রাজনীতিকদের জনগণের ভাষা বুঝতে হয়

নেতাদের মুখে আওয়ামী বয়ান তুলে দিয়ে বিএনপি কী সুবিধা পাবে সেটাও তাদেরই ভাবার কথা। আমরা শুধু বলতে পারি এতে দলটির ভাবমর্যাদার ক্ষতিই হচ্ছে। বিএনপির জনপ্রিয়তা কমছে। দলটির এই অবস্থান পতিত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে সহায়ক হবে।

জনগণকে নিয়েই রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদকে জনগণের কল্যাণেই কাজ করতে হয়। এ জন্য রাজনীতিককে জনগণের ভাষা বুঝতে হয় এবং জনগণের চিন্তাচেতনা মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হয়। তাদের জনগণের দুঃখ কষ্ট বুঝতে হয়, বিপদে আপদে জনগণের পাশে থাকতে হয় এবং জনগণের সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হয়। জনগণের ভাষা বুঝলেই তারা জনগণের প্রত্যাশার অনুকূলে কাজ করতে পারেন। তখন রাজনীতিবিদদের প্রতি জনসমর্থন বাড়ে। তাদের ওপর জনগণ আস্থা রাখে। তারা জনগণের সম্মানের পাত্রে পরিণত হন। অন্য দিকে রাজনীতিবিদরা যদি জনগণের ভাষা না বোঝেন, জনগণের চিন্তাচেতনা, মূল্যবোধকে অসম্মান করেন এবং জনগণের পাশে না দাঁড়ান তাহলে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, জনসমর্থন হারান এবং জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হন।

সাম্প্রতিককালে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষোভ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশেও বিভিন্ন সময়ে জনগণের আন্দোলন হয়েছে। জনগণের এই বিক্ষোভ একপর্যায়ে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং সরকার পদত্যাগ করে। জনগণের এই আন্দোলনে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে এবং ২০২৫ সালে নেপালে সরকার পতন হয়। এসব দেশের শাসকরা প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরা জনগণের কল্যাণে কাজ করেননি বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের অধিকার হরণ করেছেন এবং জনগণের ওপর দমন নিপীড়ন চালিয়েছেন। কিন্তু কারোই শেষ রক্ষা হয়নি। এরা স্বৈরাচার উপাধি পেয়েছেন, জনগণের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন এবং ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। এরা জনগণের ভাষা বোঝেননি এবং বুঝতে চাননি।

আপনি যতই জনপ্রিয় হন না কেন, যদি জনগণের ভাষা না বোঝেন এবং জনকল্যাণে কাজ না করেন তাহলে সময়ের ব্যবধানে জনপ্রিয়তা হারাবেন। আবার অজনপ্রিয় হয়েও আপনি যদি জনগণের ভাষা বোঝেন এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করেন, তাহলে একসময় জনপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারেন। এটাই সত্য।

স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান কখনো জনগণের ভাষা বুঝতে চাননি। তিনি ইচ্ছামাফিক একবার প্রধানমন্ত্রী, আরেকবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তিনি রক্ষীবাহিনী গঠন করে সিরাজ সিকদারসহ জাসদের প্রায় ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছেন। প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়, যাতে লাখো মানুষ মারা যায়। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসন বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং নিজের পছন্দের চারটি ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করেছিলেন। ফলে একসময়ের অতি জনপ্রিয় এই নেতা দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। তিনি যদি জনগণের ভাষা বুঝতেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করতেন তাহলে তার এই পরিণতি হতো না।

শেখ হাসিনা ও তার দলও ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে যা ইচ্ছা তাই করেছে। পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ১৫ বছরে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার করে বিদেশে পাচার, বিরোধী মতের লোকদের মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, ব্যবসায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা দখল, গুম, খুন, আয়নাঘর, বিরোধী মতের গণমাধ্যম বন্ধ ও সাংবাদিকদের নির্যাতন হাসিনার অন্ধকার শাসনের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে।

বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, অথচ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে তারাই তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। তাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন বিরোধী দল বয়কট করে এবং ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে ভোট বাক্স পূরণ করা হয়। হাসিনার সময়ে আইন-আদালত বলে কিছু ছিল না। অনেক রাজনীতিবিদকে বিচারের নামে স্রেফ হত্যা করেছে, অনেকেই বছরের পর বছর জেল খেটেছে। মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে, চলাফেরা করতে এবং নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারেনি। সর্বত্র ছিল ভয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ছিল না। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতি ছিল লাগামহীন। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তার বাড়ির পিয়নও চার শ’ কোটি টাকার মালিক হয়েছে, হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। পুলিশ, প্রশাসন, বিচারালয়সহ সবকিছুকেই দলীয়করণ করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের অবজ্ঞা এবং আলেম সমাজকে নির্যাতন করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় ভারতের স্বার্থে কাজ করেছে। এমনকি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও দ্বিধা করেনি। এসব কারণে জনগণ ছিল অসন্তুষ্ট। কিন্তু শেখ হাসিনা ও তার দল কখনো জনগণের মনোভাব বুঝতে চায়নি। ফলে তাদেরও করুণ পরিণতি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সমর্থন করেনি। অন্য দিকে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে বিএনপি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মূলত আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবেই বিএনপির জন্ম। বিএনপি ছাড়াও দেশে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী কিছু দল আছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এদের অন্যতম। বিএনপি জামায়াত দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি সরকার গঠন করে এবং ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত যৌথভাবে সরকার গঠন করে। দু’টি দল একসাথে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া এবং জনাব তারেক রহমান কখনোই জামায়াতকে নিয়ে কটূক্তি করেননি। অথচ বিএনপির কিছু নেতা এখন জামায়াতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেয়। আওয়ামী লীগ পরবর্তী সময়ে যেখানে দল দু’টির মধ্যে ঐক্য সবচেয়ে প্রয়োজন, তখন বিএনপির কিছু নেতা জামায়াতকে নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলেন। তারা আওয়ামী বয়ান প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছেন। এসব বক্তব্য বিএনপির আদর্শ, নীতি ও দর্শনের সঙ্গে কতটা যায় তা বিএনপির নেতৃত্বই ভালো জানে। আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন বাম দল থেকে বিএনপিতে যোগ দেয়া কিছু নেতা এ জন্য দায়ী। তারা অতীতে জনগণের ভাষা বোঝেননি এখনো বোঝার অবস্থায় আছে বলে মনে হয় না।

নেতাদের মুখে আওয়ামী বয়ান তুলে দিয়ে বিএনপি কী সুবিধা পাবে সেটাও তাদেরই ভাবার কথা। আমরা শুধু বলতে পারি এতে দলটির ভাবমর্যাদার ক্ষতিই হচ্ছে। বিএনপির জনপ্রিয়তা কমছে। দলটির এই অবস্থান পতিত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে সহায়ক হবে। সুতরাং বিএনপিকে এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। বিএনপিকে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তা না হলে সময়ের ব্যবধানে বিরূপ ফল অনিবার্য। ছলচাতুরীর রাজনীতি এবং বেফাঁস কথাবার্তা জনগণ শুনতে চায় না। নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করে গঠনমূলক এবং ইতিবাচক রাজনীতির দিকে না ফিরলে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। ডাকসু ও জাকসুর নির্বাচনী ফলাফল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

লেখক : প্রকৌশলী