গত ৯ এবং ১১ সেপ্টেম্বর সম্পন্ন হয়েছে ‘ডাকসু’ ও ‘জাকসু’ নির্বাচন। নির্বাচনের ফলে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। এতে ইসলামী ছাত্রশিবির জয় লাভ করার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এভাবে নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবাক করা একটি ফল! এ ফলকে মূলত ‘জেন-জেড’ প্রজন্মের মনস্তত্তে¡র প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে। কাজেই এ নির্বাচনের একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ দরকার।
শিবিরের বড় জয়ের কারণ: ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী’ প্যানেলের বড় ব্যবধানের জয়ের অসংখ্য কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বড় কারণগুলো মোটা দাগে আলোচনা করা যেতে পারে।
১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার পর দ্রুত ছাত্রসমাজে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসুতে ভিপিসহ বেশ কয়েকটি পদে জয়লাভ করে শিবির। কিন্তু ১৯৮২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ‘নেতাকর্মী’ হত্যার মাধ্যমে শিবিরকে কোণঠাসা করা শুরু হয়। এরপর থেকে ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রদলসহ অন্য ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্রশিবিরবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এসব ছাত্রসংগঠন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে কোণঠাসা করতে থাকে। এসব শিবিরবিরোধী পদক্ষেপে দেশের সুশীলসমাজের বামগোষ্ঠী ও চিহ্নিত মিডিয়া হাউজ অংশ নেয়। আদর্শিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে শিবিরকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ এবং ‘রগকাটা’ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ট্যাগ দিতে থাকে। একই সাথে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিবির নেতাকর্মী নিহত হন প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের হামলায়। তদুপরি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো ‘পরিবেশ পরিষদ’ নামের গোষ্ঠী সৃষ্টি করে অন্যায়ভাবে ক্যাম্পাসগুলোতে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। এভাবে ১৯৮১ সালের পর থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে স্বাধীনভাবে তাদের আদর্শিক কাজগুলো করতে দেয়া হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে আওয়ামী স্বৈরশাসক ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আরো মারমুখী হয়ে ওঠে। আওয়ামী সরকার ও তার সহযোগী মিডিয়া হাউজ শিবিরকে হত্যাযোগ্য দানবীয় রূপে চিত্রায়িত করে। ফলে ১৯৮১ সালের পর শিবির নিজেকে ছাত্রদের কাছে তুলে ধরার অবাধ সুযোগ পায়নি।
৫ আগস্ট বিপ্লবের পর একটি স্বাধীন পরিবেশে শিবির গত এক বছরে সাধারণ ছাত্রদের কাছে সংগঠনের মিশন, ভিশন, কর্মপন্থা তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। যা সাধারণ ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদের ওপর ১৬ বছরের জুলুম-নির্যাতন ছাত্রদের সহমর্মিতা অর্জন করেছে। তৃতীয়ত, ৩৬ জুলাই আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা সবার নজর কেড়েছে। তারা পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সব ভূমিকায় থাকলেও বিপ্লব-পরবর্তী কোনো ক্রেডিট নেয়নি এবং সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেনি; বরং আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহত ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। গত ১৬ বছর প্রকাশ্যে না থাকতে পারলেও নীরবে সুখে-দুঃখে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে ছিল। সত্যিকারার্থে শিবিরের কার্যক্রম রাজনীতিকেন্দ্রিক নয়; বরং তারা ছাত্রকল্যাণ-ভিত্তিক আদর্শিক কার্যক্রম করে ইসলামী আন্দোলন এগিয়ে নিতে চায়। ডেডিকেশন, নেতার প্রতি আনুগত্য, পারস্পরিক মমত্ববোধ ও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় তারা অনন্য। তাছাড়া শিবিরের প্রার্থীরা মেধা, যোগ্যতা, আদর্শ ও আধুনিকতার সমন্বয়ে উন্নত চরিত্র প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি শিবিরের জয়ে প্রভাব ফেলেছে তা হলো- জামায়াত-শিবিরের প্রতি ভারতের অযৌক্তিক বিরোধিতা। হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ভারত যেভাবে নগ্ন সহযোগিতা দিয়েছে তা আজকের ‘জেন-জেড’ প্রজন্মকে প্রচণ্ডভাবে ভারতবিরোধী করে তুলেছে। ফলে এ নির্বাচনকে তারা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছে।
ছাত্রশিবিরের নির্বাচনী কৌশল অন্য সব প্যানেলকে আউটস্মার্ট করে ফেলেছিল। প্যানেলে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে স্থান দিয়ে মিলেমিশে কাজ করার উদাহরণ তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচনের ভোট গণনার সময় শিবির ‘অঃঃধপশরহম উবভবহপব’ বা একটি ‘আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা’ কৌশল গ্রহণ করে। নির্বাচন শেষে ভোট গণনায় বিভিন্ন গুজব ছড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ স্পষ্ট বলেছেন, ‘ফলে কারচুপি হলে পরিণতি হাসিনার চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে।’ লক্ষণীয় ছিল, শিবির প্যানেলের প্রার্থীরা অন্য কোনো প্যানেলের বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে সময় নষ্ট করেনি। তবে তাদের সামাজিক মাধ্যমের প্রচার ছিল সর্বগ্রাসী। তাছাড়া এ নির্বাচনে দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীসহ সব সমর্থকগোষ্ঠী ও তাদের পরিবার সবাই মিলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতায় হাত বাড়িয়েছে।
ছাত্রদলের পরাজয়ের কারণ : ছাত্রদল ১৬ বছর নির্যাতিত ছিল এবং ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত ছিল। কাজেই তাদের রাজনীতিকেন্দ্রিক তৎপরতার বাইরে অন্য কোনো কর্মসূচি না থাকায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল একেবারে নীরব। ক্যাম্পাসে টিকে থাকায় তাদের ছিল না কোনো কৌশল। ফলে তারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তদুপরি বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তারা শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। এমনকি তারা সুসংগঠিত হতে না পারায় ‘ডাকসু’ প্রার্থীর আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একদিন সময় বাড়িয়ে দেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এটিকে প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ হিসেবে দেখেছেন। এ সময় একজন ছাত্রদল নেতা প্যানেল চূড়ান্তের বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতার নাম উচ্চারণ করেছিলেন যা ছিল ছাত্রদলের সিদ্ধান্তগ্রহণের দুর্বলতার প্রতিফলন। ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থীরা নির্বাচনী অভিযান শুরু করেছিলেন শিবির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বয়ান দিয়ে এবং শেষও করেন সেভাবে। তাদের সেই বয়ান ফ্যাসিস্ট সরকারের এবং ছাত্রলীগের গত ১৬ বছরের বয়ানের সাথে মিলে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর! তাদের এ ট্যাগিংয়ের রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে, মতের বিরুদ্ধে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরাসরি জামাতি বলে ট্যাগ দিচ্ছিলেন। অভ্যুত্থানের-পরবর্তী সময়ে গত এক বছরে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির অপরাধে হাজার সাতেক লোকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের ঔদ্ধত্বপূর্ণ অহমিকামূলক বক্তৃতা-বিবৃতি ভাইরাল হয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ফলে সচেতন শিক্ষার্থীরা এসব পর্যবেক্ষণ করে ভোটে তাদের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর নমুনা সবাই দেখেছেন নির্বাচন শেষে রাতে ঢাবি ভিসির সাথে ছাত্রদল নেতার অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক এবং অছাত্রসুলভ আচরণ! সব মিলিয়ে ছাত্রদল প্রার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থায় আনতে পারেননি। তাছাড়া বিএনপির জাতীয় রাজনীতির প্রভাবও এতে পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়া বিপ্লব সম্পর্কে বিএনপির জাতীয় পর্যায়ের কোনো কোনো নেতার বক্তব্য নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
অন্যান্য কারণ : নির্বাচন চলাকালীন মিডিয়া সাহসিকতার সাথে সার্বক্ষণিক পাহারার কাজটি করেছে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ার সাথে সাথে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং পেশাদার। সর্বোপরি ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সাহসিকতা এবং দলনিরপেক্ষতার সাথে নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন। বিশেষ করে ঢাবির ভিসি ছাত্রদলের নেতাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে সাহসিকতা, বলিষ্ঠতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। অপমানিত হয়েও তাদের সাথে অত্যন্ত ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে আলোচনা করেছেন। অবশ্য নির্বাচনে বেশ কিছু অনিয়মের এবং ত্রুটি বিচ্যুতির অভিযোগও ছিল। বিশেষ করে জাকসুতে ভোট গণনার পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সমালোচিত। তবে এসব বিচ্যুতিগুলো নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করতে পারেনি বলে জানা যায়।
নির্বাচনের শিক্ষা : ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে একটি বার্তা। আজকের সচেতন মহল বিশেষ করে তরুণরা কী চিন্তা করছে তা রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে সক্ষম হতে হবে। এটি ছিল মূলত আধিপত্যবাদীর বিরুদ্ধে রায়। সেই আধিপত্য হতে পারে অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক। আজকের তরুণরা বিদেশী আধিপত্যবাদ তো নয়ই; বরং ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করে এমন কিছুও মানতে নারাজ।
ফলের পর ঢাবি ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী তা মেনে না নিলেও জিএস প্রার্থী বিনীতভাবে মেনে নিয়েছেন। আর জাকসুর ছাত্রদল নির্বাচন বয়কট করলেও পরবর্তীতে ফল মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন। তবে বিএনপি নেতারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা নির্বাচনের ফল নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে গিয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেননি। কেউ বলেছেন কারচুপি, কেউ বলেছেন ছাত্রলীগ ভোট দিয়েছে যা বাস্তবতার সাথে যায় না। জগন্নাথ হলে শিবিরের ভিপি প্রার্থী ১০ ভোট পেয়েছেন সেখানে ছাত্রদল প্রার্থী বাকি প্রায় সব ভোট পেয়েছেন। এ সমস্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য বিএনপির পক্ষে যাবে কি না তা একটি বড় প্রশ্ন। আমাদের বরং এ নির্বাচন দু’টি বিশ্লেষণ করে এর থেকে শিক্ষা নেয়া সব দলের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
দেশ আমাদের সবার, সব দলের; সবাই মিলে দেশটিকে গড়তে হবে। দু’টি মাত্র নির্বাচন ভালো ফল না হলে সব শেষ হয়ে যায় না! বরং পরেরগুলো ভালো করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে কতটুকু প্রভাব ফেলবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। সামনে রাকসু ও চাকসু নির্বাচনকেও পর্যবেক্ষণে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে সবাই সচেতনভাবে ভোট দেন, যেটি সাধারণত জাতীয় নির্বাচনে হয় না। জাতীয় নির্বাচনে সচেতন, বেশি সচেতন, কম সচেতন সবাই ভোট দেন। সেখানে থাকে আবেগ, ব্যক্তির প্রতি মোহ ও মার্কার প্রতি ভালোবাসা। কাজেই ডাকসু-জাকসু ফলে বিএনপির জন্য যেমন হতাশার কিছু নেই, তেমনি জামায়াতের জন্যও অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা হতে পারে আত্মঘাতী।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক