসে থাকে না। সবাই জানেন, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ। সময় উৎরে গেলে হাজার ফোঁড়েও আর কাজ হয় না।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কার্যকর বালাইনাশক হচ্ছে সর্বস্তরের ঐক্য। তবে ঐক্যের অর্থ এই নয় যে, ‘ছুতা নাতা’ নিয়েই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে সবারই মুক্তচিন্তা ও চেতনা থাকবে। রাজনীতিতে দেশ গঠন নিয়ে দলভেদে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও পথরেখা তো থাকবেই। তবে সবারই লক্ষ্য থাকবে, দেশ-জনতার পরিচর্যা, দেশের স্বাধীনতা, সংহতি ও অখণ্ডতার সুরক্ষা, দেশের অভিন্ন প্রতিপক্ষকে রুখে দেয়া। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সবাই মিলে যেকোনো মূল্যে নি-িদ্র প্রাচীর গড়ে তোলা। সবারই জানা, সেই প্রতিপক্ষ কারা। তাদের ট্রেসআউট করা মোটেই কঠিন নয়। অতীতের দিকে একটু ঘুরে তাকালেই দেখা যাবে তাদের পরিষ্কার প্রতিচ্ছবি, স্বচ্ছ হবে তাদের বেশুমার অপকর্ম, অপলাপ। দূষিত যত চিন্তাচেতনার ধারকরা তাদের নিজ স্বার্থে বহু প্রাণ ও অর্থমূল্যে কেনা স্বাধীনতাকে নিছক ক্ষমতার বিনিময়ে হস্তান্তর করেছিল। এবার চূড়ান্তভাবে দেশকে ধ্বংস করতে দেশে-বিদেশে সমান্তরালে চলছে তাদের অপতৎপরতা। কারো এক কান কাটা গেলে সে সড়কের একপাশ দিয়ে হাঁটা-চলা করে, আর দুই কান কাটা পড়লে সড়কের মাঝ দিয়ে চলে। অর্থাৎ- বেপরোয়াভাবে পথচলা। রাষ্ট্র-জনতা ও ব্যক্তি সংগঠনকে গুঁড়িয়ে দিতে তাদের যত তৎপরতা। এরাই যে এই জনপদের ও জনগণের চিহ্নিত প্রতিপক্ষ, সেটি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এখন দেশে অনুপ্রবেশের জন্য ফাঁকফোকর খুঁজছে। দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ তৈরি করে, তর্কযুদ্ধকে মল্লযুদ্ধে পরিণত করার নানা অপকৌশল করছে। সব সময় সব দেশে ও প্রতিষ্ঠানে ‘ব্লক শিপ’ থাকে। এদের ভূমিকা হচ্ছে, কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাওয়া। এই কর্তার ইচ্ছা কার কোন উপকারে লাগবে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। কর্তার করুণাতে তাদের ভরসা। উচ্ছিষ্ট কিছু পেলেই তারা বর্তে যায়। এসব প্রাণী ভয়ঙ্কর। এদেরই এখন বাছাই করছে সেই অভিন্ন প্রতিপক্ষ ও তাদের সুহৃদ-দোসররা। এরা কখন যে কার ঘাড় মটকাবে সে খবর কেউ রাখে না। আমরা যখন লুটেপুটে খেতে পারব না, তখন কাউকেই আর শান্তিতে থাকতে দেবো না- তাদের এমন বাক্য একেবারেই নতুন কিছু নয়। বহুবার প্রকাশ্যেই এমন কথার গরম সিসা সবার কানেই ঢেলে দেয়া হয়েছিল। তবে এখন স্তম্ভিত-হতচকিত হওয়ার সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, এখন দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। আর কথা নয়, এখন কেবল কাজেরই সময়। বৃক্ষ তার ফলে পরিচয়; ফল কখনো এমনি এমনি আসে না, কেবল কর্মযোগেই আসে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কলমসৈনিকরা সদা দ্বিমুখী যুদ্ধ করে। স্বেচ্ছাধীন থেকে দেশ-জনতার পক্ষে যুদ্ধ করা এবং সংবাদপত্রের স্বত্বাধিকারীদের স্বার্থ রক্ষার অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়ন- যা কখনো কখনো রাষ্ট্রস্বার্থের প্রতিকূলে থাকে। যেমন বণিকদের এক সভায় উপস্থিত থাকা পতিত সরকারের নেত্রীর প্রতি গভীর আস্থা প্রদর্শনের জন্য দুই বণিক নেতা স্লোগান তুলেছিলেন- শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার। এমন স্লোগান সামগ্রিকভাবে কতটা দেশহিতৈষী ছিল? পেশার নিষ্ঠাবান সংবাদকর্মীরা তাকে নিবৃত্ত করতে না পারলেও মনে মনে ঘৃণা করেছিল।
পতিতরা ফেরার কোনো সুযোগ পাবে এমন চিন্তা কখনো স্বপ্নেও আসে না। তারপরও কারো অনিচ্ছাকৃত ভুলে কখনো যদি কোনো সুযোগে আসে, তবে তাদের ছায়া হয়ে আসবে তাদের আশ্রয়দাতারাও। তারা দেশের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সব মহৎপ্রাণকে ‘বধ’ করবে। এ দেশ থেকে তাদের নাম ও নিশানা ধুলায় মেশাবে। তাই এখন তাকে প্রতিহত করার জন্য সব সক্ষমতা অর্জনের জন্য দিবানিশি সক্রিয় ও সতর্ক সময় অতিক্রম করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার। প্রস্তুত থাকতে হবে, সব মাল্লার। শ্রমিকের হাতুড়ি, কৃষকের কাস্তে, কবির কলম, আম-জনতার গগণবিদারী স্লোগানের কণ্ঠ। সবাইকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে। সবাইকে স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করতে হবে।