পিআর পদ্ধতি : সমস্যা ও সংস্কারের উপায়

ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া দল আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের রাস্তা করে না দিতে চাইলে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে দেশবাসীকে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে।

মো: একরামুল্লাহিল কাফি

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এ প্রতিনিধিত্ব যত বেশি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, গণতন্ত্র তত শক্তিশালী হবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (প্রোপর্টশনাল রিপ্রেজেনটেশন-পিআর) পদ্ধতি এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদীয় আসন পায়। এ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো- সব শ্রেণী, মতাদর্শ এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।

বিভিন্ন দেশে পিআর পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে এবং কিছু দেশে এটি সফলও হয়েছে। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে পিআর পদ্ধতিতে হয় সেজন্য জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বোধগম্য কারণে এর বিরোধিতা করছে। এমতাবস্থায় দেশে একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বহুলকাক্সিক্ষত নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ পিছিয়ে যাওয়াসহ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ পদ্ধতির ভালো ও মন্দ দিক এবং এর সংস্কার করে আরো কিভাবে সময় ও দেশোপযোগী করা যায় তার একটি নমুনা তুলে ধরা হলো।

এ ব্যবস্থার ভালো দিকগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চরমপন্থী দলের উত্থান, স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের অভাব, স্বচ্ছতার সঙ্কট ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা। এ প্রবন্ধে আমরা পিআর পদ্ধতির প্রধান সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করব এবং সফল সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলোর আলোকে সম্ভাব্য সমাধান উপস্থাপন করব।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রধান সমস্যাগুলো

১. রাজনৈতিক বিভাজন ও সরকারের অস্থিতিশীলতা : পিআর পদ্ধতি সাধারণত বহুদলীয় রাজনীতির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এতে নির্বাচনে কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না, ফলে সরকার গঠনে জোট বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। এ ধরনের জোট সরকার প্রায় স্বল্পস্থায়ী ও অস্থির হয়, কারণ দলগুলোর মধ্যে মতভেদ সহজে সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ-

ইসরাইল : দেশটির ৩.২৫ শতাংশ ন্যূনতম ভোট থ্রেশহোল্ড থাকা সত্তে¡ও ছোট দলগুলো সহজে সংসদে প্রবেশ করে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশটিতে পাঁচবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা স্পষ্ট করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাত্রা।

ইতালি (১৯৪৬-৯৪) : এ সময়ে দেশটিতে ৬০টির বেশি সরকার গঠিত হয়েছে ও ভেঙেছে। পিআর পদ্ধতির ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

২. দুর্বল নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব : তালিকাভিত্তিক পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়; বরং একটি রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন। ফলে, সংসদ সদস্যদের সাথে ভোটারদের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে ওঠে না, যা গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কমিয়ে দেয়। উদাহরণ-

নেদারল্যান্ডস : এখানে দেশটিকে একটি একক নির্বাচনী এলাকা হিসেবে ধরা হয়, যার ফলে সংসদ সদস্যরা নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করেন না।

দক্ষিণ আফ্রিকা : এমপিরা ভোটারদের নয়; বরং দলীয় কমান্ডের কাছে বেশি জবাবদিহি করেন, ফলে স্থানীয় জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।

৩. চরমপন্থী দলের উত্থান : পিআর পদ্ধতিতে ভোটের থ্রেশহোল্ড যদি খুব কম হয়, তাহলে সামান্য জনপ্রিয়তা পাওয়া দলগুলোও সংসদে প্রবেশ করতে পারে। এতে করে চরমপন্থী বা গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী দলগুলো রাষ্ট্রশক্তির অংশ হতে পারে। উদাহরণ-

জার্মানি : ডানপন্থী ও অভিবাসনবিরোধী দল এএফটি (অষঃবৎহধঃরাব ভহৃৎ উবঁঃংপযষধহফ) ১০ শতাংশ ভোট পেয়ে সংসদে প্রবেশ করেছে।

গ্রিস : চরমপন্থী নব্য-নাৎসি দল ‘গোল্ডেন ডন’ পিআর ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সংসদে প্রবেশ করে।

৪. গোপন জোট চুক্তি ও স্বচ্ছতার অভাব : পিআর পদ্ধতিতে সরকার গঠনে জোট গঠন প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে এ জোট গঠন প্রক্রিয়া গোপনে সম্পন্ন হয়, যেখানে দলীয় নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির দরকষাকষি চলে। এতে সাধারণ ভোটারের জানার ও অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। উদাহরণ-

বেলজিয়াম : ২০১০-১১ সালে সরকার গঠনে ৫৪১ দিন লেগেছিল। এ সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির অস্বচ্ছ আলোচনা চলে।

ইরাক : এখানে ধর্মীয় ও গোত্রীয় দলগুলোর মধ্যে গোপন চুক্তির মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়, যা প্রায়ই বিভাজন সৃষ্টি করে।

৫. ধীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিগত অচলাবস্থা : বহুদলীয় জোট সরকারের মধ্যে সমঝোতার অভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয়। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় কার্যকারিতা ব্যাহত হয়। উদাহরণ-

ভারতের রাজ্যসভা : পিআর-ভিত্তিক এ কক্ষে যদি ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে, তাহলে আইন পাশ করাতে বাধা সৃষ্টি হয়।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সংস্কার : সফল উদাহরণ

১. নির্বাচনী থ্রেশহোল্ড প্রবর্তন : পিআর ব্যবস্থায় একটি ন্যূনতম ভোটের সীমা (থ্রেশহোল্ড) নির্ধারণ করা হলে খুব ছোট দলগুলোর সংসদে প্রবেশের পথ বন্ধ হয়। এটি চরমপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দল নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। সফল উদাহরণ-

জার্মানি : এখানে ৫ শতাংশ ভোট না পেলে কোনো দল সংসদে আসন পায় না, যা চরমপন্থী দল নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

সুইডেন : ৪ শতাংশ থ্রেশহোল্ড ব্যবস্থা ছোট দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছে।

২. মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক (এমএমপি) পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে ভোটাররা দু’টি ভোট দেন- একটি স্থানীয় প্রার্থীর জন্য এবং অন্যটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্য। এতে পিআর এবং এফপিটিপি (ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট) পদ্ধতির সমন্বয় ঘটে।

সফল উদাহরণ-

নিউজিল্যান্ড : ১৯৯৬ সাল থেকে এমএমপি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহি বজায় রেখেছে।

স্কটল্যান্ড : এ পদ্ধতির মাধ্যমে আঞ্চলিক ও জাতীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়েছে।

৩. ওপেন-লিস্ট পিআর পদ্ধতি : এই পদ্ধতিতে ভোটাররা একটি দলের তালিকা থেকে সরাসরি প্রার্থী বেছে নিতে পারেন, ফলে দলীয় প্রার্থীদের জবাবদিহি বাড়ে। সফল উদাহরণ-

ফিনল্যান্ড : ভোটাররা দলীয় তালিকার প্রার্থী নির্বাচন করতে পারে, যার ফলে দলীয় নেতৃত্বের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়।

ব্রাজিল : দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীদের নির্বাচনে পরাজিত করে ভোটাররা শাস্তি দিতে সক্ষম হন।

৪. আঞ্চলিক পিআর ব্যবস্থা : জাতীয় তালিকার পরিবর্তে আঞ্চলিক ভিত্তিতে পিআর প্রয়োগ করলে স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব এবং জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ে। সফল উদাহরণ-

ডেনমার্ক : আঞ্চলিক পিআর ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

৫. শক্তিশালী নির্বাহী ক্ষমতা : সংসদে জোট সরকারের সীমাবদ্ধতা মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী নির্বাহী নেতৃত্ব নীতিগত অচলাবস্থা কাটিয়ে কার্যকর শাসন নিশ্চিত করতে পারে। সফল উদাহরণ-

ফ্রান্স : প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সংসদীয় জটিলতা এড়িয়ে নীতিনির্ধারণে নেতৃত্ব দেন।

জার্মানি : শক্তিশালী চ্যান্সেলর প্রথা এবং গঠনমূলক আস্থাভোটের নিয়ম পিআর ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করেছে। ইউরোপের এই দেশ পিআর ব্যবস্থার একটি সফল মডেল। এখানে মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক (এমএমপি) ব্যবস্থা দিয়ে আধুনিক পিআর পদ্ধতির সফল উদাহরণ হিসেবে পরিচিত। দেশটি পিআর পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা মোকাবেলায় যুগোপযোগী সংস্কার এনেছে।

জার্মান ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য-

৫ শতাংশ থ্রেশহোল্ড : চরমপন্থী ও দুর্বল দলগুলোকে সংসদে প্রবেশে বাধা দেয়।

দ্বৈত ভোট পদ্ধতি : একজন স্থানীয় প্রতিনিধি ও একটি দলকে ভোট দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।

জোট সংস্কৃতি : দলগুলো নির্বাচনের আগেই জোট নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

গঠনমূলক আস্থাভোট : সরকার পতনের সময় বিকল্প সরকার গঠনের প্রস্তাব বাধ্যতামূলক, ফলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় না।

ফলাফল : গত সাত দশকে মাত্র আটজন চ্যান্সেলর পরিবর্তিত হয়েছে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিদর্শন। চরমপন্থী দল এফডি সংসদে থাকলেও নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

উপসংহার : আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি গণতন্ত্রের একটি শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপ। এটি সব মতামত ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। তবে বাস্তব প্রয়োগে কিছু জটিলতা দেখা দেয়, যেমন- অস্থিতিশীল সরকার, চরমপন্থী উত্থান ও স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের অভাব।

জার্মানি, নিউজিল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মতো দেশগুলো যথাযথ সংস্কার এনে পিআর পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছে। থ্রেশহোল্ড নির্ধারণ, এমএমপি পদ্ধতি, ওপেন-লিস্ট এবং আঞ্চলিক পিআর ব্যবস্থার মাধ্যমে পিআর পদ্ধতি আরো কার্যকর, জবাবদিহিপূর্ণ ও স্থিতিশীল করা সম্ভব।

বাংলাদেশের মতো দেশে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগে স্থানীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ধাপে ধাপে সংস্কার আনা যুক্তিসঙ্গত। সরকার গঠনের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সচেতনতা ও নির্বাহী কর্তৃত্বের কাঠামো উন্নত করার মাধ্যমে পিআর একটি কার্যকর ও টেকসই নির্বাচন ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, বাস্তবভিত্তিক নকশা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা হতে পারে পিআরের সফল বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি।

একটি সতর্ক বার্তা- বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে এ ব্যবস্থা হিতে বিপরীত হতে পারে। কেননা, এতে পতিত আওয়ামী লীগের জাতীয় পার্টি কিংবা সংখ্যালঘুদের ঘাড়ে ভর করে রাজনীতিতে পুর্নবাসিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া দল আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের রাস্তা করে না দিতে চাইলে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে দেশবাসীকে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে।