নির্বাচনই কী সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র উপায়

সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের পথে হাঁটা উচিত সরকারের, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত হবে। তৈরি হবে একটি ভিন্ন আবহ, যা স্বস্তি দেবে রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সব খাতে।

‘দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই’-এ ধরনের ন্যারেটেভি তৈরির বিরুদ্ধে ক্রমে সোচ্চার হচ্ছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। কিছুদিন আগেও সরকারের বিরুদ্ধে কিছু ব্যর্থতার অভিযোগ আনা দলগুলোর মধ্যে হালে কথায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কিছু ঘটনা ও নমুনায় নির্বাচনকে এক নম্বর দাবিতে নিয়ে আসার চেষ্টা লক্ষণীয়। নির্বাচন বিলম্বিত করতে ‘দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার ভাষায়- নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে যেতে হবে, সেটিই এ টু জেড ডেমোক্র্যাসি। এমন মতামতে সমমনাদেরও সায় মিলছে। তারাও বলছে, নির্বাচনই বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র উপায়। রাজনীতির বাইরের অনেকেও বলতে শুরু করেছেন, বিদ্যমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নির্বাচিত সরকার ছাড়া সামাল দেয়া সম্ভব নয়। নির্বাচন যত দেরি হবে অঘটন ও সঙ্কট তত বাড়বে। সংস্কার চলমান রেখে নির্বাচনকে লক্ষ্য করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বলা হচ্ছে, সরকার আন্তরিক হলে আগামী ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। আর সংস্কার কার্যকর করবে নির্বাচিত সরকার। যা আগে ঠিক করে রাখবে এই নিয়ে কাজ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে আসছে প্রায় শুরু থেকে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংস্কার ও নির্বাচনকে মুখোমুখি না করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন প্রায়ই। এর মধ্যে কোনো ‘যদি-কিন্তু-তবে’-দেখতে চায় না বিএনপি।

গণতন্ত্রের জন্য এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার প্রতিবাদে সৃষ্ট গণউপেক্ষার পটভূমিতে হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীন দেশেও নির্বাচনের নামে তামাশা চলেছে। স্বাধীন দেশে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। সেখানে ২৭৩ আসন কেড়ে নেয়ার পরও আওয়ামী লীগের মন ভরেনি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে এর সাথে আরো তামাশা যোগ করেছে দলটি। নির্বাচনের আগে নির্বাচিত হয়ে যাওয়া, দিনের ভোট আগের রাতে এবং সর্বশেষ আমি-ডামির মশকরায় মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে। এ অপকর্মে তাদের সরাসরি মদদ জুগিয়েছে ভারত। যার অনিবার্য পরিণতি চব্বিশের ৫ আগস্ট নজরিবিহীন গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন। তারা ভারতে পলায়ন।

গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সঙ্গত কারণে মূল আকাক্সক্ষা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বর্তেছে। জুলাই-আগস্টে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার। এ দু’টি কাজ দীর্ঘমেয়াদি বা সময়সাপেক্ষে। নির্বাচন সম্পন্ন করা তত সময়সাপেক্ষ নয়। এমন যুক্তি ও অভিমতে একমত নয় কোনো কোনো দল। তাদের বক্তব্য, বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে না।

তারা না জেনে না বুঝে এসব করছেন তা কিন্তু নয়। এসব দলও জানে, গেল আমলে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। বিনাভোটের নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না। যাদের বয়স এখন অন্তত ৩২ বছর তাদের কেউ জীবনে ভোট দিতে পারেননি। ভোটারদের মধ্যে তাদের সংখ্যা বিপুল। তারা প্রথম ভোটদানের জন্য উন্মুখ। এমতাবস্থায়, সব দিক বিচার বিশ্লেষণে দ্রুত নির্বাচন হওয়া জরুরি ও অত্যাবশ্যক বলে মনে করছেন বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বিএনপিও দেশের সার্বিক অবস্থা ও মানুষের অভিপ্রায় বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। নির্বাচন দ্রুত বা বিলম্ব যখন হোক, বৃহত্তম দল হিসেবে নির্বাচনে বিএনপি জিতবে ও সরকার গঠন করবে, এমন ধারণা দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রবল।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত লন্ডন বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি সময়সীমা নির্দিষ্ট করেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে তার প্রেস উইং আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্নের নির্দেশনার কথা জানিয়েছেন। এরপর আর বিপত্তি থাকার কথা নয়। বাস্তবে বিপত্তি পিছু ছাড়ছে না। আগে বিচার-সংস্কার, পরে নির্বাচন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতে ভোটের হিসাব, উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষসহ নানা ফ্যারকা সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। আর এ ফ্যারকায় নির্বাচন পেছানো এসবের উদ্দেশ্য বলে অনেকের সন্দেহ।

অর্থনীতি এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মহলেও এ নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে। কয়েক বছর ধরে চাপে রয়েছে অর্থনীতি। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনার পালানো ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা এলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে কাক্সিক্ষত গতি আসেনি; বরং দেখা যাচ্ছে ধীরগতি। নতুন বিনিয়োগের কথা বলা হলেও কার্যত নতুন বিনিয়োগ বন্ধ, পুরনো বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতা দেশের অর্থনৈতিক গতি শ্লথ করছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। তাদের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলাও খুব একটা ভালো নেই।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা আদায়ের দাবিতে আন্দোলন-হামলার ঘটনায় কিছু পোশাক কারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। উৎপাদনশীল খাতে যুক্ত শ্রমিকদের একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছেন। চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও সাইবার হুমকিতে বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এসবের অন্যতম কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।

শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের পর বছর পূর্ণ হতে চললেও অর্থনীতির গতি তেমন একটা ফেরেনি। বিদেশীরা নতুন বিনিয়োগ করছেন না। বিনিয়োগ সম্মেলন করা হলেও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য থেকে জানা যায়- বিদেশীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না তারা। নির্বাচিত সরকার এলে তারা নতুন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন। মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর্মসংস্থান সঙ্কট, রফতানি হ্রাস এবং রাজস্ব ঘাটতিতে অর্থনীতি এখনো নানা অনিশ্চয়তায় ঘেরা। এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ভারতের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা রফতানির ওপর চাপ তৈরি করেছে।

গত ১০-১১ মাসে অনেক খাতে ব্যবসায়-বাণিজ্যে অস্থিরতা। বিনিয়োগে স্থবিরতা। নিত্যপণ্যের বাজার এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আসেনি। কর্মসংস্থানে নতুন বেকার তৈরি হয়েছে অনেক মিলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। ফলে প্রায়ই নানা দাবি-দাওয়া ও ইস্যুতে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। সব কিছুতে যেন একটা অগোছালো ভাব পরিলক্ষিত। এমনকি বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ রেটিংয়ের মূল্যায়নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পূর্বাভাস নেতিবাচক হিসেবে বহাল থাকছে। একই সাথে বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী আরো দুই বড় প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল এবং মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিসও বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছে। তাই জাতীয় নির্বাচনকে বহুমুখী এসব সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ বলছেন অর্থনীতিবিদসহ ব্যবসায়-বাণিজ্য জগতের সংশ্লিষ্টরাও। অভিজ্ঞতার আলোকে তারা বলছেন, রাজনৈতিক সরকার ছাড়া দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না, বিনিয়োগ আসবে না।

যারা বিনিয়োগ করে রেখেছেন, তারাও বিপাকে আছেন। তাদের জন্য যে ন্যূনতম সহায়তা থাকা দরকার, তা সরকারের তরফ থেকে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ইউটিলিটি ফ্যাসিলিটিতে ঘাটতি। উদ্যোক্তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাচ্ছেন না, রফতানি ও উৎপাদনে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানিতেও দেখা দিচ্ছে জটিলতা। যা কার্যত আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশের অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, দ্রুত নির্বাচনে তা অনেকটা কাটতে পারে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সুশীলসমাজের নেতাদেরও বক্তব্য- রাজনৈতিক সরকার ছাড়া দেশে কাক্সিক্ষত স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ আসবে না। কারণ সবাই মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার আজ আছে-কাল নেই। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের মূল দায়িত্ব সংস্কার করা। বিগত রেজিমের যারা অপরাধী তাদের বিচার করা। সেই সাথে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করে রাজনৈতিক সরকারের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটি করা না হলে, সেই আগের অবস্থাতে দেশ ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে যে উপদেষ্টারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। অথচ উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনও হচ্ছে না। বর্তমান উপদেষ্টাদের বেশির ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। মনে রাখতে হবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চালানো আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক জিনিস নয়। এ দিকে অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের মানুষের মধ্যে পাহাড়সম প্রত্যাশার জন্ম নিয়েছে। সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা প্রয়োজনীয় সংস্কার, বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনার অলিগার্কদের বিচার করা এবং দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, তিনি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চান।

সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, জরুরি ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের পথে হাঁটা উচিত সরকারের, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত হবে। তৈরি হবে একটি ভিন্ন আবহ, যা স্বস্তি দেবে রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সব খাতে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট