দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘ দিন ধরেই খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ। এর কারণে ঋণদানের সক্ষমতা, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ- সবকিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ০৯ শতাংশের সমান। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ অনুপাত। ২০২৪ সালের জুনে এই হার ছিল মাত্র ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই হার দ্বিগুণ হওয়া প্রমাণ করে, ব্যাংক খাত গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। মহামারী-পরবর্তী স্থবিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন, অদক্ষ ঋণ মূল্যায়ন, দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাব- সবমিলিয়ে এ বিপর্যয় তৈরি হয়েছে।
এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৬ সেপ্টেম্বর একটি নতুন সার্কুলার জারি করে ঋণখেলাপিদের মাত্র ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে (বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫)। শর্ত অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ‘Sub-standard’, ‘Doubtful’ বা ‘Bad/Loss’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ঋণ এ সুবিধার আওতায় আসবে। পুনঃতফসিলকৃত ঋণের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডও দেয়া হয়েছে। আগে যেসব ঋণ তিনবার বা তার বেশি পুনঃতফসিল করা হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হবে। এই নীতি পূর্ববর্তী কঠোর কাঠামোর তুলনায় অনেক বেশি নমনীয় এবং ঋণগ্রহীতাদের জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই সুবিধা শুধু সৎ ঋণগ্রহীতাদের জন্য প্রযোজ্য এবং প্রতারণার আশ্রয় নেয়া ঋণগ্রহীতাদের জন্য নয়। এই শর্ত ব্যাংকগুলোর জন্য একটি নৈতিক নির্দেশনা, তবে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রভাব কতটা এড়ানো সম্ভব হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিছু ব্যবসায়ী রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে এই সুবিধা গ্রহণ করেছেন, যা ব্যাংক খাতের নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই সার্কুলারের বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করবে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ঋণগ্রহীতার অর্থনৈতিক সক্ষমতা মূল্যায়ন ও সরকারের নীতি সমন্বয়ের ওপর। কিছু সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ হলো- ঋণ পুনঃতফসিলের পর ব্যাংকগুলোকে এই ঋণের জন্য পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে হবে। যদি ব্যাংকগুলো যথাযথ প্রভিশন না রাখে, তাহলে এটি তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। ঋণ পুনঃতফসিলের পরও ঋণগ্রহীতাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা মূল্যায়ন করতে হবে।
ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। যদি সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকে তাহলে এই পদক্ষেপটি সফল হতে পারে না। তৃতীয়ত, সরকারি নীতি ও তদারকি অপরিহার্য। ব্যাংকিং খাতে পুনঃতফসিল কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত নীতি ও তদারকি থাকতে হবে।
ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হ্রাস পেতে পারে, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণসুবিধা একটি সুযোগ হিসেবে কাজ করবে।
অন্য দিকে যদি এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ না করা হয়, তাহলে এটি ব্যাংকগুলোর জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাব বা অনিয়মের মাধ্যমে অনিচ্ছাকৃত ঋণ পুনঃতফসিল প্রদান হলে, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই পুনঃতফসিল কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য নির্ভুল নীতি প্রয়োগ, স্বচ্ছ প্রশাসনিক তদারকি ও নিয়মিত মূল্যায়ন অপরিহার্য।
এক দিকে কম ডাউন পেমেন্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি সময়সীমা ঋণগ্রহীতাদের জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। তারা ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, নগদ প্রবাহ স্থিতিশীল রাখতে পারছেন এবং নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারেন। ব্যাংকগুলোর জন্যও এটি কিছুটা আশার আলো। হিসাবের খাতায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসবে। অর্থনীতির জন্যও এটি ইতিবাচক, কারণ বিনিয়োগের আস্থা ফিরিয়ে আনা গেলে উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতে পারে।
তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এ সার্কুলার সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বড় ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে সুবিধাজনক পুনঃতফসিল পাচ্ছেন, যেখানে সাধারণ ঋণগ্রহীতারা একই সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ অভিযোগ সত্য হলে পুরো উদ্যোগের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংক খাত আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা যেমন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণমান ও নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফের ২০২৫ সালের দেশভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ লুকানো এবং পুনঃতফসিলের অতিরিক্ত শিথিলতা প্রকৃত ঝুঁকি আড়াল করছে। বিশ্বব্যাংকও বলেছে, ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের শৈথিল্য বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থাকে বিকৃত করছে এবং এটি দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।
আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা যেমন স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস, মুডিস এবং ফিচ রেটিংসও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের উচ্চহার এবং নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা দেশের সার্বিক ক্রেডিট রেটিংকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাসের ঝুঁকি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অনুরূপ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পাকিস্তান ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য পাঁচ বছরের মেয়াদ ও এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কাতেও ২০২২ সালে একই ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছিল। তবে এসব পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পুনঃতফসিল ব্যর্থ হয়েছে, কারণ ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক সক্ষমতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।
খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে শুধু পুনঃতফসিল নয়, প্রয়োজন সমন্বিত সংস্কার। ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের আগে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক সক্ষমতার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেবল প্রকৃত সমস্যায় থাকা ব্যবসায়ীরাই সুবিধা পান।
রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বচ্ছতার অভাব অব্যাহত থাকলে পুনঃতফসিলের সুবিধা ব্যাংকিং খাতের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে। বলা যায়, এ নীতি একটি পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে এক বড় পরীক্ষার মুখোমুখি করছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি যথাযথ নীতি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এটি ব্যাংকিং খাত ও দেশের অর্থনীতির জন্য একটি স্থায়ী সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ব্যবসায়ীদের জন্যও এই সুবিধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখা জরুরি। ন্যায্য প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা গেলে, এই পদক্ষেপ ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা এবং দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলা এবং পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হবে। অন্যথায় এটি কেবল দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংক খাতকে আরো দুর্বল করে তুলবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক