দেশের শত্রু-মিত্র চিনতে পেরেছে তরুণরা

নির্বাচনের গণিতে ভবিষ্যতে নির্বাচনে তারা কত আসন পেলো সেটি আদৌ কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়; তাদের রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যয় ও সঙ্কল্প প্রকাশিত হয়েছে রাজনীতিতে সেটিই মুখ্য বিচার্য। এই প্রজন্ম সার্থকভাবে এই দেশ ও জাতির শত্রু-মিত্র নির্ণয় করতে পেরেছে, এটিই আমাদের আনন্দ ও সন্তুষ্টির কারণ। তাদের জন্য রইল অন্তহীন শুভ কামনা ও দোয়া। যে আবেগ থেকে তারা হিমালয় টলিয়েছে, বিভেদের ফাটল মিটিয়ে জাতীয় ঐক্যকে দুর্ভেদ্য করে তুলতে তারা সক্ষম হোক, এই প্রত্যাশা আজ ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর তথা পুরো জাতির।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক কবিতায় দুঃখ করে বলেছিলেন, পৃথিবী আমার কাজের ভার বয়, আমার ভার নেয়ার সামর্থ্য তার হয় না। কথাটি পুরোপুরি খেটে গেছে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের দুনিয়া কাঁপানো, দেশ বদলানো ছাত্র-জনতার মহাবিদ্রোহে। সেই অসম্পূর্ণ বিপ্লব যেন আজ গুমরে কেঁদে কেঁদে কবির ওই আফসোসের কথা বলছে। আসলে সেই বিপ্লবের সুফল আজ উপদেষ্টা থেকে চৌকিদার পর্যন্ত সবাই ভোগ করছে, কিন্তু জুলাই-বিপ্লবের অন্তঃদর্শন ও মর্মবাণী কেউ জুলাই-আগস্টের মতো করে ধারণ করতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে না। এ বিপ্লবের উপলক্ষ ছিল স্বৈরাচারের পতন এবং গণহত্যাকারী দুঃশাসক আওয়ামী বাকশালীদের রাজনৈতিক নিপাত। অথচ পতিত সেই স্বৈরাচারীদের পুনর্বাসনের জঘন্য অপপ্রয়াস বিপ্লবের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেননা, নির্বাচনের আগেই সংস্কার ও শাসন কাঠামোর আমূল রূপান্তর যে প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল, সেই প্রত্যয় আজ ম্লান হতে দেখছি। বিপ্লবের শহীদ ও পঙ্গুদের প্রতি কী চমৎকার প্রতিদান! রক্তের দাগ এখনো শুকাতে পারল না, এখন ক্ষমতার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, ক্ষমতার সোপানে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের তাৎপর্যকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে আমরা সবাই মহাব্যস্ত হয়ে উঠেছি। বিপ্লবের পর বৈপ্লবিক সরকার ছিল কাম্য। বিপ্লবের চোখে ধুলা দিয়ে স্বৈরাচারের দোসরদের নিরাপদে দেশ থেকে পাচারে সহায়তা করা ছিল বিপ্লবের প্রতি প্রথম এবং প্রায়শ্চিত্তবিহীন বিশ্বাসঘাতকতা।

অবাক বিস্ময়ে দেশ ও জাতি (এবং বিশ্বও) প্রত্যক্ষ করল প্রতিবিপ্লবের একেকটি অভিযান, যেমন সচিবালয় অবরোধ, আনসারদের দিয়ে পাল্টা অভিযান, চট্টগ্রাম অভিযান, সীমান্তে সংখ্যালঘুদের দিয়ে সাজানো নাটক ইত্যাদি। এরপর তারা সামাজিক অপরাধের মাত্রা বাড়াতে থাকল। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি বেশির ভাগ অনাচারেই স্বৈরাচারের ক্ষুধার্ত হায়েনারা বেপরোয়া। সীমান্তের ওপার থেকে আসছে ইন্ধন এবং কৌশলগত দিক-নির্দেশনা। সর্বোপরি ভারত সরকার ও তাদের নৃশংস গোয়েন্দা বহর ‘র’-এর যখন কাজই হলো বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা এবং যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশকে ইউনূসমুক্ত করা। ভারত জানে বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী যে নতুন ভাবমর্যাদা, সহানুভূতি ও সংহতি তার প্রতীকই হলেন নোবেলজয়ী এই জনপ্রিয় নেতা। তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্য মোকাবেলার জাতীয় গণজাগরণের প্রতীক।

দেশে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি পুনর্বহালের জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছেন অনেকে। অনেকের ধারণা, এর নেপথ্যে রয়েছে স্বৈরাচারের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের এবং ভারতীয় দাদাগিরির অবকাশ সৃষ্টির আত্মঘাতী খেলা। কিন্তু তাতে করে যে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার শাহাদত এবং পঙ্গুত্ববরণের চরম ত্যাগ-তিতিক্ষাকে অস্বীকার করা হচ্ছে সে বিবেচনা যেন কাজ করছে না।

ছাত্ররা তো ঠিকই বলেছে, আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন এবং দেশের আমূল নতুন বন্দোবস্তের স্বার্থে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জুলাই শাহাদতের দাবি।

মনে আছে, স্কুল পাঠ্যবইয়ে টলস্টয়ের একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটির নাম ছিল, Children are wiser than Elders (বড়দের চেয়ে ছোটরা বেশি বিজ্ঞ)। আমরা স্মরণ করি, এ দেশের অকুতোভয় তরুণ তরুণী ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক এবং মধ্যবিত্ত ও কর্মজীবী সেই সব সংগ্রামী মানুষের কথা। তারা জুলাই-আগস্টে একেকজন আবু সাঈদ, একেকজন মুগ্ধ হয়েছিল বলেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল। ৫৩ বছরের ভারতীয় দালালতন্ত্র এবং সেবাদাসীর রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক দাসত্বের অবসান তারাই ঘটাতে পেরেছিল।

সংস্কারের ন্যায্যতার ব্যাপারে মৌখিক সমর্থন সবাই দিচ্ছে। তবে ভেবে দেখতে হবে কেন এই সংস্কার, কী এই সংস্কারের সংজ্ঞা? এ ব্যাপারে সামান্যতম যুক্তির ঘাটতি নেই যে, সংস্কারের মূল মর্মবাণীই হচ্ছে এ দেশের রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি এবং জীবনের সর্ব ক্ষেত্র থেকে ভারত ও তাদের বাংলাদেশী দালাল এবং সর্বযুগের, সর্বকালের অথর্ব বুদ্ধিজীবীদের উচ্ছেদ। দেশে যতদিন স্বৈরাচারের অনুগত দানব রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকবে, ততদিন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়। আজ যারা বলছেন, স্বৈরাচারী দলকে নিষিদ্ধ করা উচিত হবে না কিংবা দাসত্বের দলিল বাহাত্তরের সংবিধান সম্পূর্ণ বদলানো উচিত হবে না, তারা কেন একবার নিজেকে প্রশ্ন করেন না যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে গত ৮০ বছরে জার্মানি, ইতালি, জাপানের মতো খুনি স্বৈরাচারীরা নামে-বেনামে সেই সব দেশের গণতন্ত্রের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার রাজনৈতিক মূলস্রোতে ফিরে আসতে পেরেছে কি?

ভারত তথা আওয়ামী লীগ তোষণের পরিণতি কি আমরা ভুলে গেছি? শেখ হাসিনাকে দেশে নিয়ে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যে খুন হয়ে যান আমাদের একজন দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট। ভারত তোষণের পরিণতিতে কি জাতীয় পার্টিকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়নি? আওয়ামী লীগের ‘বিটিম’ হতে গিয়ে সিপিবি, বামপন্থী জোট, ইনুর জাসদ, নাস্তিক লীগ এবং নিকৃষ্ট নাস্তিকরা কি আজ শতভাগ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে ইতিহাস থেকে নিখোঁজ হতে বসেনি?

‘দোদেল বান্দা কলেমা চোর, না পায় শ্মশান, না পায় গোর।’ পাতিবুর্জোয়াদের এই এক করুণাযোগ্য খাসলত। মনে মনে তারা স্বৈরাচার নিপাতে খুশি। কিন্তু মুখ খুলতে নারাজ। পাছে আবার স্বৈরাচার প্রত্যাবর্তন করে তাদের ঘুম হারাম করে দেয়! এই শ্রেণীটি যুগে যুগে ছিল, এখন প্রবলভাবে আছে। রাজনীতির ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ জানেন, দেশত্যাগের সেই অভিশপ্ত হেলিকপ্টার কিয়ামতের আগে আর ফিরে আসবে না। ইরানের সম্রাট ফিরে আসতে পারেনি তেহরানে, মার্কোস তার হাতেগড়া ম্যানিলায়, হিটলার তার দুর্গ বার্লিনে, তোজো তার দুর্গ টোকিওতে কিংবা মুসোলিনি ইতালিতে। একটি দেশের জনগণ যখন স্বৈরাচারী খুনি উৎপীড়কদের একবার পরিত্যাগ করে, তালাক দেয়, তারা কখনোই ফিরে আসতে পারে না। তাদের ঠাঁই হয় ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে এবং তাদের আমলনামা মোতাবেক সাব্যস্ত উপাধি ও উপমাতেই। তারা ক্রিয়াপদে নয়; বিশেষণ আকারেই ফিরে আসে কিংবা রোমানিয়ার চসেস্কু বা ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মতো কয়েক মিনিটের সংক্ষিপ্ত আদালতের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলে বা উন্মুক্ত ফায়ারিং স্কোয়াডেই তাদের অপকর্মের চূড়ান্ত প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হয়।

রাজনীতিতে তরুণদের জ্যোতির্ময় অভ্যুদয় সেকেলে ধ্যান ধারণাপুষ্ট অহঙ্কারী ও আত্মম্ভরি রাজনীতিবিদদের ‘ইগো’তে আঘাত দিয়েছে। তারুণ্যের এই সদ্য বিকশিত এবং নব বিকাশমান আলো তাদের মনের অন্ধকারকে জয় করতে পারছে না। অথচ কী না করেছে এই নব প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও সাধারণ জনতা? তারা একটা আস্ত হিমালয়কে টলিয়ে দিয়েছে, জাতীয় ঐক্যের ভিত গেঁথেছে (যা প্রবীণ রাজনীতিবিদদের কখনোই মুরাদে কুলায়নি জেন্ডার সমতা রচনা করেছে; এ দেশের অস্তিত্বের দর্শন ‘ইসলাম’কে নিয়ে এসেছে জায়নামাজ থেকে রাজপথে, রাজনীতিতে, ফেসবুক-ইউটিউবে ডুবে থাকা গন্তব্যহীন ধারাকে ফিরিয়ে এনেছে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের মিছিলে, রাজনৈতিক সঙ্কট, বিভেদ, দলাদলিকে ঈমানি চেতনায় যুথবদ্ধ করেছে, দেশকে ভালোবাসার শপথে, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে। আমাদের মতো মাজাভাঙা এবং নিদ্রিত বিবেক প্রৌঢ়দের, বৃদ্ধদের, আপসকামী পেশাজীবীদের এ জন্য লজ্জিত হওয়া এবং আত্ম দংশনে দংশিত হওয়া উচিত এবং আলিঙ্গন করা উচিত এই বিজয়ী বীর তরুণদের। ৫৩ বছর পর দেশের এই প্রথম একটি প্রজন্ম যারা দেশপ্রেমকে জীবনের মূল্যে উৎসর্গ করেছে। দেশকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় তার সবক দিয়েছে। সে জন্যই তো বলি, Sometimes, Children are wiser than Elders.’ এই নবজাগ্রত দেশপ্রেমিক তরুণ প্রজন্মের ভুল ভ্রান্তি, শুধরানোর উপদেশ না দিয়ে আপনি আমি যদি তাদের প্রতি উপহাস-গঞ্জনায় মত্ত হই বা তাদেরকে প্রতিপক্ষ গণ্য করতে থাকি, তাহলে সেটি হবে গত ৫৩ বছরের ভারতীয় আধিপত্যবাদের দালালি এবং এ দেশে তাদের প্রহরী-বরকন্দাজ খুনি লুটেরাদের স্বার্থানুকূল আত্মঘাত অথবা জেনে বুঝে সেই পতিত স্বৈরাচারের পক্ষাবলম্বন।

দাদাভাই নওরোজি ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ কিন্তু ইংলিশ কেতায় অভ্যস্ত তরুণ ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মধ্যে তিনি ভারতবর্ষের মুসলমানদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পেয়েছিলেন। জামাল আবদুল নাসের যখন রাজা ফারুকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন তার বয়স তখন ৩০ বছরও হয়নি। বুড়ো আমেরিকানরা যখন কিউবায় সামরিক হামলার তোড়জোড় করছিল তখন তরুণ রাষ্ট্রপতি কেনেডি সহনশীলতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে কিউবার মিসাইল সঙ্কট মোকাবেলায় কূটনৈতিক দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, যার কাছ দিয়েও আজকের বুড়ো ট্রাম্প হাঁটছেন না।

বাংলাদেশের তরুণদের এই সংস্কার-আকাক্সক্ষা বা নতুন বন্দোবস্তের দাবি (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র) প্রবীণদের কাছ থেকেই আসবে, এটিই প্রত্যাশিত ছিল। তারা যে আজকের বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছে, এর যথেষ্ট যুক্তিসিদ্ধ কারণ এবং পটভূমি রয়েছে। বিপ্লবের পর প্রবীণদের উপর ভরসা করে তারা একের পর এক হতাশ হয়েছে। নির্বাচনের গণিতে ভবিষ্যতে নির্বাচনে তারা কত আসন পেলো সেটি আদৌ কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়; তাদের রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যয় ও সঙ্কল্প প্রকাশিত হয়েছে রাজনীতিতে সেটিই মুখ্য বিচার্য। এই প্রজন্ম সার্থকভাবে এই দেশ ও জাতির শত্রু-মিত্র নির্ণয় করতে পেরেছে, এটিই আমাদের আনন্দ ও সন্তুষ্টির কারণ। তাদের জন্য রইল অন্তহীন শুভ কামনা ও দোয়া। যে আবেগ থেকে তারা হিমালয় টলিয়েছে, বিভেদের ফাটল মিটিয়ে জাতীয় ঐক্যকে দুর্ভেদ্য করে তুলতে তারা সক্ষম হোক, এই প্রত্যাশা আজ ‘নতুন বাংলাদেশ’ এর তথা পুরো জাতির।