গুলি থামাতে পারে দেহ, থামাতে পারে না সত্য

হাদি চলে গেছেন; কিন্তু রেখে গেছেন এক আদর্শ বোধ। তার সেই অমোঘ সত্য আজও আমাদের কানে বাজে- দেহকে গুলি থামিয়ে দিতে পারে; কিন্তু সত্যের যাত্রাপথ রুদ্ধ করার ক্ষমতা কোনো মারণাস্ত্রের নেই।

এই লেখা কোনো শোকবার্তা নয়; কোনো প্রথাগত স্মৃতিচারণও নয়। এটি একটি ঘোষণা- একটি মৃতপ্রায় সমাজে বেরিয়ে আসা এক ক্ষুরধার কণ্ঠস্বরের ব্যবচ্ছেদ। বাস্তবে একটি সমাজ যখন দীর্ঘ দিন অন্যায়ের সাথে আপস করে বেঁচে থাকতে শেখে, তখন অন্যায় আর অপরাধ থাকে না- হয়ে ওঠে প্রাত্যহিক নিয়ম। সেই নিয়ম ভাঙার সাহস যিনি দেখান, প্রচলিত ব্যবস্থা তাকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করে। শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন সেই বিপজ্জনকদের একজন। বিপজ্জনক ছিলেন, কারণ তিনি প্রশ্ন করেছিলেন; বিপজ্জনক ছিলেন কারণ তিনি মাথা বিক্রি করেননি। হাদি কোনো ব্যক্তি নন, তিনি একটি নৈতিক অবস্থান; তিনি একটি জাতির বিচ্যুত বিবেককে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার এক জীবন্ত ইশতেহার।

নৈতিকতার সঙ্কট বনাম রাজনৈতিক আবর্ত

আমাদের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো- আমরা সত্যকে দলীয় চশমায় দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শহীদ হাদি এই বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক ছিলেন না। ছিলেন জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো এক নিঃসঙ্গ শেরপা। কিন্তু বজ্রকণ্ঠ। দলীয় পতাকার নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সুবিধাবাদী রাজনীতি তিনি করেননি; বরং উচ্চারণ করেছিলেন সেই তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য- ‘আমি দল বেছে নিলে জনগণকে ছোট করা হবে।’ এই একটি বাক্য বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের দলদাস রাজনীতির মুখে প্রচণ্ড এক চপেটাঘাত। যেখানে দলই শেষ কথা, যেখানে নেতার আনুগত্য যোগ্যতা, সেখানে হাদি জনগণকে চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝিয়েছিলেন, রাজনীতি শুধু ক্ষমতার ভাগাভাগি নয়, রাজনীতি মানে মানুষের মর্যাদা সমুন্নত করা।

হাদি রাষ্ট্রকে বিপদগ্রস্ত করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের আত্মা বা তার নৈতিক ভিত্তিটি মেরামত করতে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সামনে আয়না ধরেছিলেন তিনি। স্পষ্ট করে তিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সঙ্কট অর্থনৈতিক নয়, নৈতিক।’ শাসকগোষ্ঠীর জন্য সত্যটি ছিল সবচেয়ে ভীতিপ্রদ। কারণ অর্থনৈতিক সঙ্কট পরিসংখ্যান দিয়ে আড়াল করা যায়, মেগা প্রজেক্টের চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে রাখা যায়; কিন্তু নৈতিক সঙ্কট যখন মানুষের চোখে প্রশ্ন হয়ে ফুটে ওঠে, তখন কোনো বুলেট সেই প্রশ্নকে নিভিয়ে দিতে পারে না।

নির্লোভ জীবন : বিপ্লবীর প্রথম শর্ত

শরিফ ওসমান হাদির কোনো বিলাসী ফ্ল্যাট ছিল না, ছিল না পাহাড়সম ব্যাংক ব্যালেন্স কিংবা বিদেশী ডিগ্রির জৌলুশ। বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতেন। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ নামে যে সাংস্কৃতিক লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, সেখানে কর্মী ছিল হাতেগোনা। কিন্তু এই স্বল্পতাই ছিল তার প্রকৃত শক্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘উচ্ছিষ্ট খেয়ে বিপ্লবী হওয়া যায় না’। আজকের ভোগবাদী সমাজে, যেখানে আদর্শ বিক্রি করে পদ-পদবি কেনা অত্যন্ত সহজ, সেখানে হাদি ছিলেন এক অনন্য ব্যতিক্রম। যার হারানোর কিছু নেই। যাকে কেনা যায় না, তাকে ভয় দেখানো যায় না। আপসহীন এই চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। হাদি প্রমাণ করেছেন, বিপ্লব কোনো শোরুমের সাজানো আসবাব নয়; বিপ্লব হলো অন্তরের এক বিশুদ্ধ দহন, যা ভোগবাদের কলুষতা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

সংখ্যা নয়, প্রভাবই ইতিহাস লেখে

১৯৯৩ সালে জন্ম নেয়া শরিফ ওসমান হাদির বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর। জাগতিক হিসাবে বয়সটি হয়তো খুবই ছোট; কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, জীবনে কত বছর বাঁচা হলো তা কোনো দিন বড় ছিল না; বরং কী রেখে যাওয়া হলো সেটি ছিল মুখ্য। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে, উঁচু পদে বসে, কোনো প্রশ্ন না তুলে নিঃশব্দে মরে যাওয়া মানুষের ভিড়ে পৃথিবী সয়লাব। ইতিহাস তাদের মনে রাখে না। ইতিহাস তাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়, যারা সময়কে অস্বস্তিতে ফেলে; যারা ঘুমন্ত মানুষের কানে সজোরে নৈতিকতার ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।

হাদি দেখিয়ে দিয়েছেন, প্রভাবহীন ৫০ বছর বাঁচার চেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী কয়েকটি বছর বাঁচাই প্রকৃত গৌরব। তার স্বল্পায়ু জীবনের ব্যাপ্তি হিমালয়ের উচ্চতাকেও হার মানায়, কারণ তিনি একটি আদর্শিক মানদণ্ড তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়েও কিভাবে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়।

মৃত্যু নয়, এক সচেতন প্রস্তুতি

হাদি জানতেন কী আসছে। তিনি জানতেন, যে পথে তিনি হাঁটছেন, তার শেষ পরিণতি কী হতে পারে। তবু তিনি থামেননি। ২০২৫ সালের ৩১ জুলাই তার সেই উচ্চারণ কোনো সাময়িক আবেগ ছিল না; বরং তা ছিল একজন প্রস্তুত মানুষের চূড়ান্ত ঘোষণা- ‘হারাম খাইয়া আমি এত মোটাতাজা হই নাই যে, স্পেশাল কফিন লাগবে।’ এই কথা ছিল নিজের জীবনের সততার ওপর দাঁড়িয়ে এক পরম আত্মবিশ্বাস। এটি কোনো সস্তা রোমান্টিকতা নয়; বরং এটি ছিল এক মহৎ জীবনের হিসাবের প্রশান্তি।

একটি ভীতু ব্যবস্থার স্বীকারোক্তি

হাদির মৃত্যু একটি বার্তা- এমন একটি ব্যবস্থার বার্তা, যা যুক্তি এবং প্রশ্ন সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। হাদি নিজেই বলতেন, ‘যারা প্রশ্নকে ভয় পায়, তারাই গুলি চালায়’। যখন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো শক্তি যুক্তির বদলে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে, তখন বুঝতে হবে সেই ব্যবস্থা ভেতর থেকে পচে-গলে গেছে। হাদিকে হত্যা করা মানে কেবল একজন মানুষকে হত্যা করা নয়; বরং একটি প্রশ্নকে চিরতরে থামিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু ঘাতকরা ভুলে গিয়েছিল, দেহ নশ্বর কিন্তু চেতনা টেকসই। তারা হাদিকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল; কিন্তু তারা আসলে তাকে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। তার রক্ত আজ প্রতিটি তরুণের রক্তে দ্রোহের বীজ বপন করে দিয়েছে।

নৈতিক দ্রোহের উত্তরাধিকার

আমরা হাদির জীবন থেকে কী শিখলাম? তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, নিরাপদ থাকা মানে সঠিক থাকা নয়। তিনি শিখিয়ে গেছেন, নীরব থাকা মানে বাঁচা নয়; বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মরে যাওয়াও এক গভীর সার্থকতা। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হলো সময়ের সবচেয়ে বড় কর্তব্যকাজ।

হাদির জীবনবোধ আমাদের বলে দেয়- স্বাধীনতা মানে কেবল একটি পতাকা নয়, স্বাধীনতা মানে হলো ভয়হীন চিত্তে সত্য বলার অধিকার। তিনি তার যাপিত জীবনের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, যখন সত্যের জন্য কেউ দাঁড়ায়, তখন বন্দুকের নলও তার সামনে নতজানু হয়ে যায়।

শেষ কথা নয়, শুরুর কথা

শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু কোনো পরিসমাপ্তি নয়; এটি একটি নতুন জাগরণের সূচনা মাত্র। যে আগুন তিনি দেশবাসীর মনে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন, তা নেভানোর সাধ্য কারো নেই। প্রত্যেক তরুণের ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাসে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর যৌক্তিক প্রতিবাদে এবং প্রতিটি অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানো মুহূর্তে হাদি ফিরে আসবেন বারবার। ফিরে আসবেন শোষিতের আর্তনাদে এবং শোষকের দুঃস্বপ্নে।

হাদি চলে গেছেন; কিন্তু রেখে গেছেন এক আদর্শ বোধ। তার সেই অমোঘ সত্য আজও আমাদের কানে বাজে- দেহকে গুলি থামিয়ে দিতে পারে; কিন্তু সত্যের যাত্রাপথ রুদ্ধ করার ক্ষমতা কোনো মারণাস্ত্রের নেই। হাদি আজ কোনো ব্যক্তি নন, তিনি এক চিরন্তন স্লোগান- ‘গুলি থামাতে পারে দেহ, থামাতে পারে না সত্য’। এই নৈতিক দ্রোহের মশাল এখন বিবেকবান প্রত্যেক মানুষের হাতে। সেই মশাল জ্বলছে এবং জ্বলতেই থাকবে।

লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক