সূর্য মধ্যগগনে স্থির হয়ে আছে। বেশ রাগী ও ক্ষুধার্ত। যেন সে যৌবনের তেজ দিয়ে পৃথিবীর সব তরল স্বপ্ন শুকিয়ে ফেলতে চায়। ঘাসের রঙ গাঢ় হয়ে উঠেছে, ধুলোর কণাগুলোও যেন জ্বলজ্বল করে। বাতাসে গরমের অলস ঘনত্ব। পাতাদের নড়াচড়া থেমে গেছে। মাঝে মধ্যে দূর কোথাও ডাকছে কিছু কাক। তাদের স্বর যেন গলে গিয়ে মিশে যাচ্ছে দুপুরের ঘামে। গাছের ছায়া ছোট হয়ে গুটিয়ে আছে গাছের পায়ের কাছে। মাঠে কেউ নেই। কৃষকরা বিশ্রামে। গরুগুলোও ছায়ার আশ্রয়ে শুয়ে আছে। তাদের লেজ নড়ছে ধীর ছন্দে। যেন সময়ও ঝিমাচ্ছে কিংবা ঘুমাচ্ছে।
একটি মৌমাছি ফুলের গায়ে বসে গুঞ্জন করছে। যেন সে-ই একমাত্র জীবিত সঙ্গীত এই ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের দরিয়ায়। দুপুরের এই তসবিরে সমস্ত বিবেচনা নিষ্প্রভ, সমস্ত যুক্তি বিশ্রামে। শুধু সজাগ আছে অনুভ‚তির গভীরতা, বস্তু ও ছায়ার সরাসরি সংলাপ। এই গভীরতা ও সংলাপ এমন, যা কোনো যুক্তিবাদের কাঠামোর মধ্যে আসতে চায় না।
এই ভাবনাবৃষ্টি যখন মাথায়, তখন রোদের সন্ত্রাসের বাইরে আমার মন। বৃষ্টির আমেজে চিন্তার বিচারসভা। আজ যুক্তিবাদকে আদালতে হাজির করব।
জ্ঞানতত্ত্বে র্যাশনালিজম হলো এমন দর্শনভাষ্য, যেখানে যুক্তি বা রিজনকে জ্ঞান ও সত্যের প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। তার মূল দাবি হলো- মানব মস্তিষ্ক স্বতঃসিদ্ধ নীতির ভিত্তিতে সত্য বুঝতে সক্ষম। যুক্তি হলো স্থায়ী ও বিশ্বজনীন জ্ঞানের পথ। ডেকার্তে ও স্পিনোজা এই দর্শনের প্রবল দিশারি, জোরালো কণ্ঠস্বর।
ডেকার্তের দার্শনিক বিচার মূলত পদ্ধতিগত সন্দেহের ওপর নির্ভর করে। তার মতে, যে জ্ঞানকে সন্দেহ করা যায়, সেটি চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না। তাই তিনি সব কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তিনি জ্ঞানের অনুসন্ধান শুরু করেন সর্বব্যাপী সন্দেহ থেকে। যাকে বলা হয় Cartesian Skepticism।
যে বিষয় সন্দেহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হবে, সেটিই জ্ঞান। সেখানেই থাকবে সন্দেহহীন সত্য। কিন্তু সত্য কোথায়, তা কিভাবে জানব? ডেকার্তে বলেন, তা জানব যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে। কারণ মানুষের যুক্তিই সত্যের মানদণ্ড। জ্ঞানকে একটি সুসংগঠিত কাঠামোর মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। আর যুক্তি হচ্ছে সেই শৃঙ্খলা, সেই কাঠামো।
যুক্তি গঠন করে মানুষের মন। অতএব মানুষের মনই সত্যের চূড়ান্ত মানদণ্ড। ইন্দ্রিয়ের তথ্যের চেয়ে যুক্তির মূল্য বেশি। বাইরের অভিজ্ঞতার চেয়ে যুক্তি বেশি নির্ভরযোগ্য।
স্পিনোজা ল্যাশনালিজমকে সম্প্রসারিত করেন একটি প্যানথেইস্টিক দৃষ্টিতে। তিনি বলেন, জ্ঞান তিন স্তরে বিভক্ত। প্রথমত, পরিচিতি বা উপলব্ধি, যাকে বলা হয় ইমাজিনেশন বা ওপিনিয়ন। এটি সীমিত ও অনিশ্চিত। সাধারণত সেটি অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, যুক্তির দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞান। এটি স্থিতিশীল। এই জ্ঞান সাধারণ নীতি ও যুক্তি ব্যবহার করে। তৃতীয়ত, অত্যন্ত উচ্চ জ্ঞান। যাকে বলে ইনটুইশন, ল্যাটিন ভাষায়- সাইএনটিয়া ইনটুইটিভা। এতে থাকে মহাবিশ্বের সাথে মিলিত চূড়ান্ত সত্য। এখানে বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ বা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রকৃতির একত্ব উপলব্ধি হয়।
স্পিনোজার অবলম্বন মনন ও প্রকৃতি। এর মধ্য দিয়ে তিনি আলিঙ্গন করেন যুক্তির সাথে। যুক্তিই হচ্ছে তার সত্য বোঝার মাধ্যম। চূড়ান্ত উপলব্ধি আসে পুরো সৃষ্টির নিয়ম ও অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক বোঝার মাধ্যমে। কিন্তু বুদ্ধি বা ইনটেলেক্ট ব্যবহারেই প্রকৃতির নিয়ম, সম্পর্ক ও সৃষ্টির সত্য বোঝা সম্ভব।
যুক্তিকে অনেক বেশি লাই দিয়েছেন তারা। যুক্তিকে দিয়েছেন অতিরিক্ত স্বাধীনতা। তার ক্ষমতার চেয়ে বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন তাকে। যুক্তির সীমা ও সামর্থ্য বুঝতে ব্যর্থ যুক্তিবাদ। যুক্তির সামর্থ্য আছে বিশ্লেষণে; কিন্তু সীমা আছে উপলব্ধিতে। যুক্তি কেবল বস্তুর ধারণা ও সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে পারে। কিন্তু সে পৌঁছাতে পারে না অস্তিত্বের গভীর অনুভব বা আধ্যাত্মিক সত্যে। যে মনকে বলা হলো যুক্তির নির্মাতা, সেই মন যুক্তির সীমার বাইরে, আবেগ যুক্তির সীমার বাইরে, আত্মার আচরণ যুক্তির সীমার বাইরে। অন্তর্দৃষ্টিও যুক্তির অতিরিক্ত ও উচ্চতর সত্য। যুক্তিবাদে আছে যৌক্তিক মহিমা। কিন্তু অনেক সময় সেটিই পরিণত হয় হৃদয়হীন বিশ্লেষণে।
যুক্তি নির্ভরশীল মানুষের মনন ও ধারণার ওপর। মানব মন কল্পনা, পূর্বধারণা, অভ্যাস ও অনুকরণের দ্বারা প্রভাবিত। ফলে বাস্তবতা সবসময় যৌক্তিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
যুক্তি আমাদের শেখায়- সব কিছু কারণ-ফল অনুসারে ঘটে। কিন্তু প্রকৃতিতে অনিয়ম ঘটে, সম্ভাব্যতা সব সময় জারি থাকে এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা জীবনেরই অংশ। এগুলো কারণ-ফল কাঠামোর বাইরে চলে যায়। তার মানে যুক্তির শৃঙ্খলা এখানে কাজ করছে না। যুক্তি একা চূড়ান্ত জ্ঞান নিশ্চিত করতে পারছে না।
যুক্তির বড় সঙ্কট মূলত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। যুক্তি শুধু বলতে পারে কী ঘটেছে; কিন্তু কী হওয়া উচিত, তা স্পষ্ট করতে পারে না। যুক্তি নৈতিক আদর্শ নির্ধারণে অক্ষম। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সত্য বুঝতে চাই জাগ্রত হৃদয়। তাকে ধারণ করতে চাই মানসিক অভ্যন্তরীণ যাচাই। তার পূর্ণতার জন্য চাই রুহানি উপলব্ধি। যুক্তি এসব মূলধনের মূল্য পরিশোধে সক্ষম নয়। এসব অভিজ্ঞতার বিকল্প হতে পারে না সে।
ইতিহাসে দৃষ্টি দিই। দেখি, এক স্বাধীন নাগরিককে ধরে নিয়ে দাস বানানো হলো, বাজারে বিক্রি করা হলো। এ ঘটনায় যুক্তি কী দেখছে? এটি ইতিহাসের ঘটনা। ঘটেছে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতার পরিণতিতে। সবল দুর্বলকে ধরে নিয়ে গেছে। বিক্রিটা বাজারের লেনদেন। দাসপ্রথা তখনকার সামাজিক নিয়মের অংশ।
পুরো ঘটনাটা নৈতিকভাবে ঠিক না অঠিক? তা নির্ধারণে যুক্তি একা যথেষ্ট নয়। যুক্তি দাসপ্রথার বিপক্ষে বলে, পক্ষেও বলে। এরিস্টটলের মতে, কিছু মানুষ স্বভাবতই সক্ষমদের তুলনায় দুর্বল। সক্ষমদের দাস হিসেবে কাজ করাই দুর্বলদের জন্য স্বাভাবিক।
এরিস্টটল দেখান, দাসপ্রথা সমাজের একটি প্রাকৃতিক অংশ এবং এটি নগররাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্লেটো দাসপ্রথাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করেননি; কিন্তু তার যুক্তি বলেছে, দাসপ্রথা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। তার মতে, কিছু মানুষ তাদের স্বভাবগত কারণে দাসত্ব করতে বাধ্য। এটি তাদের জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা।
সক্রেটিসের যুক্তি দাসপ্রথার পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি কোনো উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হাজির করেনি। তার সময়ে প্রচলিত দাসপ্রথাকে গ্রহণ করেছিলেন সক্রেটিস।
যদিও যুক্তিবাদী বহু দার্শনিক দাসত্বের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আধুনিক পশ্চিমা দুনিয়ায় তাদের সংখ্যাই অধিক। কিন্তু এটি স্বয়ক্রিয়ভাবে যুক্তির ফসল নয়, বহুবিচিত্র বাস্তবতা এখানে কাজ করেছে।
কিন্তু ধরে নিয়ে দাস বানানোর যে ঘটনা তার আত্মায় কেন প্রবেশ করতে পারছে না যুক্তিবাদ? কারণ পরিষ্কার। মানবের সত্তার মৌলিকত্ব ও মহিমা না বুঝলে ঘটনার নৈতিক দিক স্পষ্ট হবে না। হৃদয় ও আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টিকে বাদ দিলে এ ঘটনাকে আমরা বুঝব কেবল তথ্য দিয়ে। এটিকে মনে করব আইনের লঙ্ঘন। এতটুকুই। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ বা নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি আমাদের দেখাবে, মানুষের তাকরিম তথা খোদা প্রদত্ত সম্মান, তামিন তথা খোদা নির্দেশিত নিরাপত্তা, তাদিল তথা খোদার সজ্জিত ন্যায় কিভাবে এখানে লাঞ্ছিত হয়েছে!
এমনতরো উদাহরণ জীবনের চারধারে ছড়ানো। এক গরিব, শিক্ষাবঞ্চিত সুদানি নারীর প্রেমে পড়ল এক কাতারি অভিজাত তরুণ। এক যুবক নিজের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে অন্য কারো জন্য। এমনতরো ঘটনা যুক্তির কাছে কেবল অস্বাভাবিক ঘটনামাত্র।
যুক্তিবাদ চায় প্রতিটি ঘটনার কারণ ও ব্যাখ্যা; অর্থাৎ কোনো কিছুই ঘটবে না, যদি তার যৌক্তিক ভিত্তি বা কারণ-সম্পর্ক না থাকে। তাই যুক্তিবাদের চোখে ঘটনাগুলো ঘটেছে কারণ ও ফলাফলের নিয়মে। কিন্তু এসব ঘটনায় মানবিক প্রেরণা ও অন্তর্জগতের গভীরতা আছে। যুক্তির সহজ সূত্র তাকে ধরতে পারে? যুক্তিবাদ হয়তো বলছে, ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক। কারণ এই প্রেম সামাজিক শ্রেণী, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু হৃদয় বা অস্তিত্বের দৃষ্টিতে ঘটনাগুলো সবচেয়ে স্বাভাবিক, কারণ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের উৎস যৌক্তিক নয়, অস্তিত্বগত। যুক্তিবাদের কাছে ঘটনাগুলো ডাটা পয়েন্ট। কিন্তু জীবনের কাছে এগুলো অর্থপূর্ণ বিস্ময়। যুক্তির বয়ান থেকে আত্মত্যাগের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্য বোঝা যায় না। কারণ এটি হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ স্থিতি ও নৈতিক অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। এই প্রেম, এই আত্মত্যাগ নৈতিকভাবে বা আধ্যাত্মিকভাবে সঠিক, এটি উচ্চারণের জিহ্বা নেই যুক্তিবাদের। অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া আমরা জানি না যে, এই প্রেম বা আত্মত্যাগ সত্যিকারের নৈতিক বা ধর্মীয় সঠিকতা বহন করছে কি না?
যুক্তিবাদের নিজস্ব প্রবণতায় যেকোনো নৃশংস কাজকে বৈধতা দানের যুক্তিও হাজির হয়। ৬ আগস্ট ১৯৪৫। জাপানের হিরোশিমা শহরে আমেরিকার পারমাণবিক হামলা হলো। সাথে সাথে মারা গেল ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মানুষ। বছরের শেষে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। পরবর্তীতে বিকিরণে আক্রান্ত হয়ে নানা শারীরিক জটিলতায় মারা যায় দুই লক্ষাধিক মানুষ। যারা মরেনি, তারা ভুগেছে তীব্র বিকিরণজনিত ক্যান্সারে। শিশুরা ভুগেছে মানসিক আঘাতে, জন্মগত বিকলাঙ্গতায়।
৯ আগস্ট ১৯৪৫। নাগাসাকিতে হলো পারমাণবিক হামলা। বিস্ফোরণে মারা গেল ৪০ হাজার মানুষ। বছরের শেষে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার। পরবর্তীতে বিকিরণে মৃত্যুর সংখ্যা অনুমান করা হয় প্রায় দেড় লাখ পর্যন্ত। পুরো শহর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হাজারো মানুষ অন্ধ হয়। শরীরের নানা অংশ পুড়ে যায়, তেজষ্ক্রিয় ক্ষত নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য হয়।
এ হামলার আদেশ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান। কার্ল কম্পটনের মতো পদার্থবিজ্ঞানী এ হামলার পক্ষে যুক্তি হাজির করেন। হার্বার্ট ফেইসের মতো ইতিহাসবিদ এ হামলার পক্ষে যুক্তি দেন। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত The Atomic Bomb and the End of World War II গ্রন্থে তিনি দাবি করেন, ট্রুম্যানের সিদ্ধান্ত বিশুদ্ধ সামরিক ভিত্তিতে গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয় এবং আমেরিকার সৈন্যদের প্রাণ রক্ষা পায়। সাম্রাজ্যবাদের খেদমতগার বুদ্ধিজীবীরা হাজির করেন এক থিওরি। যার নাম হলো necessary evil বা প্রয়োজনীয় অমঙ্গল। এর যুক্তি হলো- জাপান আত্মসমর্পণ করতে রাজি হচ্ছিল না। তাই পারমাণবিক হামলা ছিল যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার একমাত্র উপায়।
বাহ যুক্তি! হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমার মতোই তুমি কথা বলছ। অন্ধ! হৃদয়হীন! কিন্তু যে হৃদয় হারিয়েছে, তার হৃদয় না থাকার আফসোস কি ফল দিতে পারে? তার যা নেই, তা নিয়েই সে আছে। অন্ধ জানে, তার দৃষ্টিশক্তি নেই। কিন্তু যুক্তিবাদীরা কি জানে যে, যুক্তির হৃদয় নেই?
স্পিনোজার যুক্তি শুধু বুদ্ধি বা মননের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাস্তব জ্ঞান কেবল যুক্তি ও মননে নয়। সেই জ্ঞান অর্জিত হয় যুক্তি+অভিজ্ঞতা+হৃদয়+আধ্যাত্মিক নির্দেশনার সমন্বয়ে। হৃদয় ও অভ্যন্তরীণ চেতনা ছাড়া জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকে। যুক্তি একা এই অভ্যন্তরীণ সমন্বয় প্রদান করতে পারে না।
কেউ যুক্তি ব্যবহার করে বলছেন, প্রকৃতির নিয়ম নির্ধারণ করা সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য, রহস্য ও অনুভ‚তিকে কি হৃদয় ছাড়া বোঝা যায়?
কেউ কেউ যুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় আচরণ বিশ্লেষণ করতে চান। কিন্তু হৃদয় ও অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া আধ্যাত্মিক বাস্তবতার গভীরতা বোঝা সম্ভব? অভ্যন্তরীণ জ্ঞানের উৎসগুলোকে অগ্রাহ্য করলে যুক্তি সীমাবদ্ধ, অসম্পূর্ণ।
যুক্তির মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির নিয়ম অনুধাবন করি বা উদ্ভাবন করি। যেমন- ‘প্রতিটি ক্রিয়ার জন্য সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ এটি যুক্তির সত্য। কিন্তু স্থানীয় পরিস্থিতি বা বিশেষ ঘটনায় প্রকৃতির আচরণ এই সাধারণীকরণের বাইরে চলে যেতে পারে।
যুক্তির মাধ্যমে বলা যায়, ‘পানি সবসময় নিচের দিকে বয়ে যায়।’ কিন্তু বন্যা বা প্লাবনের সময় পানি উঁচুতে উঠতে পারে। তখনকার বাস্তবতা যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে যায়।
স্পিনোজার লক্ষ্য ছিল যৌক্তিক কাঠামো ব্যবহার করে বিজ্ঞানের বা প্রকৃতির মৌলিক সত্য স্থির করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি কোনো জ্ঞান সঠিক যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সেটি চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়।
কিন্তু পশ্চিমা সমালোচকরা দেখিয়েছেন, বিজ্ঞান চূড়ান্তভাবে কখনো স্থির হয় না। কারণ বিজ্ঞানের মূল নীতি হলো falsifiability, অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক তত্ত¡কে এমন হতে হবে, যাকে পরীক্ষার মাধ্যমে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব। যদি কোনো তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করা না যায়, তবে তা বিজ্ঞানের পরিসরে পড়ে না। সেটি বিশ্বাস।
আমরা মনে করি ‘সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিক থেকে ওঠে’। হাজারো অভিজ্ঞতা একে সমর্থন করতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি চূড়ান্ত সত্য নয়। এটি কেবল একটি কার্যকর অনুমান। যদি কোনো দিন কোনো প্রমাণ আসে, পৃথিবীর অক্ষীয় গতিতে মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, তা হলে সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, এ ধারণাটিও ভুল বা অসম্পূর্ণ প্রমাণিত হবে।
বিজ্ঞান দেখিয়েছে, নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা প্রায়ই সত্য। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত¡ দেখিয়েছে, উচ্চগতিতে বা মহাকাশে প্রথাগত পদার্থবিজ্ঞান ব্যর্থ হয়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত¡ নিউটনীয় র্যাশনালিস্ট অনুমানকে সংশোধন করেছে। এর মানে যৌক্তিক অনুমান সবসময় স্থায়ী বা সর্বজনীন সত্য দেয় না।
বৈজ্ঞানিক বক্তব্যও ধ্রুব নয়, চূড়ান্ত নয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হয়। ইমানুয়েল কান্ট ঠিকই বলেছেন, যুক্তি বা মানসিক কাঠামো অভিজ্ঞতার বাইরে স্বতঃসিদ্ধ সত্য তৈরি করতে পারে না। কিন্তু ব্যাপার কেবল এতটুকু নয়। যুক্তি কেবল দিগন্ত পর্যন্ত আলো দেয়। আসমান অবধি যেতে হলে আমার চাই ওহির নূর। এই নূর আমাকে আসমানের ওপারেও নিয়ে যায়।
দুপুরের সেই রাগী সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ধুলোর কণা-কণিকায় মৃদু আলোর ক্লান্তি। মৌমাছির গুঞ্জন মিলিয়ে গেছে যাযাবর হাওয়ায়। তার মর্মসুর নীলিমায় রয়ে গেছে অস্পষ্ট গুঞ্জনের মতো। এই গুঞ্জন সমাপ্তিহীন। এর প্রাণে যে বাণী, তা যুক্তির নয়, জীবনের। পাতারা নড়ছে। গাছের ছায়া লম্বা হয়েছে, আরো লম্বা হচ্ছে। বলছে, তোমার ছায়া তোমার চেয়ে যত বেশি লম্বা হবে, ততই তোমার পরিসমাপ্তি ঘনিয়ে আসছে।
ছায়ারা আরো বেশি দৃশ্যমান হতে হতে অদৃশ্য হয়ে যায়। মধ্য আকাশে দাপুটে সূর্য পশ্চিমে শুয়ে পড়ে। প্রবল যুক্তির শোরগোলও ক্লান্ত হয়, থামে। থেকে যায় হৃদয়, নীরবতা, অন্তর্দৃষ্টি, জ্ঞান, বাস্তব জীবন। অন্ধকারের অন্ধত্বে তারা চায় আলো, ভেতরে-বাইরে।
লেখক : কবি, গবেষক



