শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনের সময় জনগণের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা ও মতামতকে সম্মান জানিয়ে সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন সেনাবাহিনী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সামনে আসে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। জন-আন্দোলনের নৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
৫ আগস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নির্ধারণমূলক হয়। নিরাপত্তা সঙ্কট, বিশৃঙ্খলা দূর করতে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর মাধ্যমে সেনাবাহিনী পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কার্যকর হয়। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা ও রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আগাম সতর্কতা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সেনাবাহিনী সময়মতো পৌঁছে। সংঘর্ষ বা অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সহায়তা করে।
সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যরা দাঙ্গা, সন্ত্রাস, বা অন্যান্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষ দক্ষ। তাদের উপস্থিতি কেবল বিশৃঙ্খলা রোধেই নয়; বরং পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করতে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও বিশৃঙ্খলার বিস্তার রোধে একটি নির্ভরযোগ্য ও পেশাদার বাহিনী হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের কার্যক্রম এমনভাবে পরিকল্পিত হয় যাতে জনজীবনে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি এড়িয়ে দ্রুত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পুনঃস্থাপন সম্ভব হয়, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও সার্বিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন।
এই সহযোগিতা দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করে, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে। সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া এমন দ্রুত ও সুসংগঠিত সরকার গঠন সম্ভব হতো না।
দেশের সম্মানিত ও বিরল ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসকে সেনাপ্রধান ৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য ফোনের মাধ্যমে আহ্বান জানান। সেনাবাহিনী ড. ইউনূসকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এই পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথ প্রশস্ত করেনি; বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে। সামরিক বাহিনীর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দেশকে সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করে গণতান্ত্রিক ধারাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে সম্পূর্ণ সেনা কমান্ডের জনগণের পাশে দাঁড়ানো একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যখন বিশাল পুলিশবাহিনী ও আমলাতন্ত্র সঙ্কটপূর্ণ সময়ে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সেনাবাহিনীর এই নিবেদন শুধু নিরাপত্তাবাহিনীর প্রতি জনগণের বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে না; বরং দেশের গণতন্ত্র ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলে।
ইউজ (বর্তমানে ইড়ৎফবৎ এঁধৎফ ইধহমষধফবংয) ও জঅই (জধঢ়রফ অপঃরড়হ ইধঃঃধষরড়হ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় এবং সরকারের প্রত্যক্ষ দায়িত্বে থাকে। একইভাবে, উএঋও (উরৎবপঃড়ৎধঃব এবহবৎধষ ড়ভ ঋড়ৎপবং ওহঃবষষরমবহপব) ও ঘঝও (ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু ওহঃবষষরমবহপব) সরকারপ্রধানের অধীনস্থ গোয়েন্দা সংস্থা এবং এগুলো সেনাবাহিনীর অংশ নয়। তাই এ সংস্থাগুলোর কার্যক্রম, নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-কানুন সরকারের অধীনে নির্ধারিত হয়।
২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সামরিক ও নিরাপত্তা ইতিহাসে একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। যদিও সেনাবাহিনী ও তাদের পরিবারগুলো নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে যথাযথ বিচার দাবি করে, পুরো জাতি এই মামলার ন্যায্য ও দ্রুত বিচার প্রত্যাশা করছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও বিচারকার্যক্রমের ওপর বাংলাদেশের জনগণের সজাগ নজর রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক যাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যায়। এ বিচারের মাধ্যমে শুধু সেনাবাহিনী পরিবার নয়, পুরো জাতি শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে পাবে বলে আশা করা যায়।
বিগত সরকারের কিছু মহল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও, পরবর্তীতে সেনাপ্রধানের পেশাদার অবস্থানের কারণে সেই প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সেনাপ্রধান পরিস্থিতি সামাল দিতে চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধার ও বাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। এর ফলে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার পথে অটল থাকতে সক্ষম হয়।
৩ আগস্ট সেনাপ্রধান দরবারের আয়োজন করে জাতীয় সঙ্কটকালে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। এই সময়ে বহিঃশত্রুর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা ছিল প্রবল, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কৌশলগত পদক্ষেপের ফলে সেই আশঙ্কা দূরীভূত হয়। সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। বহিঃশত্রুর ইন্ধনে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলেও, দৃঢ় নেতৃত্ব গোয়েন্দা নজরদারি ও বিচক্ষণ কৌশলের মাধ্যমে সেই ষড়যন্ত্র দ্রুততার সাথে দমন করা হয়। সেনাবাহিনীর ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে বাহিনীর মনোবল অটুট রেখে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হয়।
বিপ্লব-উত্তর সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা যেমন- আনসারদের আন্দোলন, আওয়ামী লীগপন্থী সরকারি কর্মকর্তাদের বিশৃঙ্খলা, গোপালগঞ্জে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নাশকতা সেনাবাহিনী চৌকস নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চক্রান্ত সেনাবাহিনী দৃঢ় হাতে রুখে দেয়াটা প্রমাণ করে, তারা শুধু ভৌগোলিক নিরাপত্তা নয়, সামাজিক ঐক্য রক্ষাতেও অঙ্গীকারবদ্ধ। বিভিন্ন মহল যখন উসকানি ও বিভাজনের মাধ্যমে জাতিকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে, তখন সেনাবাহিনী তৎপর নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার এবং সরাসরি মাঠপর্যায়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এসব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়।
গত এক বছরে সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে সারা দেশে সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে, যা সন্ত্রাস, ভাঙচুর, লুটপাট ও রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রেখেছে। সেনাবাহিনী সাধারণত রাজনৈতিক সঙ্কট ও বিশৃঙ্খলার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন হয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। তারা সংঘর্ষ এবং বিশৃঙ্খলা রোধে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে, যাতে দেশ চরম অস্থিরতা ও অবিচ্ছিন্ন সহিংসতা থেকে বাঁচে। এভাবে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রকে অচলাবস্থা থেকে উদ্ধার করে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে।
যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, তারা প্রায়ই সেনাবাহিনীকে নিজেদের দলীয় প্রভাব ও অনুগত কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করে। এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না; বরং জাতীয় নিরাপত্তাকেও মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলে। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের, কোনো রাজনৈতিক দলের নয়- এই মূল নীতি দুর্বল হয়ে পড়লে দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
তাই সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা জরুরি। এ জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা, পেশাদার প্রশিক্ষণ, মেধাভিত্তিক পদোন্নতি এবং স্বচ্ছ নেতৃত্ব ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। একই সাথে সেনা কমান্ড ও সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, তাদের আনুগত্য শুধু সংবিধান, রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি- কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি নয়। এভাবেই সেনাবাহিনীর মর্যাদা, ঐক্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব।
ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়মবহির্ভূত ও শৃঙ্খলাভঙ্গমূলক কার্যকলাপের জন্য কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে এবং অনেকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির আওতায় গিয়েছেন। এই পদক্ষেপ শুধু বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখার জন্য নয়; বরং একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ- সেনাবাহিনীতে কেউই আইন ও নীতিমালার ঊর্ধ্বে নয়।
এ ধরনের দৃঢ় ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা বাহিনীর অভ্যন্তরে অনৈতিক প্রভাব, রাজনৈতিক পক্ষপাত এবং অসদাচরণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একই সাথে এটি প্রমাণ করে, বাহিনীর নেতৃত্ব সততার সাথে প্রতিষ্ঠানটিকে সুরক্ষিত ও নিরপেক্ষ রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।
রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঠিকমতো সমাধান না হওয়ার ফলে, সেনাবাহিনীকে বারবার আলোচনার টেবিলে এনে তাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করবে।
সেনাপ্রধানের প্রতি আস্থা অটুট রাখা দেশের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন।
একইভাবে বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বা অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মনোবল ক্ষুণ্ণ করা হলে তা দেশের নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটাতে পারে। তাই জাতীয় স্বার্থে তাদের কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন বজায় রাখতে হবে।
লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি



