আর কোনো নির্বাচিত সরকার যাতে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে সে জন্য বিভিন্ন দল ও মহল থেকে বিভিন্ন দাবি তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একদিকে পৃথক নির্বাচনের, অন্যদিকে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে। পৃথক নির্বাচনের দাবিটি নতুন বলা যাবে না। শেখ হাসিনার আমলেও তোলা হয়েছিল। পৃথক নির্বাচন বলতে বোঝায়, সংসদে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আসন বরাদ্দ রাখা। ওই সব আসনে শুধু ওই সম্প্রদায়ের মানুষই প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারবে। অর্থাৎ মুসলিম আসনে মুসলমানেরা, হিন্দু আসনে হিন্দুরা।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা চালু হয়। ১৯০৯ সালের এই ব্যবস্থা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও ছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে অর্থাৎ গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ পৃথক নির্বাচনব্যবস্থা বিলুপ্ত করে যুক্ত নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এখনও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু নেতা বলে বেড়ান যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হিন্দুদের স্বার্থে আঘাত হানার জন্য পৃথক নির্বাচন চালু করেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার বিলুপ্তির পেছনে হিন্দু নেতাদেরই বড় অবদান ছিল। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ সরকারের উত্থাপিত যুক্ত নির্বাচন বিলটি পাসের পক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্রের’ প্রথম খণ্ডে উল্লেখ আছে। পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির হিন্দু নেতারাও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
কথা হলো, তখন হিন্দু নেতারা মুক্ত নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও এখন কেন পৃথক নির্বাচনের দাবি তুলছেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ইতিহাসের সাহায্য নিতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বি-জাতিতত্তে¡¡র ভিত্তিতে। অর্থাৎ মুসলমানরা এক জাতি আর হিন্দুরা আরেক জাতি। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক হিন্দু ভারত চলে যায় এবং ভারত থেকে অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে আসে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা কমে এবং মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৭ সালের আগে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ ছিল হিন্দু। আর ১৯৫৩ সালের আদমশুমারি অনুসারে, হিন্দু জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২ শতাংশ। সে কারণে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় ৩০৯টি আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ২৩৬টি আসন, হিন্দুদের জন্য ৬৯টি। এ ছাড়া বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি করে মোট দু’টি আসন।
১৯৪৯ সালের ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেক্যুলার ও কমিউনিস্টরা দলটিতে ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং এক পর্যায়ে মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে সক্ষম হয়। যদিও আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টোতে পাকিস্তানে একটি সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্প ব্যক্ত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে একটি সেক্যুলার রাজনৈতিক দলে পরিণত করার পর পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বুঝতে পারেন, পাকিস্তানের বারোটা বাজানোর জন্য আওয়ামী লীগের হাত আরো শক্তিশালী করতে হবে যা কি না হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
সে কারণে তারা যুক্ত নির্বাচনের দাবি তোলেন। হিন্দুদের ২২ শতাংশ ভোট পেলে আওয়ামী লীগকে হারানো কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব না এটি তারা বুঝেছিলেন। তাদের ধারণা সত্য হয় ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে।
যুক্ত নির্বাচনের দাবির ব্যাপারে ভারতীয় লেখক জ্যোতিসেন গুপ্ত তার ‘ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঋৎববফড়স গড়াবসবহঃ রহ ইধহমষধফবংয’ বইয়ে জানিয়েছেন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যখন তুমুল দ্ব›দ্ব চলছিল, তখন শেখ মুজিব কংগ্রেস দলের নেতা শ্রী মনোরঞ্জন ধরের শরণাপন্ন হন এবং কংগ্রেসের সাথে পাঁচ দফা গোপন চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী কংগ্রেস আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য হিন্দু জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন নিশ্চিত করে। বিপরীতে শেখ মুজিব যৌথ নির্বাচনপদ্ধতি প্রবর্তনের, হিন্দুদের হাতছাড়া হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ফেরত দেয়া এবং সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের জন্য ২৩ শতাংশ কোটা রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ মুজিব যখন বাকশাল কায়েম করেন তখন বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের সংগঠন বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগ দেয়।
অনেকেই মনে করেন, যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে অভীষ্ট অর্জিত হওয়ার পর এখন আবার পৃথক নির্বাচনের দাবি তোলারও একটি লক্ষ্য আছে। আর তা হলো, বাংলাদেশকে ভাগ করা। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে যুক্ত নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রাদেশিক আইনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম দফতরের মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘দুই জাতির ভিত্তিতে আমাদের পাকিস্তান হয়েছে। এরপরও যদি আলোচনা করা হয় যে, পাকিস্তানে আমরা দুই জাতি, একটি হিন্দু আরেকটি মুসলমান, তাহলে একটি উত্তেজনার কারণ সৃষ্টি করা হয়। আজ যদি পূর্ব বাংলার এক কোটি হিন্দু বলে যে তাদের জন্য আলাদা জায়গা, অর্থাৎ একটি হিন্দুরাষ্ট্র দিতে হবে, তাহলে কী হবে? পাকিস্তানের খাতিরে, ইনসাফের খাতিরে আমি আমার বন্ধুদের অনুরোধ করব, তারা যেন স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। হিন্দুরা যদি যুক্ত নির্বাচন চায় তাহলে মুসলমানদের আপত্তি করার কী আছে?’ (রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী সম্পাদিত, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা-২০৯) হালের হিন্দু নেতারা আলাদা হিন্দু রাষ্ট্রের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি তুলছেন বলে কেউ যদি ধারণা করেন, তাহলে সেটি অমূলক হবে বলে মনে হয় না।
এখন দেখা যাক, হিন্দু নেতাদের একাংশ কেন পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চাইছেন? পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যদি একযোগ হয়ে কোনো একটি দলকে ভোট দেয় তাহলে তারা প্রায় ৩০টি আসন পাবে। কারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হচ্ছে জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে তারা আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে একটি রেজিস্টার্ড সংখ্যালঘু সংগঠনকেই ভোট দেবে। অর্থাৎ পিআর নির্বাচনকে পৃথক নির্বাচন বানিয়ে ফেলবে। যাতে করে ওই সংগঠনের নির্বাচিত নেতারা নিজেদেরকে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি বলে দাবি করতে পারেন এবং পরে একটি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ খুলতে পারেন। এরকম যদি হয় তাহলে তা হবে আওয়ামী লীগের জন্য বিরাট দুঃসংবাদ। দীর্ঘদিনের ভোটব্যাংক তাদের পরিত্যাগ করলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।