আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা একদিন শান্তির দ্বীপ লঙ্কাপুরায় (শ্রীলঙ্কা) ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। লঙ্কাধিপতি রাবনকে নাম দিয়েছিল রাক্ষস, ‘রাক্ষসরাজ রাবন’। সেই ধ্বংসযজ্ঞের কাছে চেঙ্গিস হালাকুদের পরদেশ দখলের গণহত্যা ও নিপীড়ন কিছুই নয়। লঙ্কাবাসীর সেই আর্য হত্যাযজ্ঞেরই যেন বদলা হিসাবে এলো কমরেড অনূঢ়ার ঐতিহাসিক বিজয়। শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার পর এই প্রথম দেশটির শাসন ক্ষমতার অধিকারী দুই প্রধান দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) এবং শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির ধারানুক্রমিক একচেটিয়া ঘরানার বাইরে এলো।
এবারই প্রথম দেশীয় ‘অভিজাত’ এবং ভারতীয় দাদাগিরির কব্জা থেকে দ্বীপদেশটিকে মুক্ত করার স্বাধীন বার্তা নিয়ে কম বয়সী বাম নেতা অনূঢ়া কুমারা দেশানায়কের উত্থান ঘটল কলম্বোয়। একে একে প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের ‘বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের’ অবসানের পটভূমিতে লঙ্কান স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদীদের বিপুল নির্বাচনী বিজয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক রণকৌশলে নিয়ে আসতে চলেছে এক বিরাট পরিবর্তন। শ্রীলঙ্কার নতুন বাস্তবতা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিচ্ছে। গোতাবায়া রাজাপাকসের দুঃশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০২২ সালে ঠিক সেই গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল, যা হয়েছে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী হাসিনার গণনিপীড়ন, গুম, খুন, মামলা ও বিরোধী মত দমনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা-সিপাহি দেশপ্রেমিকদের দুনিয়া কাঁপানো জুলাই-আগস্ট (২০২৪) গণ-অভ্যুত্থানে।
লঙ্কাদ্বীপে এবারের ফলাফল ছিল সামাজিক রূপান্তরের এক বিস্ময়কর মাইলফলক। অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছাড়া হতে বাধ্য হন গোতাবায়া রাজাপাকসে। এবারের নির্বাচনে বিস্ফোরিত হলো সেই অসমাপ্ত গণবিদ্রোহের ডিনামাইট। রাজাপাকসের পরিবারের প্রার্থী ছিলেন তার ভাতিজা নমাল রাজাপাকসে। অভ্যুত্থানে অপসারিত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। তিনি ভোট পেয়েছেন তিন লাখ ৪২ হাজার আর জেভিপির অনূঢ়া বিজয়ী হয়েছেন ৫৬ লাখ ৩৪ হাজার পপুলার ভোটে। তিনি পেয়েছেন মোট ভোটের ৪২ ভাগ। এই বিপুল ব্যবধান থেকে ফুটে ওঠে গণ-অভ্যুত্থানের তাৎপর্য। এটা পরিষ্কার যে, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে লঙ্কাবাসী শুধু পুরোনা বন্দোবস্তকেই অচল করে দেয়নি; খোঁজ পেয়েছে তরুণ ও নতুন নেতৃত্বেরও। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে অনূঢ়া এই নির্বাচনী বিপ্লবকে ‘শ্রীলঙ্কার রেনেসাঁ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আগের আমলটি ছিল অভিজাতদের ধারাবাহিক শাসনধারা। ২০২২ নাগাদ শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে পড়াটাকে সেখানকার অভিজাত রাজনীতিরই অনিবার্য পরিণতি বলে মনে করা হয়েছে।
বিগত ১৬ বছরের তিনটি নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে হতে পারত তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতো। কিন্তু তার সামান্য সুযোগটুকু রাখেনি হাসিনা স্বৈরাচার, যার পেছনে সর্বতোভাবে সক্রিয় প্রভাব রেখেছে আধিপত্যবাদী ভারত। সেটা এখন থেকে আর পারবে না বাংলাদেশে, শ্রীলঙ্কায়ও। মালদ্বীপ ও নেপাল থেকে ইতোমধ্যে ঘাড়ধাক্কা খেয়েছে ভারত। অর্থাৎ তার চারপাশে এখন স্বাধীনতাপ্রিয় জাতিপুঞ্জ, এমনকি তার নিজ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি প্রদেশগুলোও। তারাও এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা অভিলাষী। বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচি এখন পাবে নতুন গতিবেগ। অনূঢ়া তাদের নিয়তির নিকটতম সাথী করে নেবে গণচীনকে। এমনিতেও চীনের অনেক ঋণস্বার্থ পড়ে আছে শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কা চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ ইনিশিয়েটিভের এক বড় হিস্যাদার।
শ্রীলঙ্কার মানুষ যুগ যুগ ধরে ভারতকে গণ্যমান্য করে এসেছে বৃহৎ প্রতিবেশী এবং ক্ষমতাধর উন্নয়ন-অংশীদার হিসাবে। কিন্তু তাদের সে ভুল খান খান হয়ে ভেঙে গেছে গৃহযুদ্ধের বছরগুলোয়। ভারত অর্থ দিয়ে অস্ত্র দিয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিলদের পাশে দাঁড়িয়েছে সিংহলী জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে। অথচ ভারতেরই এক বিশাল বাজার শ্রীলঙ্কা; যেমন তার একচেটিয়া বাজার বাংলাদেশ কিংবা নেপাল। অথচ যখনই ভালো করার উদ্যোগ নিয়েছে তখনই নেপাল ভারতের রোষানলে পড়েছে। কলম্বোর রাস্তায় যত গাড়ি চলে অধিকাংশই ভারতের টাটা কোম্পানির। নতুন নির্বাচিত শাসক মহল শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় আগ্রাসনের দিন ভুলে যেতে বলেছে। নিমজ্জমান দ্বীপদেশ মালদ্বীপের মতো শ্রীলঙ্কাও এখন থেকে অনুসরণ করবে স্বাধীন বিদেশনীতি; যেমনটা করতে চলেছে বাংলাদেশ এবং নেপাল। এটাই বাস্তবতা; এটাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে অর্থাৎ নিজের গ্রামে গণধিকৃত হয়ে চানক্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-শাসিত ভারত এখন অনুসরণ করছে চানক্যের কূটনীতি, যার মর্মকথা হলো নিকট প্রতিবেশীকে পদানত করে রাখো এবং অন্বেষণ করো দূরের প্রতিবেশীদের মৈত্রী ও আনুগত্য। ভারত তাই এখন বৈশ্বিক স্কেলে আমেরিকা ও হানাদার রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার যারপর নাই চেষ্টা করছে। অথচ এই ভারতই একদিন মার্শাল টিটো, জামাল নাসের, সুকর্ণ এবং কৃষ্ণ আফ্রিকার হাতে হাত মিলিয়ে ‘জোট নিরপেক্ষ’ বিশ্ব গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
অবশ্য ভারতের খাসলত কোনো দিনই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তারা রাশিয়াকেও হাতে রেখেছে; আমেরিকার সাথে চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদেরও বন্ধু সেজেছে; গোপনে ইসরাইলের কনস্যুলেট খুলে জগতের ক্যান্সার ইহুদি জায়নবাদীদেরও নির্বিঘ্নে যাবতীয় ষড়যন্ত্র চালানোর বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ভারতীয় নীতির শঠতা কী পরিমাণ বিপজ্জনক দেখুন। তারা জগতের সব দেশের দূতাবাস রেখেছে রাজধানী নয়াদিল্লিতে। ভারত ও ইসরাইল হলো গুপ্ত ভায়রা-ভাই। জগদ্বাসীকে কী ধরনের উজবুক মনে করে ভারত! মধ্যপ্রাচ্যে তেলের সুবিধা দুই হাতে লুটে নেয় এবং জনশক্তি জোগান দিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাই করে ও পণ্য রফতানি করে, আবার গোপন অভিসারে প্রেম করে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে। এহেন অবিশ্বস্ত, খল, শঠতায় ভরা চানক্যবাদী ভারতের কাছে কিভাবে নিরাপদ থাকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল? ভুটানের কথা বলি না, এজন্য যে, ভারতের চানক্যরা ইতোমধ্যেই ভুটানকে ক্রাইমিয়া বানিয়ে ফেলেছে। ভারত যেটা অনুসরণ করছে সেটাই পণ্ডিত জন মার্শিমার (John Mearscheimer) তার The Tragedy of Great Politics বইতে কী চমৎকারভাবে নব্য আগ্রাসনবাদী বড় রাষ্ট্রগুলোর অনুসৃত ত্রিমুখী আধিপত্যবাদের স্বরূপ প্রকাশ করে বলেছেন, No. 1 : The anarchy prevalent in the international political system; 2. The doubt in ascertaining the intentions of other neighborly states. ভারত ঠিক এটাই করছে উপমহাদেশে তার ছোট ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে। তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিগুরু চানক্য বলে গেছেন : ‘আন্তঃসীমান্ত সম্পর্কে কোথাও কোনো স্থায়ী মৈত্রী বা স্থায়ী বৈরিতা বলে কিছু নেই, এমনকি স্থায়ী সীমান্ত বলতেও কিছু নেই। চানক্যের মতে : There are only permanent interests and everything should be done to secure these interests. ভারত ঠিক সেটাই করেছে শ্রীলঙ্কা ও বার্মায় জাতিগত সঙ্ঘাতে, বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত স্বৈরাচারী একনায়ককে সর্ব প্রকার মদদ দিয়ে, নেপালের ভূবেষ্টিত অসহায়ত্বের ভৌগোলিক সুযোগ নিয়ে, মালদ্বীপে নব্য উপনিবেশ সৃষ্টির অভিসন্ধি নিয়ে এবং ভুটানকে কার্যত সিকিমের মতো আস্ত গিলে ফেলে।
১৯৮৯-৯০ এবং ২০১৫-১৬ তে দুই দুইবার ভারত নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ করে। ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার আমেরিকা মনে করে এক ধরনের আত্মতুষ্টি লাভ করে থাকে। আমেরিকা যেমন রাশিয়া, ইরানের ওপর অবরোধ দেয়, তারাও সেটা ‘রেপ্লিকেট’ করার কোশেশ করে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশের ওপর। অথচ এই প্রতিবেশীদের জন্যই টিকে আছে ভারতের অর্থনীতি। ভারতীয় আহম্মক গাড়ল শাসকরা কি জানে না, রাশিয়া বা ইরান আমেরিকার বাজার নয়। তারা নিজেরাই একটা জগৎ। চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা, মধ্য-এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মিলিত অর্থনীতি আমেরিকার চেয়েও বড় এবং শক্তিশালী! পার্থক্য হলো ওদের ‘ন্যাটো’ ক্লাব আছে। আমাদের সেটা নেই। কিন্তু হতে কতক্ষণ? দেখবেন, জগতে সে ধরনের দ্বিতীয় মহাতরঙ্গ জাগলে তখন এই আগ্রাসী ভারত উড়ে এসে জুড়ে বসে বেহায়ার মতো বলবে : ‘মনে রেখো আমিও ছিলাম’ কিংবা ‘ভেঙেছি না হয় কলসির কানা নেশার ঘোরে/তা’ বলে কি প্রেম দেবে না।’ এরকমই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল এক দিন ইহুদি-ফিরিঙ্গি শয্যাসঙ্গী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু এবং তার আগ্রাসী ভারত!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক



