অরুনাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম রাজ্য সমন্বয়ে অবিভক্ত আসাম গঠিত ছিল। ত্রিপুরা ও মনিপুর অবিভক্ত আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের আগে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ আসামের অংশ ছিল। অবিভক্ত আসামের মোট আয়তন ছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার ৫৬৮ বর্গকিলোমিটার (৯০ হাজার ৫৬৭ বর্গমাইল)। ১৯৬৩ সালে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা পায় অরুনাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম। এরপর ত্রিপুরা ও মনিপুর রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আসাম উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। আসামের অধিবাসী বা ভাষাকে অসমিয়া বা অহমিয়া নামে ডাকা হয়। আসামের এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী বাঙালি। ব্রিটিশ শাসনামলে বিশেষ করে ১৮৫০-৬০ সালে ব্রিটিশরা বিভিন্ন রাজ্য থেকে, এর মধ্যে উড়িষ্যা ও বিহার থেকে প্রচুর শ্রমিক চা-চাষের উদ্দেশ্যে আসামে নিয়ে আসে। তারা বংশপরম্পরায় বর্তমানে আসামের স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে পরিগণিত।
১৮২৬ সালে ইয়ান্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম প্রথম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ রাজ্য মূলত চা, রেশম, তন্তু, খনিজতেল এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। আসাম সাফল্যের সাথে এক শৃঙ্গ গণ্ডার সংরক্ষণ করে এদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। এ ছাড়া এখানে বাঘ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সংরক্ষিত হয়েছে। এশীয় হাতির অন্যতম বাসস্থান হলো আসাম। রাজ্যটি বন্যপ্রাণী পর্যটনে ক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে।
অনেকের অভিমত, পার্বত্যবেষ্টিত ভূমি অসমতল হওয়ায় রাজ্যটি অসম নামকরণ করা হয়েছে। আবার অনেকের মতে, অসম প্রতাপবিশিষ্ট আহম জাতি কর্তৃক একসময় অধিকৃত হওয়ায় প্রদেশটির নাম আসাম ডাকা হয়।
আসামের অন্যতম নগর কামরূপের প্রাচীন নাম প্রাগজ্যোতিষপুর। এখানে পৌরাণিক যুগে নরক নামের জনৈক রাজা ছিলেন। তার পুত্র মহাভারত বর্ণিত ভগদত্ত। তার পরবর্তী রাজদের নাম জোগিনিতন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাদের কীর্তি গুয়াহাটিসহ এর আশপাশে এখনো কিয়দংশে দৃষ্ট হয়। গুয়াহাটি বর্তমানে আসামের রাজধানী। অবিভক্ত আসামের রাজধানী ছিল শিলং, যা বর্তমানে মেঘালয়ের রাজধানী। এ ছাড়াও খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে কামরূপ নামে এ অঞ্চলের পরিচিতি ছিল। এ অঞ্চলে আহম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর এটি আসাম নামে পরিচিতি পায়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত এবং এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা ও উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর-পূর্ব ভারতের আরো ছয়টি রাজ্য যথা- অরুনাচল, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় দ্বারা আসাম পরিবেষ্টিত। আসামসহ প্রতিটি রাজ্য উত্তরবঙ্গের একটি সঙ্কীর্ণ অংশ চিকেন-নেক করিডোরের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত। তা ছাড়াও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান ও বাংলাদেশের সাথে আসামের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।
আসাম ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৭০০-১৮০০ শতকের মধ্যে লেখা কালিকাপুরাণ অনুসারে, আসামের প্রাচীনতম শাসক ছিলেন মহিরঙ্গ।
৬৪০ সালে হিউয়েনসাং যখন এ প্রদেশ পরিভ্রমণ করেন তখন কুমার ভাস্কর বর্ম এখানে রাজত্ব করতেন। এরপর পাল বংশীয় বৌদ্ধ রাজরা এখানে কিছুকাল রাজত্ব করেন। ১৩০০ সালে প্রথম ভাগে আহম জাতি এ স্থান অধিকার করে। এ জাতি উত্তর ব্রহ্ম এবং চীন সীমান্তবাসী সাং বংশোদ্ভূত। এ জাতির রাজা চুহুম ফা সর্বপ্রথম হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৪৫৭ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তার পরবর্তী রাজার অব্যবহিত পরবর্তী আহম জাতীয় রাজা চুচেং ফা ১৬১১ থেকে ১৬৪৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার সময়ে শিব সাগরে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু ধর্ম রাজধর্মরূপে স্বীকৃতি পায়। তার পরবর্তী রাজা চুটুমলা ১৬৫০ সালে ব্রাহ্মণরা কর্তৃক জয়ধ্বজ নামে অভিহিত হন। তার রাজত্বকাল মোগল সম্র্রাট আওরঙ্গজেবের বিখ্যাত সেনাপতি মীর জুমলা রাজ্যটি আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনি বিশেষভাবে সফলকাম হতে পারেননি। এরপর আহম রাজরা গোয়ালপাড়া পর্যন্ত অধিকার বিস্তার করেন।
আহম রাজদের মধ্যে রুদ্র সিংহ সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আহম রাজরা অন্তঃবিদ্রোহ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণবশত হীনবল হয়ে পড়েন। ১৭৯২ সালে গৌরনাথ সিংহ দারাংয়ের কোচ রাজা ও মোয়ামারিয়া নামক ধর্ম সম্প্রদায়ের নেতাদের হাতে সিংহাসনচ্যুত হন। ভারতের ইংরেজ সরকার দেশীয় রাজ্য সম্বন্ধে হস্তক্ষেপ করা হবে না- এই নীতি অবলম্বন করে উদাসীন থাকাতে আহম রাজা ব্রহ্মরাজকে মধ্যস্থতা করতে আহ্বান করেন। এর ফলে ব্রহ্মবাসী রাজ্য অধিকার করে। সেই সাথে কঠোরভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। ১৮২৪ সালে ব্রহ্মরাজের সাথে ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৮২৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্রহ্মরাজের সাথে সন্ধি স্থাপনের ফলে ইংরেজরা প্রদেশটি প্রাপ্ত হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাজনের পর আসাম রাজ্যের পুনর্গঠন হয়। ১৯৬৩ সালে নাগা পার্বত্য জেলা নিয়ে নাগাল্যান্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালে গারো, খাসি ও জয়ন্তিকা নিয়ে মেঘালয় অন্তরাজ্য গঠিত হয়, যা পরে ১৯৭২ সালে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়। ১৯৭২ সালে অরুনাচল ও মিজোরাম কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষিত হয়। পরে ১৯৮৬ সালে উভয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়।
আসাম প্রদেশকে প্রথমে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীন রাখা হয়েছিল। ১৮৭৪ সালে আসামকে চিফ কমিশনারের শাসনাধীন করা হয়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষে এ রাজ্যকে পূর্ববঙ্গের সাথে একত্র করে নতুন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীন করা হয়। আর পশ্চিবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা পুরাতন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের শাসনাধীন থাকে। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির করোনেশন দরবার উপলক্ষে সম্রাটের যে ঘোষণা পাঠ কার হয়; এর ফলে দুই বঙ্গ মিলে একটি প্রদেশ আর বিহার, উড়িষ্যা ও ছোট নাগপুর নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ গঠিত হয়। প্রথমটি একজন গভর্নর এবং দ্বিতীয়টি একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীন দেয়া হয়। আসাম প্রদেশকে আগের মতো চিফ কমিশনারের শাসনাধীন করা হয়। ১৯১২ সালের এপ্রিল মাস থেকে এটি কার্যকর হয়। এরপর ১৯২১ সালে নতুন সংস্কারবিধি অনুসারে বড় প্রদেশগুলোর মতো আসামও একজন গভর্নরের শাসনাধীন হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-পরবর্তী আসাম রাজ্যপাল দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনের পর থেকে আসামসহ পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতে অর্থনৈতিক সমস্যা প্রকট হতে শুরু করে। এর ফলে এ অঞ্চলে সার্বভৌমত্ব দাবি করে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পরিচালিত আসাম সরকার বিধানসভায় একটি বিল পাস করে। যার মাধ্যমে পুরো রাজ্যে সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়াকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে দক্ষিণ-আসামের কাছাড় জেলার বাঙালিরা ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এ ভাষা আন্দোলন চলাকালীন আধা-সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১১ জন আন্দোলনকারী নিহত হন। এর পরে চাপের মুখে ভাষা বিলটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের পর থেকে আসামে বিভিন্ন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যথা- উলফা ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অব বড়োল্যান্ড জন্ম নেয়।
অসমিয়া ভাষা দেড় কোটি মানুষের মাতৃভাষা। এদের বেশির ভাগ ভারতের আসাম রাজ্যে বাস করে। এ ছাড়া পশ্চিম বাংলা, মেঘালয় ও অরুনাচল রাজ্য এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র ভুটান ও বাংলাদেশের সিলেট জেলায় অসমিয়া ভাষা প্রচলিত। পূর্ব-ভারতীয় মাগদি প্রাকৃত থেকে অসমিয়া ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৮২৬ সালে আসাম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসার পর ১৮৩৬-এ বাংলা ভাষাকে আসামের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। এর ৩৬ বছর পর ১৮৭২ সালে অসমিয়া ভাষা রাজ্যটির সরকারি ভাষা হিসেবে ফিরে আসে। বর্তমানে অসমিয়া ভারতের আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা এবং রাজ্যের সব কর্মকাণ্ডে এটি ব্যবহৃত হয়।
আসামের প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৬৩ শতাংশ, ইসলাম প্রায় ৩৫ শতাংশ, খ্রিষ্টান ৪ শতাংশ, শিখ ধর্মাবলম্বী ১ শতাংশ এবং অবশিষ্টরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও প্রকৃতির পূজারী।
উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের সাথে প্রতিবেশী মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুনাচল রাজ্যের সীমান্ত বিরোধ এখানকার আইনশৃঙ্খলায় প্রতিনিয়ত হুমকির সৃষ্টি করছে। বিবাদ শুরু হয় একেবারে স্থানীয় স্তরে। মূলত বনজ সামগ্রীর ওপর কার অধিকার তা নিয়ে রাজ্যগুলোর সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাত বাধে। তারপর সেখানে পুলিশ প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে, যার ফলে বিষয়টি সরকারি স্তরে চলে যায়। কিন্তু শেষমেশ প্রাণ যায় বা আহত হন স্থানীয় মানুষ। সীমানা নিয়ে বিরোধ আগেও ছিল; কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে, তা সহিংস আকার ধারণ করেছে।
১৮৩৫ সালের ব্রিটিশ আমলের মানচিত্রের ওপর ভিত্তি করে আসাম ভেঙে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মনিপুর, ত্রিপুরা আর অরুনাচল রাজ্য গঠন করা হয়। স্থানীয় মানুষের ভাবাবেগ বা ইতিহাস সেখানে প্রতিফলিত হয়নি। এ কারণে সীমান্তবিরোধ, জাতিগত দাঙ্গা প্রভৃতি আসামে লেগে আছে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক