প্রধান উপদেষ্টা সমীপে কিছু কথা

এদের বিরুদ্ধে যতই শক্ত অবস্থানে যাবেন বাংলাদেশের কোনো নেতা, ততই তিনি হবেন বাংলাদেশের পরমাত্মীয়, গণ-মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক, যেমনটা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রবক্তা শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান।

নয়া দিগন্ত

ঐতিহাসিক জুলাই গণ-আন্দোলনের মূল চেতনা, ধারা-পরম্পরা এবং এর ‘স্পিরিট’ হৃদয়ে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বিপ্লবের সুফলভোগী এবং উত্তরসূরিরা। তা না হলে এই জগৎ কাঁপানো গণ-জাগরণের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং চেতনাকে আমরা এত দ্রুত নিষ্প্রভ হয়ে যেতে দেখতাম না; আধিপত্যবাদী ভারত ও তার গৃহভৃত্য বাকশালী স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য রচনার এমন সুবর্ণ সুযোগ প্রায় হাতছাড়া করতাম না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিলম্বে হলেও অপশক্তির রাজনীতি, স্বৈরাচারের দোসরদের নৈরাজ্য সৃষ্টির যে কোনো চেষ্টা সহ্য না করার যে দৃঢ় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সে জন্য দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তাকে মোবারকবাদ জানাই। এতদিনে তিনি কাণ্ডারি, রাহবারের মতো জনগণের মনের কথাটি প্রকাশ করেছেন। তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীপ্রধানদের সাথে এক জরুরি সভায় দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং এ জন্য একটি কমান্ড সেন্টার গঠনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সর্বোচ্চ আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা উদ্ভ‚ত পরিস্থিতি দ্রুত ও কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে পারে। বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণ এবং ভ‚মিকার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনী প্রধানগণকে স্বৈরাচারের যেকোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো তিনি সতর্ক ও অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়ে চাঁদাবাজ ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানোর জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে বলেন। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশকে গণহত্যা, নিপীড়নসহ স্বৈরাচারের যাবতীয় অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে গিয়ে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন হয়রানির শিকার না হতে হয় তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাই কর্তব্যরত বাহিনীকে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার তাগিদ দেন।

এই কঠোর ব্যবস্থা ও নির্দেশনাবলি সময়ের দাবি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষকে জনগণ কোমল ও স্পর্শকাতর বলে বা দুর্বল শাসক হিসেবে গণ্য করতে থাকার মতো দীর্ঘ কয়েক মাসের কিছুটা নির্লিপ্ততা এবং মধ্যপন্থার আশ্রয় নেয়ার মতো মূল্যায়ন করতে থাকার প্রেক্ষাপটে সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টার এই কঠোর অবস্থান দেশবাসীর কাছে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং ব্যতিক্রমধর্মী।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকে বলব, আপনি উদার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হোন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীলদের প্রতি; একই সাথে একইরকম কঠোর হোন গণতন্ত্র হত্যাকারী, গুম-খুন-নিপীড়ন ও নির্যাতনে বিশ্বাসীদের প্রতি। এ দেশে গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাস করে না আওয়ামী লীগ, তাদের চ্যালা চামুণ্ডা, ভারতপন্থী প্রকাশ্য ও গোপন দল বা লেজুড় সংগঠনগুলো। একইভাবে নাস্তিক বুদ্ধিজীবী চক্র, উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতের বাংলাদেশী প্রতিনিধি, স্বৈরাচারের প্রতিপালিত ঠগ ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক কাঠামোতে থেকে যাওয়া ও সদ্য ভোল পাল্টানো কর্মকর্তা, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট চক্র, সুবিধাভোগী অর্থ লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী, অসাধু পেশাজীবী দালাল শ্রেণীও বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বে আস্থাশীল নয়। এরা বহালতবিয়তে থাকলে যে সর্বনাশ খুনি স্বৈরাচার করে গেছে তা থেকে কারো পক্ষেই দেশ, জনগণ এবং জনস্বার্থকে রক্ষা করা অসম্ভব হবে। এটি তো স্পষ্ট যে, একটি মহল চোরে চোরে মাসতুতো ভাই হয়ে এখনো হুমকি দিচ্ছে স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের, আবদার করছে তাদের ফিরে আসার ও ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরির।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি বিপ্লবের ফসল। এক বর্ষণসিক্ত সকালে আপনি বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে দৃঢ় পদক্ষেপে গণহত্যার শহীদদের সোপানে ফুল দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন। জনগণের আনুগত্য ও ভালোবাসা জুলাইয়ের বর্ষণ হিসেবে রহমতের প্রতীক হয়ে সিক্ত করেছিল আপনাকে। কাজেই নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা, আপসকামিতা ও গণশত্রুদের প্রতি আপনার মমতা ও দরদ একসাথে অবস্থান করতে পারে না। অনেক সময় পাণ্ডিত্য রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়। চিত্তকে অসওয়াসার খপ্পরে ফেলে। নানা দ্বিধাদ্ব›দ্ব অর্কমণ্যতায় সৎ ও যোগ্য শাসককেও পথভ্রান্ত করে। অবিমিশ্রকারিতায় ভোগায়। এতে সাধারণ মানুষ তাদের আস্থাটা প্রত্যাহার করে নেয়, নিতে বাধ্য হয়। তাদের আস্থা ও আনুগত্যে চিড় ধরে। জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ‘সংস্কার’ সাধনের পর এবং বহুমাত্রিক, বহুপক্ষীয় ও বহুবাচনিক প্রক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিতে বিশ্বাসী হয়ে দেশ শাসনের বিধি-বিধান, প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বৈরাচারমুক্ত করে খাতভিত্তিক সংস্কার আনলেই কেবল সেই সংস্কার টেকসই হবে এবং তার বৈধতা প্রশ্নাতীত হবে।

ঘোড়ার আগে নিশ্চয়ই গাড়ি জুড়ে দেয়া যায় না। কাজেই দেশ ও জাতির সামনে এখন অগ্রাধিকার গন্তব্য (চৎরড়ৎরঃু উবংঃরহধঃরড়হ) হচ্ছে ‘সংস্কার’ ও তার পর সার্বজনীন ভোটাধিকারের প্রয়োগ সাপেক্ষে একটি আইনসভা (সংসদ) প্রতিষ্ঠা করা। বহু দেশে আগে আইন প্রণয়নকারী অ্যাসেম্বলি নির্বাচন করা হয় এবং সেই অ্যাসেম্বলির গরিষ্ঠসংখ্যক আইন প্রণেতার ভোটে বা সমর্থনে আইনসভায় বসেই সংস্কার আনা হয়; ঠিক যেমনটির বিধান দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার আইন কাঠামো অধ্যাদেশের মাধ্যমে খবমধষ ঋৎধসবড়িৎশ ঙৎফবৎ (খঋঙ) বিধানে। এই বিধান প্রণয়নের জন্য সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শরণাপন্ন হয়েছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. জি. ডবিøউ. চৌধুরীর এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সংবিধান বিশেষজ্ঞ সর্দার মেহমুদের মতো পণ্ডিতবর্গের। তারা সামরিক শাসকের সুদূরপ্রসারী রাষ্ট্রনৈতিক দূরদর্শিতার প্রতীক এই এলএফও অধ্যাদেশ প্রণয়নে সহায়তা করেন। পৃথিবীর শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে বিনা রক্তপাতে একটি সামরিক একনায়কত্ব থেকে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোয় উত্তরণের তথা পাকিস্তানে গণতন্ত্রে শুভসূচনার একটি আইনগত ভিত্তি হতে পারত এই আইনগত কাঠামো অধ্যাদেশটি।

পরিতাপের বিষয় কেন পাকিস্তান হয়েছিল, কেন আমাদের পূর্বপুরুষরা ভারতে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, সেই ধারণা বা দর্শন হৃদয়ে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন পাকিস্তানের ১৯৭০ দশকের সব পক্ষই; না পাকিস্তানি ভ‚স্বামীরা, ক্ষমতালোভী পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী, বিশেষ করে, পদস্থ সেনা কর্মকর্তারাও। মাঝখান থেকে স্বাধীনতা চেয়ে আমরাই ভারতের নীল নকশার শিকার হয়েছি। অনুরূপভাবে বলতেই হচ্ছে, জুলাই (২০২৪)-এর ঐতিহাসিক গণবিপ্লব তথা ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মূল চেতনা, ধারাপরম্পরা এবং এর ‘স্পিরিট’ হৃদয়ে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বিপ্লবের সুফলভোগী এবং উত্তরসূরিরা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নীরব বিপ্লব দেশে-বিদেশে সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। তবে সংস্কারের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে যত দ্রুত নির্বাচন দেয়া হবে ততই তা হবে দেশ ও রাষ্ট্রের নতুন বিন্যাস সোপান রচনার জন্য মঙ্গলজনক। এই নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব জুলাই-আগস্টের মহাজাগরণে তরুণ প্রজন্মের আত্মোৎসর্গের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান ও স্বীকৃতি জ্ঞাপন। এখনো হাজার হাজার প্রতিবাদী তরুণ-যুবক পঙ্গুত্বে অসহায়ত্ব নিয়ে জীবন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালের বেডে কিংবা ক্র্যাচে ভর করে। তাদের যথাযোগ্য চিকিৎসার রাষ্ট্রীয় সংস্থান এবং সহযোগিতা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। যেভাবে আমরা ভুলে গেছি ’৭১-এর রণাঙ্গনে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী বীরশ্রেষ্ঠদের, ভুলে গেছি স্বাধীনতার মহানায়ক বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীকদের সহ হাজার হাজার বাঙালি সেনানী ও কর্মকর্তাদের যুদ্ধযজ্ঞ, লাখ লাখ গেরিলা যোদ্ধাদের, ঠিক একইভাবে কি আমরা ভুলে যেতে বসেছি জুলাই-আগস্টের বীরশহীদ ও সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, রিকশাবাহক, সাধারণ ছাত্র-জনতার অবদান এবং সংগ্রামকে? স্বৈরাচার পুনর্বাসনের জন্যই কি তারা জীবন দিয়েছিল, পঙ্গুত্ববরণ করেছিল? সাধারণ মানুষ যে বলেছে এটা ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা, এর পরম তাৎপর্য ও নিগূঢ় রাজনৈতিক তাৎপর্য কি আমাদের উদাসীনতার ধুলায় ঢেকে যাবে?

তাই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও তার সহযাত্রী সব উপদেষ্টা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার সাথে সমন্বিত ও সম্পৃক্ত সবার প্রতি আকুল আবেদন : জুলাই বিপ্লবের মূল রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি এবং মর্মবাণী, এর রাজনৈতিক তাৎপর্য ও আর্থসামাজিক গুরুত্বকে অন্তরের অন্তঃস্থলে ধারণ করুন। যত বেশি গভীর হবে এই অন্তর্দৃষ্টি ও অনুভব তত বেশি উপদ্রবমুক্ত হবে আমাদের রাষ্ট্রসত্তা এবং সংহত হবে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং কায়েমি জাতীয় ঐক্য। তারা প্রাণ দিয়ে রক্তের অক্ষরে ডাক দিয়ে গেছে আমাদের অকর্মণ্য, নির্লিপ্ত ও উদাসীন চৈতন্যকে। আমাদেরকে অবশ্যই নির্মোহ হতে হবে এবং ভারতীয় জুজুবুড়ির ভয়কে জয় করতে হবে। যে বর্ণবাদী অগণতান্ত্রিক ভারত কাশ্মিরে পারে না, কাঠমান্ডুতে পারে না, থিমপু-তে (ভুটানে) পারে না, দ্বীপদেশ মালদ্বীপে গলাধাক্কা খায়, নেপালে পারে না, শ্রীলঙ্কায় পারে না, সে পারবে বেঙ্গল টাইগারের সাথে? কোনো তুলনা চলে কি মোদির সাথে ভুবনজয়ী জনপ্রিয় ড. ইউনূসের? ড. ইউনূস একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তার বৈশ্বিক জনপ্রিয়তায় গাত্রদাহ ভারত-হাসিনা কুচক্রীদের। কী অপমান, কত অসম্মান অপদস্থই না স্বৈরাচারী খুনি হাসিনা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করেছে! ড. ইউনূস অবগত আছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বার্থের শত্রুরাষ্ট্র হলো ভারত এবং তাদের কেনা গোলাম আওয়ামী-বাকশাল-কমিউনিস্ট-নাস্তিক চক্র। এদের বিরুদ্ধে যতই শক্ত অবস্থানে যাবেন বাংলাদেশের কোনো নেতা, ততই তিনি হবেন বাংলাদেশের পরমাত্মীয়, গণ-মানুষের আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক, যেমনটা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রবক্তা শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক