বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসে যে কয়জন নেতার নাম মানুষের হৃদয়ে অমোচনীয়ভাবে লিখিত রয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া তাদের শীর্ষে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি জীবনযুদ্ধে লড়ছেন। খালেদা জিয়াকে নিয়ে পুরো দেশ গভীর মানসিক অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত। হৃদয় শূন্য হয়ে আসা মানুষ শুধু প্রার্থনা করছে। তারা চায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে তাকে স্মরণ করছে, একজন রাষ্ট্রনায়ক, একজন সংগ্রামী নারী, একজন অবিচল নেত্রী হিসেবে- যিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তার নেতৃত্বের প্রথমপর্বেই ইতিহাস তাকে কঠিনতম পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৯১ সালে দায়িত্ব গ্রহণের সময় তিনি যে বাংলাদেশ পেয়েছিলেন- তা ছিল সামরিক শাসনের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়ানো একটি দেশ। সেই সময় গণতন্ত্র ভঙ্গুর, অর্থনীতি দুর্বল, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল ধারাবাহিক অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না; তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার প্রধান অবলম্বন। তার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের গণভোটে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়- যা শুধু একটি দল বা সরকারের বিজয় নয়; এটি ছিল জনগণের বিজয়, বাংলাদেশের বিজয়।
গণতন্ত্রের এই পুনর্জাগরণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে নতুন পথ দেখায়। ১৯৯১ সালের আগে বাংলাদেশ একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান, পালাবদল, হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে পড়ে ছিল। কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে আসার মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরে যায়। এই একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দেয়। একে আজো বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি সিদ্ধান্তগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তার সরকার ছিল যুগান্তকারী। ১৯৯১-৯৬ সময়ে বাংলাদেশে প্রথমবার বাজারবান্ধব নীতি কাঠামো শক্তিশালী হয়। তার শাসনামলে প্রথমবার টেক্সটাইল ও আরএমজি সেক্টর টেকসই আকারে বিস্তার লাভ করে। ১৯৯১ সালে যেখানে গার্মেন্টস রফতানি ছিল মাত্র এক বিলিয়ন ডলার, তার সরকারের হাত ধরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়। মাথাপিছু আয় ২৪০ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩২০ ডলারে। ‘বিশ্বব্যাংক’ তার সরকারের অর্থনৈতিক নীতি কাঠামোকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল মডেল হিসেবে বর্ণনা করে।
তার বড় অবদান ছিল নারী শিক্ষায়। Female Secondary School Assistance Programme-এর মাধ্যমে মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর মেয়েরা প্রথমবার বিনামূল্যে শিক্ষার সুযোগ পায়। এই একটি প্রকল্প বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো পাল্টে দেয়। ১৯৯১ সালে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছিল মাত্র ৩৩ শতাংশ; ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। ইউনেস্কো তার এই প্রকল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত করে। আজ বাংলাদেশের যে নারী শিক্ষার অগ্রগতি তার শেকড় বেগম জিয়ার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দৃঢ়তা শুধু উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি ছিলেন দেশের সার্বভৌমত্বের এক অকুতোভয় রক্ষক। ভারতের আগ্রাসী কূটনীতির মুখে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। চুক্তি, পানিবণ্টন, সীমান্ত নিরাপত্তা- প্রত্যেক ক্ষেত্রে তিনি দেশকে মর্যাদা ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তার শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক সম্মান, ভারসাম্য ও জাতীয় স্বার্থের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আন্তর্জাতিক পরিসরে তিনি বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে তিনি এমন নির্যাতন, অপমান ও কারাবরণের শিকার হন যা গণতান্ত্রিক ইতিহাসে বিরল। তার বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ- সবাই একবাক্যে বলে, তাকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করতে কারাগারে নেয়া হয়েছিল। তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়, উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দিতে অস্বীকার করা হয়। যে কারাগারে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানকার অবহেলায় তার হাঁটার ক্ষমতা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার লিভার, কিডনি, হাড়ের জটিলতা, ডায়াবেটিস- সব কিছুই অবনতির দিকে যায় রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা ও কারাবঞ্চনার কারণে। এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক নিষ্ঠুরতার পরিণতি।
বাংলাদেশের মানুষ আজ বুঝতে পারছে, রাষ্ট্র তার প্রতি যে আচরণ করেছে, তা শুধু একটি নেত্রীকে নয়; একটি জাতিকে আঘাত করেছে। তাই তার কষ্ট দুঃখ ও অসুস্থতায় সাধারণ মানুষের চোখে পানি, হৃদয়ে ব্যথা। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে সবাই তাকে শ্রদ্ধা করছে। তিনি এক মহৎ রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত। তার অনুপস্থিতি বিএনপির জন্য শুধু নেতৃত্বের সঙ্কটই সৃষ্টি করবে না; এটি দলের অস্তিত্ব, আদর্শ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলবে। চার দশক ধরে বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বেগম জিয়া। দলের নীতি, সিদ্ধান্ত, আন্দোলন ও জনআন্দোলনের প্রেরণা ছিল মূলত তার ব্যক্তিত্বকে ঘিরে। তার জীবনের সংগ্রাম, নিপীড়ন মোকাবেলার সাহস এবং মানুষের হৃদয়ে তার জনপ্রিয়তা বিএনপির জন্য ছিল এক অবিনাশী শক্তির উৎস। ফলে তার অনুপস্থিতি দলকে এমন এক মানসিক শূন্যতায় নিক্ষেপ করবে, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
বিএনপির ভেতরে সিনিয়র লিডারশিপে বহুদিন ধরে থাকা চাপা প্রতিযোগিতা তার মৃত্যুর পর তীব্র হতে পারে। একদিকে তারেক রহমানের নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক ও আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে সরাসরি মাঠে নেই; অন্য দিকে দেশের নেতৃত্বে থাকা সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য দলকে সাময়িক অস্থিরতায় ফেলতে পারে। তৃণমূলের অনেক কর্মী যাদের রাজনৈতিক পরিচয় মূলত বেগম জিয়ার প্রতি আনুগত্যের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, তার অনুপস্থিতিতে তারা দিকহারা হতে পারেন। এতে সাংগঠনিক কাঠামোর ভাঙন, নেতৃত্ব পুনর্গঠন নিয়ে দ্ব›দ্ব ও দলীয় সক্রিয়তায় বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
তবে এর বিপরীতে আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে- দল এক অভ‚তপূর্ব ঐক্যেও রূপ দিতে পারে। বেগম জিয়ার জীবন ও ত্যাগ বিএনপির জন্য একটি নৈতিক শক্তি, যা নতুন প্রজন্মের নেতাকর্মীদের আরো দৃঢ়ভাবে আন্দোলনমুখী করতে পারে। তার নিপীড়নের ইতিহাস তরুণদের মনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে পারে। দমন-পীড়নে ক্লান্ত বিএনপির তৃণমূলে দলকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে সহায়তা করতে পারে। অতএব, তার অনুপস্থিতি বিএনপিকে বিপর্যস্ত করলেও একই সাথে আন্দোলনের নতুন ঢেউয়ের জন্ম দিতে পারে। এই দ্বিমুখী বাস্তবতা দলটির সামনে একদিকে চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে সম্ভাব্য শক্তি যার ওপর নির্ভর করবে বিএনপির ভবিষ্যতের রাজনীতি। দেশের রাজনীতিতেও তার অনুপস্থিতি ক্ষমতার ভারসাম্য ভেঙে দেবে। জামায়াতে ইসলামী বিএনপির দ্বৈত কাঠামোতে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষমতার ভারসাম্য এক দিক থেকে হেলে পড়বে। এতে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, জনআন্দোলন বা নতুন ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আজ বাংলাদেশের মানুষ বেগম জিয়ার জন্য চোখের পানি ফেলে, প্রার্থনা করে। এই প্রার্থনা শুধু একজন নেত্রীর জন্য নয়; এটি দেশকে আবার স্বাভাবিক পথে ফেরানোর প্রার্থনা, একটি নিষ্ঠুর সময়কে বিদায় জানানোর প্রার্থনা।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক



