দুর্ঘটনা ও দুর্ভাবনা

মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি যদি আমাদের বিমানবাহিনীতে কোনো পরিবর্তন আনে এবং নগরায়নে যদি গ্রহণ করা হয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা- তাহলে রক্তনদীর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে সান্ত্বনা।

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। সারা বছর নানা দুর্যোগ দুর্ঘটনায় আচ্ছন্ন থাকে এই মানচিত্র। বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা আমাদের নিত্যসাথী। এই ছোট্ট দেশে ১৮ কোটি মানুষের ব্যবস্থাপনাও এক সুকঠিন কাজ। আমাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্থিরতা, অবিশ্বাস ও অলসতার ইতিহাস আছে। মৃত্যু এদেশে এখন আর অসম্ভব আলোড়ন তোলে না। এক সময় দু-একটি মৃত্যু ওলট-পালট করে দিয়েছে রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনা। এখন মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে আমরা যেন অভ্যস্ত। এমন কোনো দিন নেই যে, সড়ক অথবা নৌপথে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটছে না। নৌপথ, জনপথ এবং আকাশপথের হিসাব নিলে দেখা যাবে, বিমানে দুর্ঘটনার মাত্রা খুবই কম। এখন আমরা আকাশ-পথের এমন একটি দুর্ঘটনা নিয়ে শোক-বিহ্বল যার সত্যি কোনো জবাব নেই। অনেকেই বলবেন, দৈব দুর্ঘটনার তো কোনো হাত-পা নেই। অপপরফবহঃ রং ধপপরফবহঃ স্বাভাবিকভাবে এ সরলীকরণ মেনে নিতে কষ্ট হয়।

উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরও প্রাণ দিয়েছেন। আহত হয়েছে কয়েক শ’। হতাহতের বেশির ভাগই অগ্নিদগ্ধ। এই ভয়াবহ বিরল দুর্ঘটনায় রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক শোক ঘোষণা করেছে। শোকে বিহ্বল গোটা জাতি। যুদ্ধবিমানটি নিয়মিত প্রশিক্ষণে উড়ছিল। উড্ডয়নের পরপরই বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। পাইলট বিমানটিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন।

স্কুলের যে ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাস চলছিল। কিছুক্ষণ আগে ছুটি হয়ে গেলেও অনেক শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষ ও আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। শিক্ষার্থীদের নেয়ার জন্য অনেক অভিভাবক ভবনের ভেতরে ছিলেন। ছুটির পর সেখানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কোচিং হতো। বিমানটি বিধ্বস্ত হলে তাতে আগুন ধরে যায়। আগুনের কারণে এ সময় ভবন থেকে অনেকে বের হতে পারেননি। এসময় সেখানে এক-দেড় শ’ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। দুর্ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা দ্রুত উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়।

দুর্ঘটনাকে সহজভাবে দেখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করা হলে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তব ব্যবস্থার ব্যর্থতা রয়েছে। এই দুর্ঘটনা নিয়ে ব্যর্থতার বিশ্লেষণ ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। গত এক দশকে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা বারবার ঘটেছে। এর কোনোটিতে পাইলট আহত বা নিহত হয়েছেন। কোনোটি বিধ্বস্ত হয়েছে জনবসতি থেকে দূরে। এবারের মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে একের পর এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার পরও মৌলিক পরিবর্তন আসেনি বিমানবাহিনীর বহরে। এসব দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। পুরনো বিমানের পরিবর্তে যুক্ত হয়নি আধুনিক যুদ্ধবিমান।

দুর্ঘটনার পরদিন ঢাকার একটি দায়িত্বশীল দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৭ বছরের অনেকগুলো বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে তিনটিতেই জড়িয়ে ছিল এফ-৭ প্রশিক্ষণ বিমান। উত্তরায় বিধ্বস্ত হওয়া এফ-৭ সিরিজের বিমানটিও ছিল চীনের তৈরি জে-৭ তথা এফটি-৭ বিজিআই। এটি মূলত ১৯৬০-৯০ দশকের প্রযুক্তি। বর্তমানে এ ধরনের বিমানের দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি বলে উল্লেখ করেছে অ্যারোস্পেস গ্লোবাল নিউজ-এজিএন। ১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির বহরে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম ও দ্রুতগামী জেট ছিল জে-৭। অ্যারোস্পেস গ্লোবাল নিউজের তথ্য অনুযায়ী, রফতানির সময় চীনা কোম্পানিটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান আমদানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে। সে সময় এর নামের সাথে কিছু সঙ্কেত ব্যবহার করা হয়। যেমন- বাংলাদেশ যদি এ সিরিজের যুদ্ধবিমান আমদানি করে তাহলে এফ-৭-এর পর ইংরেজি অক্ষর ‘বি’ যুক্ত হয়। আর গ্লাস ককপিটের নকশার ক্ষেত্রে ‘জি’ এবং উন্নত সংস্করণ বোঝাতে ইমপ্রুভডের ‘আই’ যুক্ত হয়। এ ধরনের জেট সারা বিশ্বেই আকাশ প্রতিরক্ষা, বহুমুখী অভিযান ও পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার হয়। তবে নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের চেয়ে এর দুর্ঘটনার হার বেশি। এর কারণ পুরনো নকশার এয়ারফ্রেম, সীমিত নিরাপত্তা, আধুনিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অভাব। এভিয়েশনভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোর তথ্যানুযায়ী, এফ-৭ কম স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধবিমান।

মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডির পর যেসব ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ভালো মন্দ দুটোই আছে। ভালো এটি যে, শুরুতে উদ্ধার প্রচেষ্টা সম্মিলিত এবং সমন্বিত ছিল। শত শত মানুষ ছুটে গেছে রক্ত দেয়ার জন্য। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্ঘটনা সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা যথার্থ নয়। সেনাবাহিনীর জাতিসঙ্ঘ কার্যক্রমে দু’-একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জুটলেও স্বদেশে তার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি। পৃথিবীর বহু দেশে ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম-আইসিএস রয়েছে। এটি হলো একটি যথার্থ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এটি জরুরি পরিস্থিতিতে কমান্ড, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আইসিএস পদ্ধতি রয়েছে। যাই হোক, সীমিত শক্তির মধ্য দিয়ে সবার প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদই দিতে হয়। তবে সরকারের কিছু ব্যর্থতা এবং জনপ্রতিক্রিয়া সবারই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুর্ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে তাদের কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। এরপর আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কথা। ট্র্যাজেডির কারণে চলমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাত ৩টার দিকে পরীক্ষা পেছানোর যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা ছিল অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিকতার কারণে সচিবালয়ে ছাত্ররাও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটায়।

আরেকটি সিদ্ধান্তে সরকারের অস্থিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতা প্রকাশ পায়। ঘটনার প্রথম দিকে প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে অর্থ সহযোগিতার আহ্বান জানানো হয়। পরে তা আবার সরিয়ে নেয়া হয়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী আরেকটি ঘটনা হলো, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একপর্যায়ে মারধর করা হয়। এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য আচরণ দুর্ভাবনার বিষয়। দুর্ভাবনার এখানেই শেষ নয়, সেখানে গিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সিআর আবরার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। সেখানে তারা অনাকাক্সিক্ষতভাবে ১০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। বাহিনীর হাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মারধর যেমন অস্বাভাবিক ও দুর্ভাবনার কারণ, তেমনই দু’জন উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ রাখাও অস্বাভাবিকই। স্কুলের যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, উপদেষ্টাদ্বয় প্রথমে সেই জায়গা পরিদর্শন করেন। এর পরই শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে ধরেন। শিক্ষার্থীদের উত্থিত ছয় দফা দাবি মেনে নেয়া হলেও ছাত্ররা স্বাভাবিক আচরণ করেনি। ছাত্ররা যে দাবি পেশ করেছে তা যেকোনো বিচারে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু অযৌক্তিক হলো তাদের অসহনশীল আচরণ।

কোনো দুর্ঘটনাই সহজ সরল ও স্বাভাবিকভাবে ঘটে না। দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। কিন্তু আমাদের দেশের যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অনেকে বাছ-বিচার না করেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখায়। যে বাসচালক একজনকে চাপা দিয়ে চলে গেল, তার খবর নেই কিন্তু ক্রুুদ্ধ জনতা আরো বেশি গাড়ি ও বাস আক্রমণ করে, জ্বালিয়ে দেয় এবং অঘটন ঘটায়। এটি জনমনের ক্ষোভ ও ক্রোধের প্রকাশ ঘটলেও কোনোক্রমেই বাঞ্ছিত নয়। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পর প্রতিক্রিয়া ঘটা অসম্ভব নয়। কিন্তু অসম্ভব হচ্ছে সীমালঙ্ঘন করা। শিক্ষার্থীরা দুই দফায় সচিবালয়ে প্রবেশ করে এবং উপদেষ্টাদের সাথে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করে। এটিও একটি অপ্রিয় সত্য যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথম থেকে এ পর্যন্ত কেন যেন শক্ত ও সংযত আচরণ করতে পারছে না। এখন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হয়নি। এটি ভবিষ্যতে আরো দুর্ঘটনা ও দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি আমাদের কাঁদাবে অনেক দিন। আমাদের হৃদয়ের শোক হয়তো প্রশমিত হবে কিন্তু যে ক্ষতি হয়ে গেল তা পূরণ হবে না কোনো দিন। এক সাথে এত মৃত্যুর ঘটনা খুব কমই ঘটেছে বাংলাদেশে। এই ক্ষতি অমোচনীয় ও অপূরণীয়। প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনা আমাদের জন্য কিছু শিক্ষা এনে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা এসবের মধ্য দিয়ে কিছুই শিখি না। মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি যদি আমাদের বিমানবাহিনীতে কোনো পরিবর্তন আনে এবং নগরায়নে যদি গ্রহণ করা হয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা- তাহলে রক্তনদীর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে সান্ত্বনা।

লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়