তরুণদের নেতৃত্বে সারা দেশের মানুষ এক হলো। ফ্যাসিস্টকে তাড়াতে সক্ষম হলো। হাসিনা তার প্রিয় ভূমি ভারতে আশ্রয় নিলেন। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুক্ত পরিবেশের শ্বাস নিতে পারল। এর জন্য অনেক কিছু দিতে হয়েছে। দেড় সহস্রাধিক মানুষ শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ হাজারেরও বেশি। চোখ হারিয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। এমন ত্যাগ, এত কোরবানিকে অনেকে ভুলতে বসেছেন। অদ্ভুত সব আচরণ করছেন রাজনীতিবিদরা। নেতাদের চেয়ে কর্মীরা আরো সরেস। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ আরো বেশি। সমালোচনা নিতে পারছেন না কেউ। সমালোচনা করলে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। ‘পন্থী’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অযোগ্যরা চেয়ারে বসছেন। অথবা বসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। মূর্খরা জ্ঞান বিতরণ করছেন। ফলে দেশ রাজনীতি নীতির নয়, ভাগবাঁটোয়ারার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। যারা একসময় গণতন্ত্রের দাবিতে সরব ছিলেন, আজ ক্ষমতার ছায়া পেয়ে সেই দাবি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আসলে ক্ষমতা এলে নীতি পালিয়ে যায়- এটি এখনকার কঠিন বাস্তবতা।
রাজনীতিতে আজ ভয়ঙ্কর এক প্রবণতা। ভোট পেতে নেতারা আশ্রয় দিচ্ছেন সেই ফ্যাসিস্ট চক্রকেও, যাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন দেড় যুগ ধরে। যাদের দমন-পীড়নের অভিযোগ স্পষ্ট। যাদের নাম শুনলে মানুষ আতঙ্ক মনে করে। এখন তাদের কাছে ভিড়ছেন রাজনীতিবিদরা। কারণ ভোটের অঙ্ক বড় লোভনীয়। আর এ কারণে নানা প্রশ্ন উঠেছে। রাজনীতিবিদদের কি জনগণের উপর আস্থা নেই? ভোটের হিসাব-নিকাশ কি পাল্টে যাচ্ছে? ভোটের পুরনো হিসাব মিলছে না? কেন মিলছে না? কেন জনগণ তাকে বা তার দলকে ভোট দেবে, তার জবাব দিতে পারছে কোনো কোনো দল ও রাজনীতিবিদ। কেন পারছেন না? এ প্রশ্নের উত্তর আছে। জনগণ জানে। ঠিকমতো ভোট হলে সঠিক উত্তরটি তারা দেবে। কোনো সন্দেহ নেই। ফলে কোনো কোনো দল ও রাজনীতিবিদ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের কারণে রাজনীতির নীতি ভেঙে পড়ছে। যারা মুক্তির কথা বলেন, তারা আবার দোসরদের বুকে টেনে নিচ্ছেন। জনগণ বিভ্রান্ত। তারা বুঝতে পারছে না- কাকে বিশ্বাস করবে? যে দল অতীতের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, সেই দল আবার ওই অন্যায়ের সঙ্গীদের ফিরিয়ে আনে। এতে রাজনীতির নৈতিক ভিতে ফাটল ধরে।
এ প্রবণতার আরো ক্ষতি আছে। যাদের হাত ধরছে তারা সংস্কারে অনিচ্ছুক। তারা চায় ক্ষমতার সুরক্ষা। স্বার্থ তাদের একমাত্র অ্যাজেন্ডা। ফলে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন থেমে যায়। জবাবদিহি পিছিয়ে পড়ে। স্বচ্ছতা হারিয়ে যায়।
রাজনীতি কখনো পুরো পরিষ্কার ছিল না। তবু কিছু নীতি ছিল। আজ সেই নীতিও বিলীন হওয়ার পথে। ভোটের লোভ সব কিছু গ্রাস করছে। পরিণতি ভয়াবহ। সমাজে বার্তা যাচ্ছে- নীতি নয়, সুবিধা চূড়ান্ত সত্য। তরুণরা বিমুখ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন সংবেদনশীল সময়ে। এ সময়ে ফ্যাসিস্ট চক্রকে পুনর্বাসন করা শুধু কৌশল নয়- এ গভীর বিপদ। এটি গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড দুর্বল করে। যদি রাজনীতি সত্যি নতুন পথ দেখাতে চায়, প্রথম শর্ত হলো নীতিতে অবিচল থাকা। ভোটের জন্য নীতি বিক্রি হলে ভবিষ্যৎ আর নিরাপদ থাকবে না। রাজনীতিবিদরা নিরাপদ থাকবেন না। মিছিলের মঞ্চে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু পর্দার আড়ালে ক্ষমতার দখলদারিত্বের হিসাব। এ শুধু ভণ্ডামি নয়। এ এমন এক অভ্যাস, যা ভেতর থেকে গণতন্ত্রকে খেয়ে ফেলে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ভাঙন দুই বিপদ ডেকে আনবে- প্রথমত, নৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শর্টকাটকে স্বাভাবিক করে তোলে। শর্টকাট নিয়মে পরিণত হয়। নিয়ম ভবিষ্যতের আচরণ গড়ে দেয়। পেশাজীবী সংগঠনগুলো ছিল মর্যাদার স্থান। এখন সেগুলোও দলে দলে ভাগ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, বার কাউন্সিল, সাংবাদিক সমাজ- সব জায়গায় পক্ষপাতের ছাপ। এর ফল পূর্বানুমেয়। দক্ষতা উপেক্ষিত হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। জনপরিসর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
আধুনিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি নিয়ম আছে- ক্ষমতার নেশা সীমা পরীক্ষা করে। গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচ দুর্বল হলে পরীক্ষা ভাঙনে পরিণত হয়। ইউরোপ ও আমেরিকার বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন। স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল জিবলাট বলেন, গণতন্ত্র সাধারণত ধ্বংস হয় ধীরে ধীরে, নীরব ক্ষয়ে। যখন পারস্পরিক সহনশীলতা হারিয়ে যায়, আর রাজনৈতিক নিয়মের জায়গা নেয় কৌশলী প্রতিশোধের রাজনীতি।
জান-ওয়ের্নার মুলার সতর্ক করেন জনতুষ্টির রাজনীতির মূল বিপদ নিয়ে : এ ধরনের রাজনীতি বহুত্বকে অস্বীকার করে। বিরোধী মতকে ‘অবৈধ’ হিসেবে চালায়। তখন প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে দখলের শিকার হয়। ইয়াশা মাউনক দেখিয়েছেন- নির্বাচন থাকলেও গণতন্ত্র ফাঁপা হয়ে যেতে পারে। এক ধরনের ‘সফট স্বৈরতন্ত্র’ তৈরি হয়- উপরের দিকে প্রতিযোগিতা আছে, ভেতরে ক্ষয়।
অ্যান অ্যাপলবাউমসহ আরো গবেষক দেখিয়েছেন, নাগরিক সমাজ ধ্বংস হয় এক দিনে নয়। শুরু হয় কো-অপ্টেশন দিয়ে। পেশাজীবী সংগঠনগুলো নিয়ন্ত্রণের পরোক্ষ কৌশল দিয়ে। এরপর সেগুলো ক্ষমতার হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
এসব আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। এগুলো শুধু তত্ত¡ নয়- আছে বাস্তব শিক্ষা। প্রথমত, স্বল্পমেয়াদি সুবিধা দীর্ঘমেয়াদি নিয়মে পরিণত হতে দেয়া যাবে না। পেশিশক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করা সাময়িক জয় এনে দেয়; কিন্তু এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করতে হবে। আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, পেশাজীবী সংগঠন, গণমাধ্যম- সব পক্ষপাতহীন থাকতে হবে। পার্টিজান দখলের ফলে জনবিশ্বাস চূর্ণ হয়।
তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজকে বহুত্ববাদী রাখতে হবে। শিক্ষক, ছাত্রসংগঠন, ইউনিয়ন, এনজিওগুলোর ওপর দলীয় চিহ্ন চাপানো বিপজ্জনক। এগুলো স্বাধীন রাখা না গেলে কেউ আর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না।
চতুর্থত, রাজনীতিতে নিয়মের সাথে সাথে আচরণগত নীতি প্রয়োজন। সব কিছু আইন দিয়ে ঠিক করা যায় না। সহনশীলতা, সংযম, পরস্পরের প্রতি সম্মান- এসব গণতন্ত্রের নমনীয় কাঠামো। নাগরিকদের এখন কী করতে হবে? স্বচ্ছতা দাবি করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি চাইতে হবে। নেতাদের কথার চেয়ে কাজে বিচার করতে হবে।
প্রতিটি মতকে শত্রু ভাবা বিপজ্জনক। নিয়ম মেনে ঐক্য থাকলে মতবিরোধ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। ক্ষমতার কাছাকাছি যারা- তাদের জন্য সতর্কবার্তা, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয় অস্ত্র নয়। শর্টকাট লোভনীয়, কিন্তু ধ্বংসাত্মক। নীতি ছাড়া ক্ষমতা টেকে না।
পেশাজীবীদের করণীয় হলো- নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে হবে। পেশাগত শপথকে রাজনৈতিক চাপের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। সঙ্কটের সময়ে পেশাদারিত্ব সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। এটি নিষ্ক্রিয়তার আহ্বান নয়। এটি কঠিন, পরিষ্কার চিন্তার আহ্বান। উন্মত্ত উদ্দীপনা দিয়ে কাঠামো পুড়িয়ে ফেলা সহজ। কিন্তু গণতন্ত্র টেকে কাঠামো রক্ষা করলে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে প্রতিষ্ঠান ভেঙে গেলে দেশ পুনর্গঠনের শক্তি হারাবে। এটি সবচেয়ে বড় বিপদ।
ইতিহাস স্মরণ রাখে নির্মাতাদের। লুটেরাদের নয়। বাংলাদেশকে বেছে নিতে হবে নির্মাণের পথ। এর জন্য বর্ষা বিপ্লব। এর জন্য প্রাণ দিয়েছেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমরা। এটি অস্বীকার করে কেউ টিকে থাকতে পারবেন না। তরুণরা মানবে না। তরুণদের অস্বীকার করে আর রাজনীতি চলবে না। ভোটারদের ৪০ শতাংশ তরুণ। মানে, চার কোটি।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন



