মো: মাঈন উদ্দীন
এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানো বাংলাদেশের জন্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়েই আজকের ভাবনা। এলডিসি উত্তরণের প্রস্তুতি ও অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘ চিঠি দিয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুতির অগ্রগতি জানাতে বলা হয়েছে। সরকারকে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে ভার্চুয়াল উপায়ে ওই বৈঠকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সভার অ্যাজেন্ডা, তারিখ ও সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের তালিকা যথাসময়ে জানানো হবে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত ছয় বছরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। তবে কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ একাধিক দেশকে দুই বছর সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ আছে। এলডিসি দেশগুলোও এক ধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এই তালিকায় রাখা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হওয়ার কারণে তখন থেকে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়ে আসছে।
গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৬ সালে নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এখন এলডিসি উত্তরণ পেছাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণ নির্ধারিত সময়েই হবে। ব্যবসায়ীদের সাথে বহুবার বৈঠক করেছি। অনেকের কারখানা পরিদর্শন করেছি। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তারা অন্য কথা বলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পিছিয়ে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে এলে কি বিদ্যুৎ সমস্যা, যানজট সমস্যা ইত্যাদি সমাধান হয়ে যাবে? বৈশ্বিক রাজনীতি এখন খুবই টালমাটাল, এটি মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে।’ ইতোমধ্যে এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর আবেদন করেছে কয়েকটি দেশ। সলোমন দ্বীপপুঞ্জ গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ দেখিয়ে বাড়তি সময় চেয়েছে। আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলাও এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদন করেছে। মিয়ানমার চেয়েছিল এলডিসি থেকে বের হতে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সিডিপি (কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি) ২০২৭ সাল পর্যন্ত দেশটির এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেয়। এ ছাড়া সুনামির কারণে মালদ্বীপ এবং ভূমিকম্পের কারণে নেপালের এলডিসি উত্তরণ নির্ধারিত সময়ে হয়নি। গত ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার হয়েছে। ব্যাংক খাতেও কিছু সংস্কার হয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে ওই খাতে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। এতে এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, প্রবাসী আয়ও বেড়েছে। কারো কারো মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এখন এলডিসি উত্তরণ পেছাতে গেলে বাংলাদেশ কী কারণ দেখাবে, সেটিও একটি প্রশ্ন। তবে অর্থনীতি ও সামাজিক খাতে সংস্কার, বিনিয়োগ পরিবেশসহ কিছু খাতে এখনো দুর্বলতা আছে।
সম্প্রতি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ পেছানোর জোর দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রফতানি খাতসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপ হয়েছে। সামনে নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে অর্থনীতিতে নতুন সঙ্কটের আশঙ্কা আছে। সার্বিক বিবেচনায় তারা এলডিসি থেকে উত্তরণে আরো সময় নেয়ার সুপারিশ করেন। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ- এমন সিদ্ধান্ত জাতিসঙ্ঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় আছে ১৫ মাস। এলডিসি থেকে উত্তরণ বিষয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থান জানাতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা চিন্তাভাবনা করছি। তবে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিলে প্রস্তুতি নিতে ভালো হয়। না হলে ব্যবসায়ীরা সব সময় বলে, প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি। উত্তরণ থেকে পেছানোর জন্য জাতিসঙ্ঘে কোনো আবেদন করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পেছাতে এখনই আমরা আবেদন করব না। এটি নির্ভর করবে প্রস্তুতির ওপর। বাংলাদেশ থেকে পোশাক, ওষুধসহ বেশ কিছু পণ্য বিদেশে রফতানি হয়। রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ তিন থেকে ছয় বছর পেছানোর দাবি করেন। তারা বলেন, উত্তরণের পর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধ শিল্প। ওষুধ শিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরো কড়াকড়ি হবে। এতে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। একই সাথে সফটওয়্যার ও বইসহ বিভিন্ন পণ্যের কপিরাইট ইস্যুতে বাড়তি খরচ লাগতে পারে। এ ছাড়া জিএসপিসহ অন্যান্য বাণিজ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে রফতানি কমবে ৬ থেকে ১৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকের ভিত্তিতে এলডিসি উত্তরণ করা হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যদি কোনো দেশ দ্বিতীয় পর্যালোচনার পর এসব সূচকে পিছিয়ে যায়, তাহলে উত্তরণ পিছিয়ে দেয় জাতিসঙ্ঘ। তবে বাংলাদেশ তো এখনো তিনটি সূচকেই ভালো অবস্থায় রয়েছে। জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দু’টি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো- সরকারপ্রধানকে সরাসরি ইকোসকের সিডিপির প্রধানের কাছে চিঠি লিখতে হবে। চিঠিতে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে যে, নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নতুন ও অপ্রত্যাশিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং এই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায় হলো- বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। তখন সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে একটি দেশের মানমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রকাশ পায়। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। একটি দেশের সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয় দেশটি কোন শ্রেণীতে আছে তার ভিত্তিতে। অন্যদিকে এলডিসি তালিকায় থাকলে ওই দেশকে নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় উন্নত দেশগুলো। এটি অনেকটা পরনির্ভরশীলতায় থাকার মতো বিষয়।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার