বাংলাদেশের সামনে আজ যে মৌলিক সঙ্কট, তা কেবল অর্থনৈতিক নয়; এটি প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও নৈতিক চেতনার এক গভীর ব্যর্থতা, যা সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছে। জাতি আজ এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে- যেখানে সুশাসন, জননিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল চালিকাশক্তিগুলোও লাগামহীন দুর্নীতি ও তীব্র নৈরাশ্যবাদী সাংগঠনিক সংস্কৃতি দ্বারা পঙ্গু হয়ে আছে। এই প্রবন্ধে যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে, এই ক্ষয়ের গভীরতা বিবেচনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় খাতগুলোর সংস্কারের একমাত্র কার্যকর পথ হলো বিশ্বমানের বিদেশী ব্যবস্থাপনা ও বিশেষজ্ঞতার বাধ্যতামূলক প্রবেশ ঘটানো। এর মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় দুর্নীতি ও অদক্ষতার চক্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে।
নৈতিক কর্তৃত্বের পতন ও বস্তুবাদিতার উত্থান
সঙ্কটের মূলে রয়েছে সমাজের এক উদ্বেগজনক পরিবর্তন। একসময় বাঙালি সমাজ শিক্ষা, সততা, ধার্মিকতা ও সেবাপরায়ণতাকে সম্মান করত; কিন্তু আজ জনপরিসর ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অনবরত কর্তৃত্ব করছে অশিক্ষিত, অসৎ, ধর্মান্ধ এবং ক্ষমতাপাগল ব্যক্তিরা। নৈতিকতার এই উল্টো রথ আমাদের জাতীয় বিবেকের পতনকে চিহ্নিত করছে। দুর্নীতি এখন অভাব থেকে নয়; বরং অতি লোভ থেকে জন্ম নিচ্ছে। উচ্চ পদাধিকারীরাও নির্লজ্জভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, যার চালিকাশক্তি হলো অর্থের জন্য অদম্য ক্ষুধা। নৈতিকতা ও নাগরিক মূল্যবোধ বিলীন হয়ে গেছে, যা চরিত্র ও দেশপ্রেম উভয়কেই ক্ষুণ্ণ করছে। এই পরিবেশে ব্যক্তিগত স্বার্থ, কর্তব্যের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; দেশের প্রতি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য ম্লান হয়ে যায়। দুর্নীতি এখন কোনো ব্যতিক্রম নয়, এটি ব্যবস্থারই অপরিহার্য অংশ, যা ‘উপর থেকে নিচ’ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অলিখিত ‘চালিকাশক্তি’ হিসেবে কাজ করছে।
প্রাতিষ্ঠানিক পচন : সামান্য চুরি থেকে জাতীয় বিপর্যয় পর্যন্ত
বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা আজ স্তম্ভিত করার মতো, দেশের ৬০ শতাংশের বেশি সরকারি কর্মচারী এর সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত স্টাফরা এখন প্রভাব খাটানো ও ঘুষ লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত খুব কম ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান ফলাফলে পৌঁছায়। এই প্রশাসনিক পক্ষাঘাতের মূল কারণ হলো নৈরাশ্যবাদী সংস্কৃতি, যা বাংলায় প্রবাদ আকারে প্রচলিত : ‘কাকের গোশত কাকে খায় না’। গতানুগতিক তদন্ত ও মন্থর বিচারপ্রক্রিয়া এই মহামারী মোকাবেলায় সম্পূর্ণ অক্ষম। এর এক শক্তিশালী প্রমাণ হলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা : ২০০৪ সালে একটি সংস্থায় সংযুক্ত থাকাকালীন প্রায় ১০০ জন দুর্নীতিবাজের তালিকা তৈরি করে দ্রুত কঠোর শাস্তির প্রস্তাব দেয়া হলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এটি প্রমাণ করে, অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি প্রায়ই রাজনৈতিকভাবে অসম্ভব।
অন্য দিকে নৈতিকতার একটি দারুণ চিত্র দেখা যায় জাপানে। সেখানে এক বাসচালককে মাত্র সাত মার্কিন ডলার (এক হাজার ইয়েন) আত্মসাতের দায়ে বরখাস্ত করা হয়। সেই সাথে তার ৮৪ হাজার ডলার অবসরকালীন ভাতা জরিমানা হিসেবে বাজেয়াপ্ত করা হয়, যা সামান্য দুর্নীতিতেও শূন্য সহনশীলতার দৃষ্টান্ত। এমনকি জাপানের ইলেকট্রনিক টোল সিস্টেম ৩৮ ঘণ্টা অকেজো থাকা সত্তে¡ও ২৪ সহস্রাধিক চালক স্বপ্রণোদিত হয়ে অনলাইনে টোল পরিশোধ করেন। এটি প্রমাণ করে, যেখানে প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়, সেখানেও সততাই জয়ী হয়, এমন নৈতিক ভিত্তি বাংলাদেশে বলা চলে অনুপস্থিত।
ধারাবাহিক আগুন নিরাপত্তা ব্যর্থতার নগ্ন প্রমাণ
প্রশাসনিক ব্যর্থতার গভীরতম পরিণতি হলো জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি আপস, যা কৌশলগত অবকাঠামো এবং জননিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক, ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনাগুলো- মিরপুর-রূপনগর, এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড চট্টগ্রাম) এবং ১৪, ১৬ ও ১৮ অক্টোবর ২০২৫ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, প্রাতিষ্ঠানিক চরম ভাঙনের অকাট্য প্রমাণ।
বিমানবন্দরের আগুন জরুরি ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ত্রুটি উন্মোচন করেছে : ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলোতে পানি শেষ হয়ে যাওয়ার খবর এসেছিল, যা প্রমাণ করে স্প্রিঙ্কলার বা পর্যাপ্ত জলের মতো অপরিহার্য নিরাপত্তাব্যবস্থাগুলো স্থাপন বা রক্ষণাবেক্ষণে পদ্ধতিগত ব্যর্থতা রয়েছে। সাংগঠনিক সংস্কৃতি ‘কানের সুরক্ষা নি-িদ্র করা’ (কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা) নিশ্চিত করার চেয়ে ‘চিলের পেছনে ছোটা’কে (ঘটনার পর তদন্ত ও দোষারোপ) বেশি প্রাধান্য দেয়। একটি কার্যকর তাৎক্ষণিক শাস্তি ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এই গুরুতর অবহেলাকে দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করে।
বাহ্যিক হস্তক্ষেপের আবশ্যকতা : বিমান এবং চট্টগ্রাম বন্দরের উদাহরণ
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মতো দু’টি কৌশলগত সম্পদের পরিচালন দুর্বলতা একটি আমূল পরিবর্তনকে অপরিহার্য করেছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লোকসানের গর্ত থেকে বের হতে পারছে না। অন্য দিকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কিন্তু বিশ্বমানের বিদেশী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সংস্থাগুলো সফল। ২০০৭ সালে সিইও ড. এম এ মোমেনের নেতৃত্বে বিমানের পিএলসিতে রূপান্তরের উদ্যোগ ‘অতিরিক্ত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ’ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ইতিহাস প্রমাণ করে, এই ব্যবস্থা নিজেই নিজেকে সংশোধন করতে পারে না।
অপর দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে সরকার বাস্তবসম্মত কৌশল নিয়েছে। সরকার নিজেই বিদেশী কোম্পানি আনার পরিকল্পনা করছে এই যুক্তিতে যে, দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বন্দরের আধুনিকায়নের জন্য ‘প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে’। ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের এই কৌশলগত পদক্ষেপ বিমানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আমূল সংস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী, বাস্তবসম্মত নজির স্থাপন করেছে।
চূড়ান্ত অপরিহার্যতা : রূপান্তরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা
যেহেতু নৈতিক অবক্ষয় গভীর এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কার বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা সহজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, তাই দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ জরুরি। এই ব্যবস্থার দু’টি মূল আবশ্যকতা হলো :
১. বাধ্যতামূলক বিদেশী ব্যবস্থাপক : বিমানসহ অন্যান্য সংস্থায় অবিলম্বে বিশ্বমানের বিদেশী নির্বাহী দল নিয়োগ করা এবং তাদের সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা দেয়া, যাতে তারা কোনো রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে পারে।
২. দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর : এই বাহ্যিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধকে এড়িয়ে যাওয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত দক্ষ ও নিরাপদ করার জন্য ‘তাৎক্ষণিক রূপান্তর’ নিশ্চিত করা।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থাপনা নিয়োগের এই বাস্তববাদী পদ্ধতি কোনো আত্মসমর্পণ নয়; বরং জাতির ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ। এই বহিরাগত ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য হলো- স্থানীয় কর্মীদের পরামর্শ দেয়া, প্রশিক্ষণ দেয়া এবং বিশ্বমানের করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এটি একটি অস্থায়ী সংশোধনমূলক পর্যায়, স্থায়ী নির্ভরতা নয়। যখন এই সংস্কারকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দক্ষ, সৎ ও বৈশ্বিক মানসম্পন্ন বাংলাদেশী পেশাদাররা বেরিয়ে আসবেন, তখন তাদেরকেই পর্যায়ক্রমে নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা ভূমিকাগুলোতে গ্রহণ করতে হবে। সামরিক, আমলাতন্ত্র বা অন্যান্য পেশা থেকে প্রমাণিত উদ্যোগী ও সৎ বাংলাদেশী ব্যক্তিত্বদেরও এই সিস্টেমে একীভূত করা উচিত, যদি নিশ্চিত করা যায়, কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবে না। কারণ বিদেশী ব্যবস্থাপক দায়িত্ব নিলে, রাজনীতিবিদরা সহজে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করেন, ফলে মেধা, পেশাদারিত্ব ও শৃঙ্খলা বিকাশের সুযোগ পায়। চট্টগ্রাম বন্দর মডেলে প্রমাণিত, এই আমূল ও সুশৃঙ্খল কৌশল গ্রহণ করে, বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিক পতন রোধ করতে পারে এবং এমন এক প্রশাসনিক ভিত্তি পুনর্নির্মাণ করতে পারে, যা কেবল গণতন্ত্রের নাম বহন করে না; বরং সততা, দক্ষতা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কার্যকর গণতন্ত্র হয়ে ওঠে।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রোভিসি, বিইউপি



