২০১৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশ যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তবে এ আশ্রয়দান এখন বাংলাদেশের কাঁধে দীর্ঘমেয়াদি এবং বহুমাত্রিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। এদের আবাসন, খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক চাপে পড়তে হচ্ছে। বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি পেলেও, প্রত্যাবাসনে কার্যকর চাপ সৃষ্টিতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এতে করে দেশের ভেতরে এ সঙ্কট ক্রমাগত এক অনিশ্চিত ও অসহনীয় রূপ নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সীমান্ত নিরাপত্তা, স্থানীয় জনজীবন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর।
এই জটিল বাস্তবতায়, ‘মানবিক করিডোর’ চালুর প্রস্তাবটি এসেছে একটি সম্ভাব্য কৌশলগত বিকল্প হিসেবে। মানবিক করিডোর কোনো নতুন ধারণা নয়; বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মানবিক হস্তক্ষেপের একটি প্রমাণিত উপায় হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সিরিয়া, সুদান, আফগানিস্তান, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন সঙ্ঘাতপীড়িত অঞ্চলে, যেখানে সাধারণ জনগণ যুদ্ধ ও সহিংসতায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন, মানবিক করিডোর খুলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরাপদে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা ও জরুরি সেবা পৌঁছে দেয়। এসব করিডোরে কোনো সামরিক সহায়তা বা অস্ত্র পরিবহন হয় না। এটি পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, মানবিক এবং আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে। এতে অংশ নেয় জাতিসঙ্ঘ, রেডক্রস (আইসিআরসি), বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) মতো সংস্থাগুলো, যারা নির্দিষ্ট নিয়ম ও চুক্তির আওতায় এ করিডোর ব্যবস্থাপনা করে থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি, যেখানে বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে নিয়মিত সংঘর্ষ চলছে, অনেক রোহিঙ্গা এবং রাখাইনের বেসামরিক জনগণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন বাস্তবতায়, সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর চালুর মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব। এটি রোহিঙ্গাদের জীবনরক্ষা ও ভবিষ্যতের প্রত্যাবাসনে ন্যূনতম আস্থা তৈরিতে সহায়ক হবে। একই সাথে, এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাবে যে, সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ সদিচ্ছা ও বাস্তবভিত্তিক চিন্তা রাখে।
তবে এ উদ্যোগ সফল করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, স্বচ্ছতা ও বহুপক্ষীয় সমন্বয়ের। একে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারে মিয়ানমারের ওপর এবং আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের অবস্থান আরো জোরালো করতে পারে। ফলস্বরূপ, এ সঙ্কট নিরসনে নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে পারে, যা শুধু মানবিক নয়; বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অগ্রগতিরও পথ দেখাবে।
বাংলাদেশের জন্য মানবিক করিডোরের প্রস্তাব কেবল একটি মানবিক উদ্যোগ নয়; বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত কৌশলগত অগ্রগতি হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। বর্তমান বাস্তবতায়, যেখানে মিয়ানমার সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করছে না, সেখানে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ বারবার কূটনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে, মানবিক করিডোর একটি বিকল্প কৌশল হয়ে উঠতে পারে, যার মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি ও সমর্থন আরো সুসংহত করা যাবে। একই সাথে, এর মাধ্যমে মিয়ানমারের বাস্তবতা এবং রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কাঠামোগত বাধাগুলো বিশ্ব জনমতের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা সম্ভব।
করিডোর চালু হলে, বাংলাদেশ কেবল একটি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে নয়; বরং একটি উদ্যোগী ও দায়িত্বশীল আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এতে করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান আরো দৃঢ় হবে। সেই সাথে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে নতুনভাবে আলোচনার টেবিল গঠনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে আরাকান আর্মির বর্তমান ভূখণ্ডীয় নিয়ন্ত্রণ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সীমিত ক্ষমতার মধ্যে এ করিডোর কার্যত রাখাইনের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করবে যা অনেক আন্তর্জাতিক শক্তিকে বাস্তবতাভিত্তিক পুনর্মূল্যায়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু, এ বাস্তব ও সম্ভাবনাময় উদ্যোগ ঘিরে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারত, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। দিল্লি কখনো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়নি; বরং নিজ দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছে। বর্তমানে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি অংশ এই করিডোর ইস্যুতে ভুয়া খবর, ভুল ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালাচ্ছে, যাতে জনগণ বিভ্রান্ত হন। সেই সাথে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এ প্রচারণা মূলত দু’টি উদ্দেশ্য সাধন করতে চায় :
১. বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কার্যকর কৌশল গঠনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করা, যাতে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে না ওঠে।
এ ছাড়াও, কিছু দেশীয় গোষ্ঠীও এ করিডোর প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এরা হয়তো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ নয়, কিন্তু তারা না বুঝে ‘সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন’, ‘নিরাপত্তার ঝুঁকি’, ‘এএ-এর স্বীকৃতি’ ইত্যাদি বিষয়কে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করছেন। অথচ বাস্তবে মানবিক করিডোর কোনো নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাস্তা নয়; এটি একটি মানবিক চ্যানেল, যা আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। এ ছাড়া যেকোনো সময় এটি বন্ধ করার অধিকার রাষ্ট্রের থাকবে।
এ অবস্থায়, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে উন্মুক্ত, নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক আলোচনা শুরু করা। অভ্যন্তরীণ অংশীদার যেমন সশস্ত্র বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও কূটনীতিকদের সাথে পরামর্শ করে একটি বাস্তবভিত্তিক অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের সাথে কার্যকর যোগাযোগ বজায় রেখে, ভারতের মতো রাষ্ট্রের অপপ্রচারের বিপরীতে সত্য ও তথ্যের ভিত্তিতে শক্তিশালী বার্তা দিতে হবে।
মানবিক করিডোর কেবল সাহায্য বিতরণের রাস্তা নয়; বরং এটি বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত সম্ভাবনার একটি নতুন দ্বার হতে পারে যদি আমরা সাহস, সতর্কতা এবং দূরদর্শিতার সাথে এগিয়ে যেতে পারি।
এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যু ঘিরে যে ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে অত্যন্ত যত্ন ও বিচক্ষণতার সাথে সাহসী পদক্ষেপ নেয়া। মানবিক করিডোরের মতো একটি উদ্যোগ, যেটি একদিকে মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন, অন্যদিকে কৌশলগত শক্তির প্রকাশ তা বাস্তবায়নে সফল হতে হলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক, দুই পরিসরে সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরে একটি সর্বদলীয় ও সর্বস্তরের ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারকে এগিয়ে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে উন্মুক্ত ও গঠনমূলক সংলাপের আয়োজন করতে হবে বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোকে বিষয়টি নিয়ে তথ্যভিত্তিক অবহিত করা এবং তাদের আস্থা অর্জন করা জরুরি। বিষয়টি যেন বিভেদ বা রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গায় না গিয়ে জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নে একক কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করে। এ উদ্যোগ কেবল নীতিনির্ধারণে সাহায্য করবে না; বরং আন্তর্জাতিকভাবে একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে যে, বাংলাদেশ এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ ও একমুখী।
সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতামতও এ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক করিডোর চালুর ক্ষেত্রে সীমান্ত নিরাপত্তা, প্রবেশ ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, চোরাচালান ও সন্ত্রাসবাদ রোধ এসব বিষয়ের প্রযুক্তিগত ও বাস্তবিক মূল্যায়ন কেবল তাদের পক্ষে করা সম্ভব। তাই সরকারকে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাথে নিয়মিত আলোচনা ও পরিকল্পনাভিত্তিক সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে।
এ ছাড়া কূটনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজ যারা বহুপক্ষীয় আলোচনায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করে কিংবা আন্তর্জাতিক পরিসরে মতামত গঠনে ভূমিকা রাখে, তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নাগরিক সমাজ, গবেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা যেমন বাস্তবভিত্তিক সুপারিশ দিতে পারেন, তেমনি বিদেশী সংবাদমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রতিপক্ষ গঠনে সহযোগিতা করতে পারেন।
পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সমন্বয় অপরিহার্য। জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা (বিশেষ করে ইউএনএইচসিআর, ইউএনওসিএইএ, ডব্লিউএফপি), রেডক্রস (আইসিআরসি), ওআইসি, আসিয়ান ও প্রভাবশালী বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কাতার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদিকে এ উদ্যোগের ব্যাপারে অবহিত করে সমর্থন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের উদ্যোগ চালুর আগে সুবিন্যস্ত ও কার্যকর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলে বিদেশী সমালোচনা ও প্রতিরোধ অনেকাংশে প্রশমিত করা সম্ভব হবে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেকোনো মানবিক করিডোর কেবল মিয়ানমার কিংবা রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার সাথেও সরাসরি যুক্ত। দীর্ঘমেয়াদে এ সঙ্কটের সমাধান না হলে, তা কেবল শরণার্থী সমস্যা নয়; বরং আন্তর্জাতিক অপরাধ, চরমপন্থা ও জাতিগত বিভাজনের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। তাই এ সঙ্কটকে ‘মানবিক দায়িত্ব’ হিসেবে দেখার পাশাপাশি এটিকে ‘কৌশলগত কর্তব্য’ হিসেবেও বিবেচনা করা জরুরি।
সুতরাং, এ ধাপে সাহস ও সতর্কতার এক অপূর্ব ভারসাম্য প্রয়োজন। তথ্যনির্ভর কৌশল, অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যা হয়তো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিকেও একটি টেকসই, সম্মানজনক ও বাস্তবসম্মত পথ খুলে দিতে পারে।
নিশ্চয়, মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে কিছু ঝুঁকি থাকবে বিশেষ করে যখন তা সঙ্ঘাতপীড়িত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পরিচালিত হয় এবং তৃতীয় পক্ষের (যেমন আরাকান আর্মির) নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় কার্যকর হতে হয়। যেমন সীমান্তে সংঘর্ষের আশঙ্কা, করিডোর ব্যবহার করে অবৈধ অস্ত্র বা মাদকপাচার, রোহিঙ্গা শিবির থেকে চরমপন্থী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ, কিংবা আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন উত্থাপন ইত্যাদি। তবে এসব ঝুঁকি অজুহাত হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা এগুলো মোকাবেলায় যথাযথ পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও সমন্বয় না করি।
বিশ্বের বহু সফল উদাহরণ প্রমাণ করে, পরিকল্পিত ঝুঁকি নেয়া অনেক সময় সমস্যার মূল কেন্দ্রে গিয়ে তার স্থায়ী সমাধানের দ্বার খুলে দেয়। যেমন সিরিয়ার যুদ্ধাবস্থায় জাতিসঙ্ঘের অধীনে মানবিক করিডোর ব্যবহারে লক্ষাধিক মানুষ রক্ষা পেয়েছেন; সুদানে বা দক্ষিণ লেবাননে এরূপ ব্যবস্থায় জাতিগত নিধন প্রতিরোধ করা গেছে; ইউক্রেন যুদ্ধেও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো করিডোর ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবা ও খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে। এসব উদাহরণে আমরা দেখি, ঝুঁকি সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলো মানবিক প্রয়োজন ও কৌশলগত স্বার্থকে একত্রে ব্যালান্স করে এগিয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সঙ্কট এখন আর কেবল অস্থায়ী উদ্বাস্তু সঙ্কট নয়- এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দালালচক্র ও চোরাচালান বৃদ্ধি এবং স্থানীয় জনসংখ্যার সাথে সাংস্কৃতিক সঙ্ঘাত এসব সঙ্কটকে বহুমাত্রিক করেছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি আমরা সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছিয়ে যাই, তা হলে এ সঙ্কট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতায় মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একমাত্র সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের মাধ্যমে এ সঙ্কটের দীর্ঘমেয়াদি, শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশের সামনে এখনো সুযোগ আছে- এ সঙ্কটকে কেবল মানবিক বোঝা হিসেবে না দেখে, একে কৌশলগত বাস্তবতায় রূপান্তরিত করার।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক