দেশের তিনটি পার্বত্য জেলা- খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে কেন সঙ্ঘাত। কারা ধারাবাহিক এ অশান্তির হোতা, তা আর গবেষণার বিষয় নয়। পাহাড় অশান্ত থাকলে কারা লাভবান- এ প্রশ্নের জবাবও পরিষ্কার। এ নিয়ে তথ্য-তালাশ বহু হয়েছে। এখন দরকার যথাযথ পদক্ষেপ। মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির পাহাড় থেকে অস্ত্র উদ্ধার হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হয় এমন অস্ত্র রকেট লাঞ্চার, এলএমজি, একে-৪৭ ও গ্রেনেড ব্যবহার করছে পাহাড়ি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো।
দেশের অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা প্রচার ও অপতত্তে¡র মাধ্যমে পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে কিছু সংগঠন। পার্বত্য অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে পাশের দেশের ছত্রছায়ায় সক্রিয়ভাবে এ কাজ হচ্ছে।
পাহাড়ি জনপদ বাংলাদেশেরই সীমানায় আমাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সুরক্ষা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। দেশের জল-স্থল, পাহাড় নিরাপদ রাখতে যা দরকার, তা-ই করার এখতিয়ার সরকারের। কিন্তু পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেলেই দরদি কিছু মহল তৎপর হয়ে ওঠে। জ্ঞান জাহির করে আদিবাসী, প্রকৃতি, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে। অথচ সেখানকার অবস্থা তাদের অজানা নয়। জেনেও, বুঝেও না জানা- না বোঝার ভান ধরেন। কে না জানে ইউপিডিএফ (প্রসিত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), জেএসএস (সন্তু) ও জেএসএস (এম এন লারমা) সবাই অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান। অস্ত্রের জোরেই নিয়ন্ত্রণ করছে বিস্তীর্ণ এলাকা। করছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড। দেশের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকেও চ্যালেঞ্জ করে জানিয়ে দেয় তাদের হিম্মত। পাহাড়ি এসব বাহিনীতে রয়েছে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত আর্মস ক্যাডার। এরা আবার নিজেরা নিজেরাও দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়। করে গোলাগুলি-সংঘর্ষ। ঘটায় প্রাণহানি। তা হয় বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য রক্ষার জন্য। সঙ্ঘাতে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হয়, জনজীবনে নেমে আসে চরম আতঙ্ক। সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থাটি এমন কখনো কখনো তথ্য পেলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সাত-আট ঘণ্টা লেগে যায়। এর মধ্যেই সন্ত্রাসীরা ঘটনা ঘটিয়ে চম্পট দেয়। এতে এরা দমে না। একটু দম নেয়। বাড়ায় অস্ত্রের মজুদ। সেই সাথে রিক্রুটও বাড়ায়।
গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে, গত এক বছরে পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র গ্রুপগুলো আনুমানিক ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে। এর মধ্যে ইউপিডিএফ একাই ১০৪ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছে, যা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশের একটি গণমাধ্যমের সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদনে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউপিডিএফের হাতে ৩০০ জন অপহৃত হয়েছেন এবং ৮৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য এবং সেনাবাহিনীর ১৬ জন সদস্যও রয়েছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে অপহরণের মতো গুরুতর ঘটনাও ঘটেছে। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বিদেশী সহায়তা। প্রাপ্ত প্রমাণাদি অনুযায়ী, তারা ভারতের মিজোরাম রাজ্যে অবস্থিত সশস্ত্র ক্যাম্প থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ নিচ্ছে।
পার্বত্য আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছ থেকে চলতি বছরের বিভিন্ন অভিযানে আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৪০ মিমি গ্রেনেড লাঞ্চার, এম-১৬ ও একে-৪৭ রাইফেল, মার্কিন এম-৪ কার্বাইন, গ্রেনেড, হাজার হাজার রাউন্ড অ্যামুনেশন, ম্যাগজিন, কর্ডেক্স বিস্ফোরক তার, ডেটোনেটর, সেফটি ফিউজ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম। ওই অঞ্চলে মোতায়েন করা সেনাবাহিনীকেই বড় বাধা মনে করে তারা। রাজনৈতিক সংযোগ থাকায় তারা যেকোনো ছুতায় মাঠ কাপিয়ে দিতে পারছে। এবারো করেছে। দেখা গেল- ধর্ষণই হয়নি; কিন্তু ধর্ষণের বিচার চেয়ে হরতাল, বিক্ষোভ, আগুন, নিন্দা, প্রতিবাদ- কিছুই বাদ যায়নি। দেশের বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ-বিবৃতি। সাধারণ মানুষ হকচকিত। নানা জিজ্ঞাসা। এর মধ্যে দিয়ে তিনজনের প্রাণহানিসহ হতাহত বেশ কয়েকজন।
এখন ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হওয়ায় তাদের কিছু যায়-আসে না, যা ঘটানোর ঘটিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়ে এসেছে। এরা এখন কিছুদিন একটু দম নেবে। ক’দিন পর আবার আরেকটা ছুতায় নামবে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। হাইপ তুলবে। ঘটনা ঘটবে। পার্বত্যাঞ্চল থেকে সেনা সরানোর বোল তুলবে আবার। তাদের মূল টার্গেটই সেনাবাহিনী। কারণ সেনাবাহিনী পার্বত্যাঞ্চলে থাকায় তারা যথেচ্ছা চাঁদাবাজি করতে পারে না। দিতে পারে না অস্ত্রের মহড়া। জুম্মল্যান্ড বাস্তবায়ন এগোয় না। এর আগে সাইকেল চুরি, মোটরসাইকেল চালক হত্যাসহ নানান উছিলায় কাণ্ডকীর্তি প্রায় এমনই। এবারো কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, পেছন থেকে কারা ফুয়েল জুগিয়েছে তা জানার বাইরে নয়। সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে। কারা কোথায় কী মন্ত্রণাপ্রাপ্ত হয়েছে, টেলিফোনে কী ছবক বাতলানো হয়েছে, লগ্নি কোত্থেকে এসেছে- তাও জেনেছে। কিন্তু সেই তুলনায় পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। ঘটনার গভীরতা ব্যাপক। সমস্যাটি এখন আর জাতীয় বা আঞ্চলিক নয়। এর সাথে জড়িয়ে গেছে দেশী-বিদেশী অনেক পক্ষ ও সমীকরণ।
অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভুল বার্তা পাঠানো এবং নিরাপত্তাবাহিনীকে দুর্বল করার নতুন একটি ঘটনার অপেক্ষায় ছিল এই চক্র। ঘটনার চক্র বা কাকতালীয়ভাবে গত বছরও সেপ্টেম্বরকেই বাছাই করেছিল তারা। ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেলচালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের অভিযোগকে আমলে নিয়ে ইউপিডিএফের দাবি করা সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। নেয়া হয় পুলিশ হেফাজতে। ঘটনাটির সত্যতা বিচারে আইনি প্রক্রিয়া চলমান। শয়ন শীলকে গ্রেফতার করা সত্তে¡ও ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পিসিপির নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল এবং প্রতিবাদী মানববন্ধনের ডাক দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ২৫ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফের আহ্বানে খাগড়াছড়িতে অর্ধবেলা হরতাল পালন করা হয়। একই সময় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ব্লাগার এবং পার্বত্যাঞ্চলের কিছু ব্যক্তি অনলাইনে বাঙালিদের উদ্দেশে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া শুরু করে। পরিকল্পনা মতো, ২৬ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ কর্মী উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে এবং সামাজিক মাধ্যমে দেশী ও প্রবাসী ব্লাগারসহ পার্বত্য জেলার কিছু ব্যক্তির উসকানিমূলক প্রচারণার জেরে গোটা খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা হয়।
অবরোধ চলাকালে একপর্যায়ে ইউপিডিএফের প্ররোচনায় উচ্ছৃঙ্খল এলাকাবাসী টহলরত সেনাদলের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। বাজার, দোকানপাট এমনকি মসজিদে পর্যন্ত আগুন দেয়। পাহাড়ের অনেক বাসিন্দাই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় তৈরি রাখে। কখন কী ঘটবে কেউ জানে না। পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে স্থানীয় সবাই এই দুষ্টচক্রের সন্ত্রাসের শিকার। স্বার্থান্বেষী কোনো কোনো মহল নানাভাবে সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে ইন্ধন দিয়ে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী বিবাদ জিইয়ে রেখেছে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী চায়, পাহাড়ে দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত বজায় থাকুক পাহাড় অশান্ত থাকলেই তাদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটে।
হালনাগাদ তথ্য বলছে, ইউপিডিএফের অন্তত ছয়টি ক্যাম্প ভারতের মিজোরামে। তাদের লোকজন প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। সীমান্ত পাহাড়ে ক্যাম্প বাড়ানো ছাড়া এ অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবে না। পার্বত্যাঞ্চলের অশুভ তৎপরতা সরকারকে শক্ত হাতে দমন করতেই হবে। পাহাড়ে সুদৃঢ় করতে হবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। পাহাড়িদের নজিরবিহীন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি, জীবনযাপন- সব ক্ষেত্রেই সামনে এগিয়ে আনা হয়েছে। কিছু সন্ত্রাসীর কারণে এ অগ্রযাত্রা যেন না থামে। বর্তমানে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে মোট ২১০টি ক্যাম্প থাকলেও বিস্তীর্ণ ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের জন্য তা যথেষ্ট নয়। শান্তিচুক্তির পর ক্যাম্প কমে যাওয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নতুন করে শক্তি জুগিয়েছে।
গেল সরকারের আমলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি অপেক্ষাকৃত নমনীয় নীতি নেয়া হয়েছিল। পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর প্রতি নমনীয় থাকার অলিখিত নির্দেশও জারি ছিল। এর সুবাদে সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক মদদ ও প্রশাসনিক শৈথিল্য কাজে লাগিয়ে মোটাতাজা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে সেটি দিনে দিনে বিপদ বাড়িয়েছে। এখন তার জের সইতে হচ্ছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসও জরুরি। এ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ যেন না হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট