একটি কালো আইন, অসংখ্য পরিবারের আর্তনাদ!

আমরা বিশ্বাস করি, প্রধান উপদেষ্টা, যিনি একজন প্রবীণ, বিচক্ষণ এবং মানবিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি নিশ্চয় এ চরম অসঙ্গতি ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার গভীরতা অনুধাবন করবেন। আমরা তাকে এ মুহূর্তে ইতিহাসের দিক পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানাই। এখনই সময়, আর অপেক্ষা নয়। এই আইন বাতিল করুন। আমাদের প্রশাসনকে মুক্ত করুন পরাধীনতার সেই অদৃশ্য শৃঙ্খল থেকে। আমাদের সশস্ত্রবাহিনীকে মুক্ত করুন সেই ভয় ও নিপীড়নের সংস্কৃতি থেকে। আমাদের রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিন তার মানবিক মুখ। কারণ যে রাষ্ট্র নিজের সেবকদের ন্যায্যতা দিতে পারে না, সে কখনো জনগণের অধিকার রক্ষা করতে পারে না।

নির্বাক এক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে আজও আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ- যেখানে স্বাধীনতার এত বছর পরও একটি নিবর্তনমূলক ঔপনিবেশিক আইন আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। এই আইন, যা বলে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই, কোনো কারণ না দেখিয়ে, একজন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য বা বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো যাবে- এটি কেবল একটি আইন নয়, এটি একটি অন্যায়, একটি মানবিক বিপর্যয়, একটি মৌলিক অধিকার চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া রাষ্ট্রীয় বৈধতা।

একজন দেশপ্রেমিক অফিসার- যিনি জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় দেশের পতাকা, সংবিধান ও জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে উৎসর্গ করেছেন, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়টি হঠাৎ এক অন্ধকার চিঠিতে থেমে যায়। একটি ঠাণ্ডা, রোবোটিক আদেশে বলা হয়- ‘আপনার সেবা রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই, আপনি এখন অবসরে’। যেন তিনি কোনো মানুষ নন, একটি মেশিন, যার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে।

না কোনো কারণ বলা হয়, না কোনো অভিযোগের সুযোগ দেয়া হয়, না তাকে শোনা হয়। একটি মাত্র ফাইলে, একটি মাত্র ছকে তার তিন দশকের জীবনসংগ্রাম শেষ হয়ে যায়। যার হাতে অস্ত্র ছিল দেশকে রক্ষা করতে, যার হাতে কলম ছিল নীতির পাহারাদার হিসেবে, তার হাতে তখন পড়ে কেবল একটি পত্র- অবসরের আদেশপত্র।

তিনি হতবাক হয়ে বসে থাকেন- প্রথমে স্তব্ধতায়, পরে ঘোরে। বিশ্বাস করতে পারেন না। ‘কী ছিল আমার অপরাধ?’- প্রশ্নটি তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তার চার পাশে কেউ নেই উত্তর দেয়ার। সহকর্মীরা মুখ ঘুরিয়ে নেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গলা নামিয়ে বলেন, ‘উপরে থেকে হয়েছে, আমরা কিছু করতে পারি না’। বাহিনী তার পিঠ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। রাষ্ট্র তার স্মৃতি থেকে নাম মুছে ফেলে।

অথচ সেই মানুষটি হয়তো অপারেশন ডিউটিতে দিন-রাত পাহাড়ে ছিলেন, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে জীবন বাজি রেখেছিলেন। কিংবা বেসামরিক প্রশাসনে ছিলেন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অবিচল, কোনো মন্ত্রীর ফোনের তোয়াক্কা না করে সৎ থেকে গেছেন। হয়তো সেই কারণে তার অনুগত না হওয়ার অপরাধে কেউ ‘সিস্টেম’ ব্যবহার করে তাকে সরিয়ে দিয়েছেন- কারণ দেখানো ছাড়া।

তার ছোট সন্তানটি স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে দেখে প্রশ্ন করে, ‘বাবা, তুমি কি এখন আর অফিসে যাবে না’?

স্ত্রী হয়তো রান্নাঘরে চোখ মুছছেন, যাতে স্বামী না দেখে ফেলে সেই আতঙ্ক। বৃদ্ধ বাবা-মা অসহায়ের মতো ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কারণ তাদের ওষুধের জন্য আর সরকারি ভাতা আসবে না।

এই পরিবার রাতের বেলা আলো নিভিয়ে বসে থাকে- ভবিষ্যতের ভয় আর লজ্জার অন্ধকারে।

আর এই অফিসার? তিনি রাতভর ঘুমাতে পারেন না। বারবার তার চোখে ভাসে সেই সকাল, সেই চিঠি, সেই জীবনের হঠাৎ ঝাপটাটি। আরো কষ্ট হয় তখন, যখন তিনি দেখেন- অপরাধ করেও কেউ বহাল তবিয়তে আছেন। কেউ দুর্নীতির পাহাড় গড়েও প্রমোশন পান, আর তিনি? তিনি কোনো কারণ ছাড়া আজ পরিত্যক্ত, অনাহূত, অপ্রয়োজনীয়!

এটিই কি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপ? এটিই কি একজন সেনা, একজন কর্মকর্তা, একজন দেশপ্রেমিকের প্রাপ্য? না, এ অবিচার শুধু এক ব্যক্তির নয়- এটি আমাদের রাষ্ট্রের মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও আত্মমর্যাদার লাঞ্ছনা। এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন- কোনো দেশে কি এভাবে কাউকে ফেলে দেয়া যায়? এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে হবে। এ অন্যায়ে চুপ থাকা মানে, আগামীকাল আরেকজন এমনই হবে, আরেকটি পরিবার নিঃস্ব হবে। মানবতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ন্যায়বিচার জাগাতে হবে। এ অন্ধ অবসরনীতির- এই নির্বিচার শাস্তির, এই নির্লজ্জ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের এখনই অবসান ঘটাতে হবে।

একজন অফিসারের সম্মান শুধু তার ব্যাজে বা ইউনিফর্মে নয়- তা তার ত্যাগে, তার সততায়, তার নীরব দায়িত্ববোধে এবং রাষ্ট্রেরও সম্মান নির্ভর করে, সে তার মানুষকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন, কেমন আচরণ করেন তাদের বিদায়ের সময়। সেই মূল্যায়নের সময় এখন।

এই প্রথার পেছনে রয়েছে ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্ট-এর ১৮ নম্বর ধারা, যার আওতায় কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় যেকোনো সদস্যকে ‘নিয়ম অনুযায়ী’ অবসরে পাঠাতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এ নিয়ম প্রয়োগ হয় যখন উপরের কোনো ক্ষমতাবান চোখ রাঙান, অথবা কেউ ‘অনুগত’ নয় বলে চিহ্নিত হন। আর বেসামরিক প্রশাসনে তো ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ ধারা আরো ভয়াবহ। বলা হয়- ২৫ বছর পূর্ণ করলে সরকার জনস্বার্থে যে কাউকে অবসরে পাঠাতে পারবে। ‘জনস্বার্থ’- শব্দটি দিয়ে যা খুশি বোঝানো যায়। এর আড়ালে কত নির্দোষ, কত নিষ্ঠাবান, কত জীবন চূর্ণ হয়ে গেছে- তা কেউ জানেন না, জানতেও চান না।

আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এ আইন ব্যবহার হয়েছে। দেখেছি, একজন অফিসার শুধু নিরপেক্ষ মতামত দেয়ায় অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন। আমরা দেখেছি, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্থানীয় এমপির অপছন্দে হঠাৎ করে চাকরি হারিয়েছেন। এ অন্যায় ব্যবস্থার শিকার হয়ে অনেকে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন- বিনাবেতনে, বিনাস্বীকৃতিতে, বিনাপরিচয়ে।

আরো বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো- এসব মানুষের পাশে দাঁড়ান না কেউ। বাহিনী তাদের ‘প্রাক্তন’ বলে দূরে সরিয়ে দেয়। প্রশাসন কাগজপত্রে ‘নিষ্পত্তি’ দেখিয়ে ভুলে যায়। রাষ্ট্র দায় নিতে চায় না। সংবাদমাধ্যমেও থাকে না কোনো প্রতিবেদন। যেন তারা কখনো ছিলেন না। তাদের যন্ত্রণার সাক্ষী থাকে কেবল পরিবারের চোখের পানি, সন্তানদের হাহাকার এবং ঘরের নিস্তব্ধতা।

আমরা চাই না কেউ ক্ষমতার অপব্যবহারে পদদলিত হোন। আমরা চাই না একজন মানুষের আত্মমর্যাদা এভাবে অশ্রদ্ধা পাক। আমরা চাই, দেশের জন্য যিনি তার সময় বিনিয়োগ করেছেন, তাকে যেন অবসরের আগে অন্তত জানানো হয়- কেন তাকে অসসরে দেয়া হচ্ছে?

আমরা সরকারকে, প্রধান উপদেষ্টাকে, সংবিধান রক্ষাকারী সর্বোচ্চ মহলকে এবং সংশ্লিষ্ট সব নীতিনির্ধারককে সবার আগে আমাদের জাতীয় বিবেককে- এ মুহূর্তে আন্তরিকভাবে আহ্বান জানাই- এ আইন এখনই বাতিল করুন। এ নিপীড়ন আর চলতে দেয়া যায় না। এ যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিষবৃক্ষ, যা এখনো আমাদের প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামোর মজ্জায় মজ্জায় গেঁথে আছে, তাকে উপড়ে ফেলুন। এ শুধু একটি আইন নয়- এ এক গভীর মানসিক বঞ্চনা, যা আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্মবিশ্বাস, মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত।

একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মুখে এ আইন এক নির্মম কলঙ্ক তিলক। এ যেন বলছে, ‘আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি; কিন্তু মন থেকে এখনো স্বাধীন হতে পারিনি।’ কোনো বিচার ছাড়া, ব্যাখ্যা ছাড়া, একজন দেশসেবককে রাষ্ট্র যদি এভাবে সরিয়ে দেয়- তাহলে ওই রাষ্ট্র কি আদৌ ন্যায়নিষ্ঠ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবি রাখতে পারে?

আমরা মনে করি, একটি দেশের নৈতিক ভিত্তি সবচেয়ে ভালোভাবে প্রতিফলিত হয়, রাষ্ট্রটি নিজের নাগরিকদের কিভাবে সম্মান দেয়, কিভাবে বিদায় জানায়। একজন দীর্ঘ দিনের সেবককে যদি ব্যাখ্যা ছাড়া, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া শুধু ‘জনস্বার্থে’ বা ‘ঊর্ধ্বতন নির্দেশে’ চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া যায়, তাহলে সেটি কোনো গণতান্ত্রিক সমাজ নয়- তা নিছক এক আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ।

আমরা এমন প্রশাসন চাই না, যেখানে আদর্শবান হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা এমন বাহিনী চাই না, যেখানে নীরব নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের মূল্য নেই। এ মুহূর্তে সময় এসেছে- আমাদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধির। এ কালো আইন শুধু বাতিল নয়; এর অপপ্রয়োগে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জন্য পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া হোক। তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেয়া হোক। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এ অন্যায়ের শিকার না হন- তার নিশ্চয়তা দেয়া হোক।

আমরা বিশ্বাস করি, প্রধান উপদেষ্টা, যিনি একজন প্রবীণ, বিচক্ষণ এবং মানবিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি নিশ্চয় এ চরম অসঙ্গতি ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার গভীরতা অনুধাবন করবেন। আমরা তাকে এ মুহূর্তে ইতিহাসের দিক পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানাই। এখনই সময়, আর অপেক্ষা নয়। এই আইন বাতিল করুন। আমাদের প্রশাসনকে মুক্ত করুন পরাধীনতার সেই অদৃশ্য শৃঙ্খল থেকে। আমাদের সশস্ত্রবাহিনীকে মুক্ত করুন সেই ভয় ও নিপীড়নের সংস্কৃতি থেকে। আমাদের রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিন তার মানবিক মুখ। কারণ যে রাষ্ট্র নিজের সেবকদের ন্যায্যতা দিতে পারে না, সে কখনো জনগণের অধিকার রক্ষা করতে পারে না।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক