পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন : সুবিধা-অসুবিধা

আইনসভার নিম্নকক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে কি না, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন।

পিআর পদ্ধতি (প্রোপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) অর্থাৎ- সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে নির্বাচন নিয়ে দেশে এখন বেশ তর্ক-বিতর্ক চলছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সবচেয়ে সুবিধাজনক দিক হলো- এতে প্রকৃতপক্ষে বেশির ভাগ নাগরিকের প্রতিনিধিত্বশীল একটি পার্লামেন্ট গঠিত হতে পারে। যেসব উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেশি এবং জনগণ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সেখানে সব মত ও পথের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পিআর পদ্ধতি একটি কার্যকর ব্যবস্থা। সংখ্যালঘু দলগুলোও এতে পার্লামেন্টে গুরুত্ব পায়; এমনকি সরকার গঠনে নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন প্রার্থী নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে যিনি অপেক্ষাকৃত বেশি ভোট পান তিনি জয়লাভ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেয়েও জয়লাভ করতে পারেন। একইভাবে বিজয়ী দলও মোট ভোটারের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেয়েও সরকার গঠন করতে পারে। ফলে দলটি সংখ্যালঘুদের ভোট পেয়ে বিজয়ী হতে পারে। বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার বিভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়ায় পরাজিত হয়। যেমন- ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট, ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ৪৮ দশমিক .০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করেছিল। পরবর্তী ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের ভোটের কথা উল্লেখ না করা ভালো; কারণ সবারই জানা। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন ছাড়া একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার গঠন করতে পারে। ফলে পার্লামেন্টে পরাজিত এবং ছোট দলগুলোর প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব ঘটে না। এরূপ বাস্তবতায় সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হোক। লক্ষণীয়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন যেসব প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তার মধ্যে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো সুপারিশ নেই। আবার পরবর্তীতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যেসব বিষয়ে আলোচনা করছে; তার মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন ও উচ্চকক্ষ সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠনের বিষয় আলোচনা হলেও নিম্নকক্ষ প্রচলিত পদ্ধতিতে রাখার ব্যবস্থা রয়ে গেছে।

জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো বড় দল ছাড়াও ছোট অনেক দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি সংবিধান সংশোধনের সাথে জড়িত। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মাধ্যমে গঠিত সংসদ জুলাই জাতীয় সনদের বিষয়গুলোর আলোকে সংবিধান সংশোধন করার পর তার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। যেহেতু জুলাই জাতীয় সনদে উচ্চকক্ষ গঠন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করার বিধান রাখা হয়েছে, সেহেতু সংসদ চাইলে উচ্চকক্ষ সেভাবে গঠন করতে পারবে। কিন্তু বর্তমান সংবিধান বা জুলাই জাতীয় সনদে নিম্নকক্ষ সম্পর্কে কোনো কথা নেই বিধায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতে হবে বলে ধরে নেয়া যায়। অবশ্য পিআর পদ্ধতির পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো যদি আন্দোলন বা নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে পারে, তাহলে ভিন্ন কথা।

পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের পক্ষে কতটা যৌক্তিক তা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। পিআর পদ্ধতি মূলত চার প্রকারের- ক. তালিকাভিত্তিক পিআর যা স্পেন, ব্রাজিল, ফিনল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা অনুসরণ করে থাকে। খ. মিশ্র সদস্যভিত্তিক পিআর যা জার্মানি ও নিউজিল্যান্ড অনুসরণ করে থাকে। গ. একক হস্তান্তরিত ভোটের পিআর, যা আয়ারল্যান্ড ও মাল্টা অনুসরণ করে থাকে। সমান্তরাল পদ্ধতির পিআর, যা জাপান ও রাশিয়া অনুসরণ করে। বিশ্বের ৮১টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। প্রধানত সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চলে আসছে। এর মধ্যে মাত্র ১০টি দেশ মিশ্র সদস্যভিত্তিক পিআর অনুসরণ করে। বাকি ৭১টি দেশ তালিকাভিত্তিক পিআর মেনে চলে। যেহেতু অধিকাংশ তালিকাভিত্তিক পিআর অনুযায়ী নির্বাচন করে সেহেতু আমরা সেই পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। এ পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিজ নিজ প্রার্থীর তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করে। সেই সাথে নির্বাচনী মেনিফেস্টো ভোটারদের সামনে তুলে ধরে। ভোটাররা নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীকে নয়; বরং পছন্দের দলকে ভোট দেন। ভোট গণনা শেষে যে দল যত ভাগ ভোট পায়, সে দল তত ভাগ আসন পায়। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সদস্য নির্বাচিত বলে গণ্য করা হয়। ধরা যাক, কমপক্ষে ১ শতাংশ ভোট যে দল পাবে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে তিনটি আসন পাবে। যারা ১০ শতাংশ ভোট পাবে ৩০টি আসন পাবে। যারা ৪০ শতাংশ ভোট পাবে ১২০টি আসন পাবে। বাস্তবে কোনো দলের পক্ষে ৫০ শতাংশ বা এর বেশি ভোট পাওয়া দুষ্কর। অভিজ্ঞতা তাই বলে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ৪০ শতাংশ ভোটপ্রাপ্ত দলটি সরকার গঠন করতে পারলেও পিআর পদ্ধতিতে সরকার গঠন করতে পারবে না। তখন অন্য ছোট দলগুলোর সাথে কোয়ালিশন করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। এ জন্য বলা হয়ে থাকে, পিআর পদ্ধতি মানে কোয়ালিশন সরকার। কোয়ালিশন সরকারের অভিজ্ঞতা অনেক দেশে সুখকর নয় বলে যুক্তি দেখানো হয়। প্রধান যুক্তি, সরকার স্থিতিশীল হতে পারে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও দুর্বল অবস্থায় থাকে। সাম্প্রতিককালের নেপাল ও ইসরাইলের উদাহরণ দেয়া হয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করেও যেসব স্থিতিশীল সরকার কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করছে সেরূপ উদাহরণও রয়েছে, যেমন- জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্র্রিয়া, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া। ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলেও তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ। সুতরাং খারাপ দৃষ্টান্তের পাশাপাশি ভালো দৃষ্টান্তও রয়েছে। আবার এটিও তো সত্য, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কোয়ালিশন সরকার না হলেও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারও পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল। আবার ২০০৮ সালে ১৪ দলীয় জোট সরকার একাধারে সাড়ে ১৫ বছর শুধু ক্ষমতায় থাকা নয়, জোটবদ্ধভাবে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়েছিল।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতিতে যেব সুবিধা রয়েছে তা হচ্ছে :

১. অসংখ্য রাজনৈতিক দলের এ দেশে বহু মত-পথ থেকে ভোটারদের কাছে যাওয়া হয়। অতীতের নির্বাচনগুলোতে আট-দশটির বেশি দল সংসদে যেতে পারেনি। হয়তো কোনো দল ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে কিন্তু আসন একটিও পায়নি। কিন্তু পিআর পদ্ধতি হলে ৯টি আসন পেতে পারত। সুতরাং পিআর পদ্ধতি ছোট দলগুলোর সংসদে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। লক্ষণীয়, কোনো কোনো ছোট দলে বড় মাপের দু’-একজন নেতা দেখা যায়। পিআর পদ্ধতি হলে ছোট ছোট দলের একাধিক নেতা সংসদে স্থান পাবেন। তাতে সংসদে জনপ্রতিনিধিত্ব যেমন বাড়বে, তেমনি সংসদে মানসম্মত নেতারা যেতে পারবেন।

২. বর্তমান পদ্ধতিতে একটি আসনে যদি পাঁচজন প্রার্থী থাকেন, তার মধ্যে একজন ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েও বিজয়ী হতে পারেন। তার মানে তিনি ৭৫ শতাংশ ভোটারের সমর্থন ছাড়া নির্বাচিত হয়েছেন। পিআর পদ্ধতি এ দিক থেকে অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল।

৩. বর্তমান পদ্ধতিতে প্রার্থীরা যেকোনো আঞ্চলিক ইস্যুতে আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে বা কালো টাকা ব্যবহার করে সুইং ভোটারদের মন জয় করতে পারেন। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ কোনো প্রার্থী থাকেন না বিধায় বিশেষ কোনো ইস্যু নিয়ে জোয়ার সৃষ্টি করার সুযোগ পাবেন না। ভোটারদের নিজ নিজ দলের এবং জাতীয় বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

৪. বর্তমানে দেশের সংসদ সদস্যরা এলাকার বিচার সালিস থেকে শুরু করে ছোটখাটো উন্নয়নমূলক কাজেও হস্তক্ষেপ করে থাকেন। তারা বিভিন্ন কাজে মন্ত্রণালয়ে তদবির কাজে ব্যস্ত থাকেন। অথচ তাদের প্রধান কাজ দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করা। আইন প্রণয়নে যথেষ্ট পড়াশোনা ও যোগ্যতা থাকতে হয়। পিআর পদ্ধতিতে কোনো সংসদ সদস্য যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো এলাকার প্রতিনিধিত্ব করবেন না, সেহেতু তারা আইন প্রণয়নে অধিকতর সময় ব্যয় করতে পারবেন। এতে করে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করতে স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা বা জেলা পরিষদ অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠতে পারবে।

৫. আমাদের সংস্কৃতিতে যার ভোটে প্রার্থী জিততে পারেন না তার ভোট মূল্যহীন গণ্য করা হয়। পিআর পদ্ধতিতে কোনো দল কমপক্ষে ১ শতাংশ ভোট পেলেও দলটি সংসদে তিনটি আসন পাবে। ফলে ছোট ছোট দলকে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের ভোটটি নষ্ট হয় না বলে বিবেচনা করা হয়।

৬. বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচনী এলাকার কয়েকজন প্রার্থী থাকলে একজন ন্যায়নিষ্ঠ ভোটার তাদের কাউকে পছন্দ নাও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো ‘না’ ভোট দিতে পারবেন, কারণ তার কাছে আর কোনো অপশন থাকে না। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে একটি দলের অনেক প্রার্থীর কারণে তিনি কোনো একটি দলকে বেছে নিতে পারেন। অর্থাৎ- তার ভোট দেয়ার জন্য বৃহত্তর অপশন থাকে।

৭. বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন প্রার্থী জয়লাভে মরিয়া হয়ে উঠেন এবং বিশাল বাজেট (যা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না), পেশিশক্তি দিয়ে ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটকেন্দ্র দখল, অনৈতিক আচরণ ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিন্তু পিআর পদ্ধতি হলে যেহেতু ব্যক্তি মুখ্য থাকে না, সেহেতু তিনি দলের হয়ে ততটা মরণপণ করবেন না। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

৮. বিদ্যমান দু-একটি দল প্রভাবশালী হওয়ায় নির্বাচনকালে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু পিআর পদ্ধতি হলে ছোট-বড় সব দল সমান সুবিধা পাবে।

৯. বিদ্যমান ব্যবস্থায় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি দলীয় মনোনয়ন লাভে অর্থ ব্যয় করেন (অনেক দলের ক্ষেত্রে এটি সত্য)। কিন্তু পিআর পদ্ধতি হলে অর্থ ব্যয়ে মনোনয়ন লাভের আগ্রহ কমে যেতে পারে।

১০. অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন, পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলের পক্ষে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়া সম্ভব হয় না বিধায় কোয়ালিশনের বিকল্প থাকে না; ফলে সরকার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিষয়টি ইতিবাচকভাবেও দেখা যেতে পারে। সেটি হচ্ছে- কোয়ালিশন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের সুযোগ করে দিতে পারে। একটি দেশের সব মত-পথকে সমান মর্যাদা দিতে হবে।

১১. বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোনো একটি জেলা বা উপজেলার দোহাই দিয়ে আঞ্চলিকতার সুর তুলে ভোটারদের মন জয় করা যেতে পারে। যেমন- রংপুরের ভোটাররা একসময়ে জেনারেল এরশাদকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু তার দল অন্য জেলায় ভালো ভোট পেত না। আবার কোনো দল গোপালগঞ্জের বা পার্বত্য চট্টগ্রামের দোহাই দিয়ে কয়েকজন প্রার্থী জিতিয়ে আনতে পারে। পিআর পদ্ধতি হলে সেটি সম্ভব হবে না। জার্মানিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত একাধারে ৫০ বছরের মধ্যে আট বছর ছাড়া ফ্রি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় ছিল, যদিও কখনো ১২ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি।

পিআর পদ্ধতির অসুবিধাগুলো কী কী

১. পিআর পদ্ধতির অসুবিধাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে কোয়ালিশন সরকারের স্থিতিশীলতা থাকে না। সে জন্য সরকার কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন এত বেশি যে, কোয়ালিশন সরকারের কতটা স্থিতিশীল থাকবে তা বলা কঠিন। যদিও নির্বাচনী জোট গঠনের সুখকর উদাহরণ একাধিক রয়েছে।

২. পিআর পদ্ধতি যদিও ছোট দলগুলোকে সুবিধা দেয় কিন্তু কোনো উগ্রবাদী দল যদি সরকার গঠনে অপরিহার্য হয়ে উঠে সে ক্ষেত্রে বেশি ভোট পাওয়া দলটির জন্য বিপদ হয়ে যেতে পারে। উগ্রবাদীদের চাপে সরকার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে সরকার বাধ্য হতে পারে।

৩. পিআর পদ্ধতি যদিও কোয়ালিশন সরকারের প্রবণতা নিশ্চিত করে, সমধর্মী পার্টিগুলো যদি একত্র হয়ে সরকার গঠন করে, সে ক্ষেত্রে ক্ষমতা আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে।

৪. পিআর পদ্ধতি ছোট দলগুলোকে আরো সুবিধা দেয়, এরা সরকার গঠনে অপরিহার্য শক্তি হয়ে উঠতে পারে। ফলে নির্বাচকমণ্ডলীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দেশের বৃহত্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অনুঘটকের কাজ করতে পারে।

৫. বিদ্যমান পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচিত সদস্য যদি কোনো ভুলত্রুটি করেন বা জনগণের চাহিদা/দাবি পূরণে ব্যর্থ হন, তাহলে ভোটাররা পরবর্তী নির্বাচনে আর ভোট দেবেন না। কিন্তু পিআর পদ্ধতির একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, প্রার্থী কোনো বিশেষ এলাকার না হওয়ায় ব্যর্থ সংসদ সদস্যের প্রতি অনাস্থা দেয়ার সুযোগ থাকে না। কারণ তিনি ব্যক্তি হিসেবে নন, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচিত হন।

৬. ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট হয়ে আসছে। পিআর পদ্ধতি কারো কাছে বেশ জটিল মনে হতে পারে। এ জন্য ভোটার এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আইনসভার নিম্নকক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে কি না, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী জনমানসে রাষ্ট্র সংস্কারের বহু বিষয় ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঐকমত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু নিম্নকক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে কি না, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য হয়নি। যারা এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তাদের যেমন যুক্তি আছে, যারা তা সমর্থন করেন না তাদেরও যুক্তি কম নয়। দেশের জন্য কোনটি ভালো হবে তা জোর দিয়ে বলা যায় না। বিষয়টি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে। কোনো পক্ষের দলীয় কারণে শক্ত অবস্থান কাম্য নয়; বরং জাতীয় স্বার্থে যেটি অধিকতর কল্যাণকর হবে, সেটি বেছে নেয়া হবে ন্যায়সঙ্গত।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব