শিশু চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, দক্ষ চিকিৎসা প্রশাসক ও সফল শিল্পোদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কারমনস্ক এবং সমাজসেবায় একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার পদকে ভূষিত অধ্যাপক এম আর খান চিকিৎসা ও সমাজসেবায় জাতীয় পর্যায়ে ছিলেন একজন অনুকরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ঋধঃযবৎ ড়ভ চবফরধঃৎরপং হিসেবে বাংলাদেশে যিনি ছিলেন পরম সম্মানীয়। এই নির্লোভ, প্রচারবিমুখ সদাহাস্য মানুষটি তার বিভিন্ন জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে অসংখ্য মানুষকে সেবা দিয়ে গেছেন।
শিশুবন্ধু এম আর খানের জীবন দর্শন হলো- কর্মচাঞ্চল্য আর মহৎ ভাবনার সরোবরে সাঁতার দিয়ে মানবকল্যাণে নিবেদিত চিত্ততা। নিবেদিতা মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট আর অগণিত শিশুচিকিৎসা সদন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নেরা ডানা মেলেছে সাফল্যের আকাশে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশু, নারী ও অসহায়জনের নতশির, মূক ও ম্লান মুখে হাসি ফুটিয়ে সাফল্যের তারকারা ঝিলিমিলি করত তার ললাটে, তার মুখে-তার সানন্দ তৃপ্তির নিলয়ে। জোনাকির আলো যেমন অমানিশার আঁধারে মিটি মিটি জ্বলে এক অভূতপূর্ব পেলব শান্তি ও সোহাগের পরিবেশ রচনা করে, তেমনি তার সুদক্ষ পরিচালনায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, নৈপুণ্যে, নিবেদনে অর্থবহ অবয়ব রচনা করে চলতেন নিত্যনিয়ত। এ সবের মধ্যে চিরভাস্বর হয়ে রইবে তার স্মৃতি। ‘উপকার করো এবং উপকৃত হও’ এই মহাজন বাক্য তার জীবন ও কর্মে, মনন-মেধায় পথচলা ও জীবন সাধনায় স্বতঃসিদ্ধের মতো অর্থবহ হয়েছে এবং কার্যকর ছিল। আর এসবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের মতো সারল্যে, সহজিয়া কড়চায়, বন্ধুবাৎসল্যে, স্নেহাস্পদনায়, মুরব্বিয়ানার মাধুর্যে ছিল তার ব্যক্তি ও চরিত্র উদ্ভাসিত।
জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান
(১ আগস্ট ১৯২৮ - ৫ নভেম্বর, ২০১৬)
জাতীয় অধ্যাপক ডা: এম আর খান রোগীকে মানুষ মনে করতেন। মনে করতেন, প্রত্যেক রোগীই আমাদের এই সমাজের কারো না কারো আত্মীয়-স্বজন বা আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন তখন তিনি সাহায্যপ্রার্থী, অনেক সময় অসহায়ও বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয় তা হলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য রোগীর কষ্ট ধৈর্যের সাথে গভীর মনোযোগে শোনা; রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন; তেমনি রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও তাদের আশ্বস্ত করাও প্রয়োজন। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমন নয়। সুস্থ হতে কারো সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলতেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহ তায়ালা; তেমনি রোগ থেকে মুক্তি বা আরোগ্যদাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন, ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
শিশুদের সেবার মানসে তিনি ১৯৮৩ সালে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার মিরপুরে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এবং একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট ও যশোরে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন ছাড়াও স্থানীয় জনগণ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি তার পেনশনের টাকা, পৈতৃক জমিজমা এবং স্ত্রীর সঞ্চয়ের অর্থে ১৯৮৫ সালে সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- ১. ডা: এম আর খান অ্যান্ড আনোয়ারা ট্রাস্ট; ২. উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ; ৩. নিবেদিতা চিলড্রেন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার; ৪. সেন্ট্রাল হাসপাতাল প্রা. লি. ইত্যাদি। সাতক্ষীরায় নিজের গ্রাম রসূলপুরকে আদর্শ গ্রাম তথা দারিদ্র্যমুক্ত গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার স্বপ্ন উদ্যোগ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূয়ো-দর্শন হিসেবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। ‘নিজের গ্রামকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করি’-এই প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত বাংলাদেশের সব সচেতন মানুষ তার মতো কর্মবীরের অনুসরণে একযোগে কাজ করতে পারলে সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা আর সুদূর পরাহত থাকে না। ‘রসূলপুর আদর্শ গ্রাম’ এই মডেলে তার প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ছিল- গড়ে উঠুক বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম ও জনপদ। পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মযজ্ঞে রসূলপুর এখনো পল্লী উন্নয়নে এক সমৃদ্ধ চেতনার নাম। সুদূর পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামায় বোধিছড়া গ্রামে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগেও তিনি রেখেছেন শিশুবিকাশে তার সৃজনশীল হাতের স্পর্শ। ‘দুর্বল মানুষ যদি তোমাকে ধরে পার হয় জীবনের অথৈ নদী’ তাতে তোমার নিজের কোনো ক্ষতি নেই; বরং বিপদমুক্ত মানুষের কলরবে, সাফল্যে ভরবে দেশ ও জাতি।
কেন তাহলে এ পথে পিছিয়ে যাব? রেখেছিলেন এ প্রশ্ন নিজের কাছে, দেশের কাছে। মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক মাস তিনি তার প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে পরিচর্যাধীন ছিলেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ‘দু’টি কথা’ শীর্ষক শেষ লেখায় তিনি বলেন : ‘মানুষ বাঁচে আশায়, দেশ বাঁচে ভালোবাসায়। আপনি আশা করেন এটা-ওটা করবেন। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে কিন্তু আল্লাহ জানেন, আপনি কতদিন এ দুনিয়ায় আছেন। সুতরাং আপনি যেটি ভালো মনে করেন এখনই বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করবেন। এ সুযোগ আর নাও আসতে পারে। ‘শুভস্য শীঘ্রম’-রাম রাবনের একটি গল্প শুনাতে চাই। রাবন বললেন, আমি স্বর্গের সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার সময় শেষ। সে জন্য আমি তোমাকে একটি উপদেশ দেবো, যদি তুমি কোনো ভালো কাজ করতে চাও ঝঃধৎঃ হড়,ি ফড়হ’ঃ ধিরঃ ভড়ৎ ঃড়সড়ৎৎড়.ি
এ প্রসঙ্গে তিনি তার জীবনের দু’টি ঘটনা তুলে ধরেন- প্রথমত, শিশুদের জন্য পথকলি নামে এক সংস্থায় কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো বর্তমান ইন্টারকন হোটেলের উত্তর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাড়িতে। আমি তৎকালীন সরকারপ্রধানের কাছে তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য একটা জায়গা চেয়েছিলাম। সেটি হলো মিরপুরের এশিয়া সিনেমা হলের উল্টো দিকে। এক বিঘা জমিতে একটি টিনের ঘর করে সেখানে আউটডোর শুরু করা যেত। তখন পথকলি ট্রাস্ট গঠনের লক্ষ্যে অনেক টাকাও উঠেছে, সেই টাকা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর উদ্যোগ নেয়া যেত। হাসপাতাল ও মসজিদ সবাই চান, কেউ এর বিনাশ চান না। সরকারপ্রধান বললেন, পরে হবে। এ বাড়িটি তো কেউ নিচ্ছে না, এখানেই কাজ চলতে থাকুক। আমি স্থায়ী জায়গার জন্য আবেদন জানাই। তিনি বললেন, দেখা যাক, পরে হবে। কিছু দিনের মধ্যে পট-পরিবর্তন হলো। পথকলি ট্রাস্ট বন্ধ হয়ে গেল। সব শেষ। অসচ্ছল শিশুদের সেবার সুযোগ মিলিয়ে গেল।
দ্বিতীয়ত, তৎকালীন আইপিজিএমআর, বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে একটি জায়গা ছিল। আমি ও প্রফেসর নূরুল ইসলাম সাহেব এ হাসপাতাল বর্ধিত করার লক্ষ্যে ওই জায়গাটি হাসপাতালের নামে বরাদ্দের জন্য ভূমিমন্ত্রী আব্দুল হকের সাথে দেখা করি। কয়েক দিন যাতায়াতের পর সেখানে দেখলাম খুবই হইচই। আমি মন্ত্রীকে অনুরোধ জানালাম, স্যার কাজটি ভালো মনে করলে আজকে করে দিন। আপনার এখানে যে অবস্থা না জানি আপনি কয় দিন এ দায়িত্বে থাকবেন? মন্ত্রী বললেন, আজ তো অফিস প্রায় শেষ, কালকে আসেন। আমি বললাম, কালকে আপনি এ পদে না-ও থাকতে পারেন। সবাই আমার কথায় অবাক। বললাম, আজকে সম্ভব হলে করে দিন। সন্ধ্যায় আমাদের পিএকে টাইপ মেশিনসহ তার কাছে পাঠালাম, রাতের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যের পরিহাস, পরের দিন তার মন্ত্রিত্ব চলে গেল। সুতরাং শুভস্য শীঘ্রম কত উপকারী। আমার এই দু’টি ঘটনা বলার উদ্দেশ্য- প্রথমটি পরে করবেন বলে রেখে দিলেন কিন্তু আর করতে পারলেন না। আর দ্বিতীয়টি তিনি যদি ওই দিন রাতে না করতেন তাহলে হয়তো এটিও হতো না।
‘দেশ বাঁচে ভালোবাসায়’ শিরোনামে তিনি আরো লিখেছেন- ‘আপনি টাকার আড়াই শতাংশ জাকাত দেন। সময়ের জাকাত যদি আড়াই শতাংশ ধরি, তবে সপ্তাহে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা হয়। সপ্তাহে দুই দিন ২.১৫ মি., ২.১৫ মি. ঘণ্টা সময় দিতে পারেন। এতে অনেক ভালো কাজ করতে পারবেন। আপনারা সবাই ব্যস্ত, আপনাদের সময় অনেক মূল্যবান। তবুও সবার জন্য ২৪ ঘণ্টা সমান। আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরও ২৪ ঘণ্টা, আপনাদেরও ২৪ ঘণ্টা, আমারও ২৪ ঘণ্টা। ব্যাপার হলো- এই ২৪ ঘণ্টা আমরা কে কিভাবে ব্যবহার করি। সেটিই ভবিষ্যতের সফলতা। যদি আপনি আপনার গ্রামের বা ইউনিয়নের বা উপজেলার বা জেলার একজন লোককে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন তাহলে তিনি তার পরিবারের, তার গ্রামের একজন আদর্শ মানুষ হতে পারেন, যার দ্বারা সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। তবে এর ঘবমধঃরাব ধংঢ়বপঃ আছে, তিনি যদি লাঞ্ছিত, বাধাপ্রাপ্ত বা নির্যাতিত হন তবে এ কাজ আর করবেন না। এমনকি তার আত্মীয়রা তাকে অন্যভাবে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করবেন। এখানে আমি সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’ থেকে একটি ঘটনা তুলে ধরব। নবকুমার ও তার সঙ্গীরা নৌকা করে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে রান্নার জন্য কাঠের প্রয়োজন হলো। তখন নবকুমারকে কাঠ সংগ্রহের জন্য একটি দ্বীপে নামিয়ে দেয়া হলো। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, নদীতে জোয়ার এলো কিন্তু নবকুমার আর ফিরে এলো না। তখন তার সঙ্গীরা মনস্থির করল, কতক্ষণ আর অপেক্ষা করব? তখন নবকুমারকে রেখে তার সঙ্গীরা চলে গেল। নবকুমারের ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছিল আমরা কিন্তু জানি না। তাই সাহিত্য সম্্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘নবকুমারের কাষ্ঠ আহরণের বিপর্যয় দেখিয়া যদি কেহ পর উপকারে ব্রতী না হন তাহলে তিনি মহা ভুল করবেন।’
অর্থাৎ- ভালো কাজে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে কিন্তু আপনার যদি নিয়ত ঠিক থাকে, ধৈর্য, সাহস ও নিষ্ঠা থাকে তবে সফলতা আসতে বাধ্য।
অধ্যাপক ডা: এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, হয়েছিলেন ঈর্ষণীয় সম্মানে ভূষিত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা স্বর্ণপদক-১৯৯৯, সমাজসেবা বিষয়ে অবদানের জন্য একুশে পদক-২০০৯ এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক-২০১৬ প্রদান করে তার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে।
লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান