মানুষ জন্মগতভাবে এমন কিছু অধিকার ধারণ করে যা কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এই অধিকার লুণ্ঠিত হয়েছে। রাজা, রাজ্য, রাজধানীর প্রতিপত্তিই ছিল শেষ কথা। অনেকসময় মানুষ আর গৃহপালিত পশুর জীবনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। শক্তিধর যে কেউ ঠুনকো কারণে কারো জীবন সংহার করে ফেলত। কোথাও তাকে জবাবদিহি করতে হতো না। মানবসভ্যতা যতই এগিয়েছে, মানুষের সেই জন্মগত অধিকারগুলো ততই সংরক্ষিত, সমর্থিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের অর্থ হলো, জাতীয়তা, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম বা অন্য যেকোনো মর্যাদা নির্বিশেষে সব মানুষের অন্তর্নিহিত মৌলিক অধিকার। এগুলো সর্বজনীন, অবিচ্ছেদ্য এবং অবিভাজ্য, যার মধ্যে রয়েছে, জীবনের অধিকার, স্বাধীনতা, দাসত্ব ও নির্যাতন থেকে মুক্তি, মতামত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, কাজ ও শিক্ষার অধিকারসহ আরো অনেক অধিকার। এই অধিকারগুলোকে নৈতিক নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা মানব আচরণের মান প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রায়ই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এগুলোর মাধ্যমেই নির্ণীত হয় মানুষ হিসেবে তার নিশ্চিত অধিকার ও সম্মানজনক নিরাপদ জীবন।
মানুষের এই অধিকারগুলো খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হাজার বছর ধরে মানুষই মানুষের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, আন্দোলন করেছে এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। সভ্যতা যতই অগ্রগতি অর্জন করেছে, মানবাধিকারের মাত্রা ও সীমারেখা ততই বিস্তৃত হয়েছে। মানুষ প্রথম অর্জন করে তার জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার এবং নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার। অবশেষে মানুষ নিশ্চিত করেছে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার। একসময় বাধ্যবাধকতা হিসেবে সবধরনের সরকারের ওপরে মানবাধিকারের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মানবাধিকারের দাবি হচ্ছে, শান্তি, উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা। ব্যক্তি থেকে সমষ্টি পর্যন্ত মানবজাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে সময়ান্তরে সর্বত্র।
১৯৪৮ সালে মানবজাতির পার্লামেন্ট- জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ একটি সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা প্রদান করে। পৃথিবীর এখন এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যাদের আইনে ও সংবিধানে মানবাধিকার সংরক্ষিত নেই। এর পরও স্বৈরাচারী শাসকরা আইনের নামে বেআইনি কার্যক্রম দিয়ে, সংবিধানের অসাংবিধানিক ব্যাখ্যা দিয়ে এবং গণতন্ত্রের অপচর্চা করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। তাদের কেউ কেউ যুক্তি দেয়, রাষ্ট্র এবং জনগণের জরুরি প্রয়োজনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকার শাসকের রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস দমনের নামে, মাদক দমনের নামে এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার ছলনায় বিভিন্ন রাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি ঘটছে। এভাবে শেখ হাসিনার মতো শাসকরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার স্বার্থে নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ১১তম অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ভাষায়, ‘প্রজাতন্ত্র একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানব সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য যেসব পদক্ষেপ, প্রতিষ্ঠান, আইন ও কাঠামো প্রয়োজনীয় ছিল, তা শাসকগোষ্ঠী কখনোই প্রতিষ্ঠা করেনি; বরং সংবিধানে নিশ্চিত মানবাধিকারের বিপরীতে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা অধ্যাদেশ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ প্রয়োগ করেছে। দেশে ও বিদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তারা নিন্দিত হয়েছে। অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপে জাতীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি অনুসারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করেছে। আন্তর্জাতিক কমিশনের উত্থিত অভিযোগগুলোর সত্যতা মেনে না নিয়ে তাদের গৃহীত কার্যক্রমকে সন্ত্রাস ও অপরাধ নিরোধের কার্যক্রম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। যেভাবেই হোক, ২০০৯ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাজ শুরু করে। সেখানে অনেক নিয়ম-নীতির কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটিতে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বশংবদ লোকদের ওখানে বসিয়ে দেয়। গত ১৬ বছরে কমিশনের দায়িত্ব পালন করা অধিকাংশই ছিলেন আমলা। চেয়ারম্যান ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক সচিব। তার আগে যিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তিনিও ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। সচিব দিয়েই চলেছে তাদের রাজত্ব, মাঝখানে একজন আওয়ামী অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কিছুকালের জন্য দায়িত্বে ছিলেন।
আইন অনুযায়ী, মানবাধিকার কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা। চেয়ারম্যানের সাথে সদস্য হিসেবে থাকেন সর্বোচ্চ ছয়জন। অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে নতুন চেয়ারম্যান যোগ না দেয়া পর্যন্ত কিংবা চেয়ারম্যান পুনরায় নিজের দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক সদস্য চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বর্তমানে এর কার্যকারিতা বন্ধ রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী পর্যায়ে মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা, সেখানে এখন পরিপূর্ণ নীরবতা। এসব বিষয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ‘আমার দেশ’ ৯ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ৭ নভেম্বর ২০২৪ কমিশনের চেয়ারম্যানসহ অন্যরা পদত্যাগ করেন। এরা ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বিগত বছরগুলোতে এই কমিশন তেমন কোনো কাজই করেনি। অথচ এই সময়ে ৫৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্মম ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকলেও কমিশনের আইনের নানা দুর্বলতা ও ত্রুটি সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু রাষ্ট্রের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে ইচ্ছা করেই অকার্যকর রাখা হয়। এমনকি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের কোনো ক্ষমতাও দেয়া হয়নি সংস্থাটিতে। এত বছরেও মানবাধিকার কমিশন নিজস্ব কোনো ভবনে যেতে পারেনি। প্রতিবেদক আরো উল্লেখ করেন, কর্মরতদের নেই যথার্থ আর্থিক সুবিধা এবং নেই দক্ষ আইনজীবী প্যানেল। বিমাতাসুলভ আচরণের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে বি-ক্যাটাগরিতেই রেখেছিল আওয়ামী লীগ।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আওয়ামী আমলের বড় বড় মানবাধিকারের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ছিল ২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যা। এ সময় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটায় আওয়ামী লীগ। আরো যেসব ঘটনা মানুষকে বিচলিত করে তা হচ্ছে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: ফয়েজ আহমদকে নিজ বাড়িতে ঢুকে পরিবারের সামনে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে র্যাব। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি খিলগাঁও এলাকায় পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় নুরুজ্জামান জনিকে। গত ১৬ বছরে আওয়ামী নির্যাতনে এরকম মানবাধিকারের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। গুম, খুন, হামলা, মামলার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে নিপীড়িত হতে হয়েছে। এসব বিষয়ে তথাকথিত মানবাধিকার কমিশন টুঁ শব্দটি করেনি। কমিশনটি বর্তমানে অকার্যকর রয়েছে। তাদের অফিস আছে, কার্যক্রম নেই। লোকজন অভিযোগ দিতে আসে; কিন্তু প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। অফিস অকার্যকর থাকায় এর আওতাধীন সামান্য অনুযোগ ও অভিযোগের কোনো প্রতিকার করতে পারছে না তারা।
এমনিতেই আন্তর্জাতিক বিশ্বকে দেখানোর জন্য কথায় বড় কাজে কম ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কমিশনটি কার্যকর থাকলে, যথার্থভাবে ক্ষমতায়িত হলে এবং শক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে, কমিশনটি মানবাধিকার রক্ষায় একটি দুর্গ হিসেবে কাজ করতে পারত; কিন্তু নীতিগতভাবে এবং বাস্তব অর্থে কমিশনটি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আইনগতভাবে এটি শক্তপোক্ত নয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরাসরি কোনো দণ্ড দেয়ার ক্ষমতা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নেই। রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রতিষ্ঠানটি শুধু তার কণ্ঠ উচ্চকিত করতে পারে, সুপারিশ করতে পারে মাত্র। গত ১৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর থাকায় জনগণের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার- গত আট মাস আগে কমিশনের সব সদস্য গণপ্রতিক্রিয়ায় পদত্যাগ করলেও মানবাধিকারের জন্য উচ্চকণ্ঠ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই কমিশনকে ক্ষমতায়ন, অর্থায়ন ও জনশক্তিতে শক্তিমান করার কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।
বিদ্বজ্জনরা মনে করেন, গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটিকে কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় অনেক কিছুই করতে পারত। বর্তমানে মানবাধিকার সংরক্ষণ, সংগঠন ও সুশৃঙ্খলা বিধানে মানবাধিকার কমিশনকে কাজে লাগানোর চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সরকারটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ। যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, তাদের দলীয় স্বার্থ ও শাসন সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়ে মানবাধিকার কমিশনটি যথার্থভাবে পুনর্গঠন, ক্ষমতায়ন ও কার্যকরকরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]