সব কিছুতে কেন এ অনিশ্চয়তা

দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলতে গেলে নির্বাচন নিয়ে এখন প্রায় মাতোয়ারা। হয়তো দেশও এ নিয়ে জেগে উঠতে পারে দ্রুততম সময়ে। নির্বাচন নিয়ে সবাই যেন পিপাসার্ত চাতকেরই মতো। এমন কাতরতা আসলে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপারও নয়।

দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলতে গেলে নির্বাচন নিয়ে এখন প্রায় মাতোয়ারা। হয়তো দেশও এ নিয়ে জেগে উঠতে পারে দ্রুততম সময়ে। নির্বাচন নিয়ে সবাই যেন পিপাসার্ত চাতকেরই মতো। এমন কাতরতা আসলে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপারও নয়। গত প্রায় ১৬ বছর ট্যাগ ছাড়া নির্বাচনেরও কোনো খোঁজ ছিল না। সব রাজনৈতিক দল অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল, একটা ট্যাগবিহীন নির্বাচনের। একই সাথে বাংলাদেশের ভোটপ্রিয় মানুষ ভোট বঞ্চনার শিকার হয়ে বহুকাল থেকে ত্যক্ত-বিরক্ত-সংক্ষুব্ধ। তবে ভোট নিয়ে এখনো মানুষ সম্ভাবনার পাশে জাল বোনা দেখছে এবং স্মরণ করছে অতীতের নানা কথা। এমন শঙ্কার কারণ কিন্তু এক নয়, বরং একাধিক। বিশেষ করে জনমানুষের মাঝে নির্বাচনের ‘রূপ-স্বরূপ’ নিয়েই যথেষ্ট দ্বিধাদ্ব›দ্ব এখনো বিরাজ করছে আমজনতায়। একসাথে গত ১৬ বছর নানা ট্যাগ দেয়া এবং ‘বিশেষ বিশেষণযুক্ত’ যেসব নির্বাচন হয়েছে সেগুলো এখানে তো নয়ই, কোনো গণতান্ত্রিক দেশই হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেনি। বারবার বলা হয়েছে, এমন পোকায় খাওয়া ‘কাকে ঠোকরানো’ দুর্গন্ধযুক্ত নির্বাচন করানোর সেই কর্মকর্তারা আসলে ভোট নিয়ে ‘মশকরা’ করেছে। অতীতের এমন দুঃসহ অনুভূতি কেমন করে ভুলে যাবে আজ আমজনতা। ওই সব কর্মকর্তা হয়তো আসন্ন নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবে। এদের পরিচালিত নির্বাচন নিয়ে এখন লোকসমাজ যেন কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোর মতো জ্বালা অনুভব করছে।

এ মুহূর্তে দেশে প্রায় প্রতিদিনই নানা অঘটন ঘটছে। যার লোমহর্ষক বর্ণনা প্রকাশ পাচ্ছে পত্রপত্রিকার বিরাট অংশজুড়ে। তার কতটুকু ভেজাল বা নির্ভেজাল, অথবা অতিরঞ্জন বলার উপায় কম। কারণ এসবের তো কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেন নেই, তাও সবার অজানা। পরিবেশগত এমন সমস্যা ভোটকে স্পর্শ করবে না! তা ছাড়া এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে, যা একেবারে ঠুনকো নয়। এসব অঘটনের পেছনে কি কোনো ইনটেনশন তথা কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। আমজনতা তো বোকার স্বর্গে বসবাস করে না। নির্বাচন নিয়ে যেসব মহলে যত আশা-আকাক্সক্ষা ও চাহিদা তৈরি হয়েছে কেউ সেটা ভণ্ডুল করে দেয়ার আলামত কি না- এমন প্রশ্ন প্রায় সবার। নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ধোঁয়াশা সৃষ্ট করে গোটা দেশকে অস্থির করে দেয়ার প্রয়াস হয়ে থাকলে, তার অনুসন্ধান কেন হচ্ছে না। নাকি নির্বাচনের জলাশয়ে পানি ঘোলা করার অপপ্রয়াস চলছে! যাতে সুযোগসন্ধানী মৎস্য শিকারিরা ‘জাল’ ফেলে মাছ শিকার করারের সুযোগ পেয়ে যায়।

ইদানীং দেশের চতুর্দিক থেকে পতিত আওয়ামীদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এমন হাজারো খবর প্রায় প্রতিদিন সবার কানে ঢুকছে। এতকাল সবাই ভেবেছে, সে তো মাত্র গোপালগঞ্জে পৌঁছেছে। এদের অবস্থান এখনো নিরাপদ দূরত্বে। গত শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিক তথ্য দিয়েছে, তারা খোদ রাজধানীতে পৌঁছে গেছে। আমাদের ইনটেলিজেন্স হয়তো তাদের ঢাকা পর্যন্ত আসার পথ নিরাপদ করেছে। আর করবে না কেন, তারা তো পতিত যুগে নিমক খেয়েছে। তাদের সাথে নিমকহারামি করা ঠিক হবে না। তাতে দেশ বা দেশের মানুষ গোল্লায় যাক। আমাদের কি আসে-যায়। অবস্থাদৃষ্ট মনে হয়, ২৪-এর জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তন হয়তো এখন গোধূলিলগ্নে পৌঁছে গেছে। কারো কারো চোখে বালি পড়েছে।

পতিত লীগের খলনায়কদের অপতৎপরতা নিয়ে লেখা-বলার কোনো কমতি না থাকলেও। আবার এ নিয়ে কারো কানে হয়তো ঢুকছে না। ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তাদের কূটকৌশল। গত শুক্রবার ঢাকার অন্যতম এক দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে পিলে চমকে দেয়ার মতো এক সমাচার। সে খবরের শিরোনাম ছিল, ‘গোপন বৈঠক’ ঘিরে গ্রেফতার ২২/‘সেনা হেফাজতে মেজর। খবরটা গুরুত্বে, স্পর্শকাতরতায় ভয়ঙ্কর হলেও তার শিরোনামটা কিন্তু একেবারেই ফিকে। তাতে এমন গুরুত্বপূর্ণ খবরটা অনেকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে। শিরোনামটা আরো একটু আকর্ষণীয় এবং আরো হাইলাইট করা হলে, সবার দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু কেন হলো না পাঠক হিসেবে অনেকেরই প্রশ্ন হতে পারে বটে। পত্রিকার পছন্দ-অপছন্দ একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকতে পারে। সেখানে পাঠকের তো কিছু বলার থাকে না। পত্রিকাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে অবহিত করা হয়। সব বিবেচনায় এ প্রশ্ন উঠতেই পারে দায়িত্ব পালন করছি। যে খবরটির কথা বলছি, সে খবরটি কি ঢাকার সব পত্রিকা দিতে পেরেছে? সংশ্লিষ্ট খবরটি এখানে উদ্ধৃত করছি-

‘রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসংলগ্ন একটি কনভেনশন সেন্টারে গোপন বৈঠক ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের ২২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ওই বৈঠক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মেজর পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সেনাবাহিনী। গতকাল বৃহস্পতিবার সেনা সদরের প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

“এ ঘটনায় রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলা করেছে পুলিশ। তাতে বলা হয়েছে, গত ৮ জুলাই বসুন্ধরাসংলগ্ন কে বি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ একটি গোপন ‘বৈঠকের’ আয়োজন করে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা মিলে ৩০-৪০০ জন অংশ নেন। তারা সেখানে সরকারবিরোধী স্লোগান দেন। ‘বৈঠকে’ পরিকল্পনা করা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার পর সারা দেশ থেকে লোকজন এসে ঢাকায় সমবেত হবেন। তারা ঢাকার শাহবাগ মোড় দখল করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করবেন। তারা সেখানে এসব ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) ওই মামলার তদন্ত করছে। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, সোহেল রানা ও শম্পাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য যাচাই করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই বৈঠকে অংশ নেয়া মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিককে হেফাজতে নেয়া হয়। মেজর সাদিক নামের একজন আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে- এমন সংবাদের বিষয়ে গতকাল সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো: শরিফুল ইসলাম বলেন, মেজর সাদিকের বিষয়ে আমরা অবগত। তার বিষয়ে তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বলতে পারব।”

ঢাকার এ ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এটা গোয়ালন্দ থেকে শুরু সেটাও সঠিক না। এর একটা ধারাবাহিকতা আছে। যার সঙ্কেত বহু দিন থেকেই অনেকের কানেই আসছিল। কারো কাছ থেকে তার কোনো প্রতিউত্তর বা প্রতিবিধানের কথা কারো কাছেই ছিল না বলে এখন সেটা মহিরুহের আকার ধারণ করেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এখনো হয়তো বুঝে উঠতে পারছেন না, তাদের কি হবে। এ দিকে মনে এমন ভীতি তৈরি হয়েছে, তারা আসলে করিৎকর্মা নয়। এমনও প্রশ্ন আসছে যে, আসলে তাদের নাড়ির বাঁধনটা কোথায়। আর রাজনৈতিক খবর হচ্ছে, তারা লিপ সার্ভিস দিতেই ব্যস্ত।

প্রশাসনের বিষয়ে আরো কিছু সংযোজন আছে। একটি জাতীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ছিল নিরাপত্তার চাদরে রাজধানী। পত্রিকার সূত্রে প্রকাশ, ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি করেছে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে সম্প্রতি পাঠানো একটি গোপন বার্তার ভিত্তিতে এই সময়কালে রাজনৈতিক সহিংসতা বা নাশকতার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থান নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং অন্যান্য ইউনিট।

ডিএমপি কমিশনারের নেতৃত্বে স¤প্রতি অনুষ্ঠিত এক অনলাইন মিটিংয়ে জানানো হয়, রাজধানীর প্রতিটি বিভাগে দুই প্লাটুন করে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি, মোবাইল পেট্রোল, রাতভর চেকপোস্ট, হোটেল ও ছাত্রাবাসে অভিযান চালানোর পাশাপাশি ভার্চুয়াল স্কোয়ার্ডের ওপরও সাইবার গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। প্রশাসনের এমন সব বার্তা কতটা যে হাস্যকর সেটা তো দেখা গেল ভাটারা থানা মামলায়।

রাষ্ট্রের সঙ্কট উত্তরণে জাতীয় ঐক্য কতটা প্রয়োজন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ রাজনীতিতে এখন কেবল কাদা ছোড়াছুড়ি। জাতীয় ঐক্যের অবস্থানটা এখন কোথায়, সেটা একটি দৈনিকের একটি খবর থেকে স্পষ্ট। সে খবরের শিরোনাম হচ্ছে, ‘জুলাই নিয়ে অচলাবস্থা।’ এই মূল সুর হচ্ছে মতভেদের একটা বিরাট ল্যান্ড স্কেপ। জুলাই-আগস্ট শুধু জাতীয় জীবনে একটা টার্নিং পয়েন্ট নয়। এ জনপদের ইতিহাসে এক বিরাট পটপরিবর্তন। জুলাই-আগস্ট না হলে আমরা কে কোথায় থাকতাম। এ নিয়ে এখনো অনেকেরই বোধোদয় হয়নি।