বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়েছে। এর কারণ কাঠামোগত ঝুঁকি, দুর্বল শাসন, করপোরেট গ্রুপনির্ভর ঋণ এক্সপোজার ও স্বচ্ছতার অভাব। সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি। প্রভিশন হলো ব্যাংকের মূলধন, আমানতকারীর সম্পদ এবং স্থায়িত্ব রক্ষার প্রধান উপাদান। যখন কোনো ব্যাংকের প্রভিশন দীর্ঘ সময় ধরে কম থাকে বা ঘাটতি তৈরি হয়, তখন এটি কেবল ওই ব্যাংকের আর্থিক দুর্বলতা নয়, পুরো খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থার দুর্বলতাও প্রকাশ করে।
২০১৬ সালের আগে ইসলামী ব্যাংক তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। আমানত বৃদ্ধি, মুনাফা অর্জন ও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং মডেলের জন্য পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের পর ব্যাংকে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। বড় করপোরেট গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল ঋণ, দুর্বল ঝুঁকি মূল্যায়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের অকার্যকারিতা ও অপ্রদর্শিত বিনিয়োগের সমষ্টি প্রভিশন ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি করে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বহিরাগত অডিটে আরো অস্বীকৃত বা আগে প্রকাশিত না হওয়া ঘাটতির সন্ধান পাওয়া যায়, যা ব্যাংকের ঝুঁকির চিত্র নতুনভাবে তুলে ধরে।
প্রভিশন ঘাটতির মূল কারণ ঋণ নির্বাচন ও মূল্যায়নে দুর্বলতা, প্রভাবশালী গ্রাহকের প্রতি অতিমাত্রায় নমনীয়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণখেলাপির আধিপত্য। অনেক ব্যাংক কৃত্রিমভাবে মুনাফা দেখাতে চায়। ফলে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ হয় না। এ ধরনের ‘অদৃশ্য ক্ষতি’ সময়ের সাথে সাথে বড় আকার ধারণ করে। একই সাথে অনাদায়ী ঋণ বৃদ্ধিও প্রভিশন ঘাটতি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের অনাদায়ী ঋণের হার প্রায় ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
প্রভিশন ঘাটতি কেবল পরিসংখ্যান নয়; এটি ব্যাংকের ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব, আমানতের নিরাপত্তা এবং ব্যবস্থাপনার সততার সূচক। ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক সক্ষমতা বোঝার জন্য প্রভিশনের অবস্থাই প্রধান নির্দেশক। বাংলাদেশে প্রভিশন-সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী যথাযথ প্রভিশন রাখতে হয়, যা স্ট্যান্ডার্ড ঋণ থেকে ব্যাড-লস পর্যন্ত বিভিন্ন হারে নির্ধারিত।
ইসলামী ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতের একটি বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। শুধু দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে নয়; বরং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আমানত, রেমিট্যান্স চ্যানেলিং ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে পথিকৃতের ভূমিকার কারণে। ব্যাংকের স্থিতিশীল অবস্থানের পেছনে ছিল অনাদায়ী ঋণের নিম্ন হার, দক্ষ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছ বিনিয়োগ নীতি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন গঠন করত এবং প্রায়ই উদ্বৃত্ত প্রভিশনও রাখতে পারত। তখন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল দেশে সর্বনিম্ন এবং অনেকেই এটিকে ‘টেকসই ইসলামী ব্যাংকিং মডেল’ মনে করতেন।
২০১৬ সাল ইসলামী ব্যাংকের রূপান্তরের সূচনা করে। এস আলম গ্রুপের প্রভাব বেড়ে গেলে মালিকানা, বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আসে। বহু দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নীতিসঙ্গত বিনিয়োগ প্রথা ধ্বংসের মুখে পড়ে। দীর্ঘদিন ব্যাংক ছোট ও মাঝারি গ্রাহক, রেমিট্যান্স-চালিত অর্থনীতি এবং শরিয়াহভিত্তিক নিরাপদ সেক্টরে বিনিয়োগ করত। নতুন ব্যবস্থাপনার অধীনে বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে- ঝুঁকি মূল্যায়ন, জামানত সংগ্রহ ও শরিয়াহসম্মত প্রক্রিয়া অনুসরণে শৈথিল্য আসে। বিশেষ করে বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের প্রতি ‘কেন্দ্রীভূত বিনিয়োগ’ বৃদ্ধি পায়।
২০১৬-২১ সময়কালে ব্যাংকের বিনিয়োগপ্রবাহ কয়েকটি বিশেষ গ্রুপের মধ্যে সীমিত হয়। বিভিন্ন পরিদর্শন ও গণমাধ্যম রিপোর্টে বলা হয়, বেশির ভাগ বিনিয়োগ যথাযথ ঝুঁকি যাচাই ছাড়া দেয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও ইঋওট পর্যবেক্ষণ দেখায়, কিছু ক্ষেত্রে ‘লেয়ার্ড অ্যাকাউন্ট’ ব্যবহার করে বিনিয়োগ নেয়া হয়েছে, যেখানে জামানত দুর্বল বা অপ্রতুল ছিল। ফলে প্রকৃত ঝুঁকি আড়াল হয়ে যায় এবং বিনিয়োগের গুণগত মান হ্রাস পায়। অনেক বিনিয়োগ শিগগিরই অনাদায়ী বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, কিন্তু যথাযথ প্রভিশন গঠন করা হয়নি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা দীর্ঘ সময় ধরে প্রকৃত ক্ষতি আড়াল করে মুনাফা স্থিতিশীল দেখানোর চেষ্টা করেছে।
২০১৭ সালের পর ঘাটতি ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। ব্যাংক বিভিন্ন হিসাব সমন্বয়, রোলওভার এবং আড়াল করা লোন-স্ট্রাকচার ব্যবহার করে প্রকৃত ঘচখ প্রদর্শন থেকে বিরত থাকে। ফলে প্রভিশন ঘাটতি চাপা পড়েও ক্রমান্বয়ে বিশাল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের প্রভাবাধীন সময় এই ঘাটতি প্রকাশ পায়নি এবং বার্ষিক প্রতিবেদনে মুনাফা স্থিতিশীল দেখানোর চেষ্টা করা হয়।
পরিস্থিতি বদলায় যখন নতুন তদারকি ব্যবস্থার অধীনে ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থার পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। তখনই বহু বছর আড়াল করা প্রভিশন ঘাটতি স্পষ্ট হয়, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এটি দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রভিশন ঘাটতির একটি। ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন সঙ্কট তাই কেবল আর্থিক হিসাবের সমস্যা নয়; এটি মালিকানা কাঠামো, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এবং বহুমাত্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাবের প্রতিফলন।
এস আলম গ্রুপের দখলের পর ব্যাংকের বিনিয়োগ ‘কনসেন্ট্রেটেড রিস্ক’ গ্রহণ করে। পরিদর্শন ও রিপোর্টে দেখা যায়, কয়েক শ’ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনে নিয়ম ভেঙে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ নতুন শেল কোম্পানি বা একই গ্রুপের সদ্য নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যকর ব্যবসায়িক রেকর্ড বা জামানত ছিল না, তবু অভ্যন্তরীণ শর্তাবলিও উপেক্ষা করা হয়। এই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ব্যাংকের আর্থিক কাঠামো দুর্বল করে।
২০১৭-২১ সালের মধ্যে ঋণ পোর্টফোলিও কাগজে-কলমে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তবে অধিকাংশ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ করপোরেট লোন পরে অনাদায়ী বা ‘লস ক্যাটাগরি’তে পরিণত হয়। ব্যাংক আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে কম ঘচখ দেখায়; কিন্তু আড়াল করা রিশিডিউলিং, কাগজে-কলমের আয়, রোলওভার ও গ্রুপভিত্তিক লোন ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রকৃত ক্ষতি ঢেকে রাখে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদারকি রিপোর্টে ব্যাংকের বিনিয়োগে অনিয়ম প্রকাশ পায়। দেখা যায়, ‘স্ট্যান্ডার্ড’ দেখানো ঋণগুলোর বড় অংশ আদায়যোগ্য নয় বা ক্ষতিগ্রস্ত। প্রভিশন গঠনের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘোষিত মুনাফার বহুগুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা এটিকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ‘হিডেন প্রভিশন লস’ বলে আখ্যা দেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যখন প্রকৃত ঘাটতি প্রকাশ করে, তা আর্থিক স্থিতিশীলতা ও পরিচালনার ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
প্রভিশন ঘাটতির উন্মোচন কেবল হিসাবগত সঙ্কট নয়; এটি ব্যাংকের সুনাম, আমানতকারীর আস্থা, আন্তর্জাতিক রেটিং এবং বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং খাতের বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রভাব ফেলে। তবে এটি একটি সুযোগও তৈরি করে- সঠিক নীতি, অভ্যন্তরীণ সংস্কার, স্বচ্ছ তদারকি ও ঝুঁকিসঙ্গত বিনিয়োগের মাধ্যমে ঘাটতি মোকাবেলা সম্ভব।
বিশ্বের অনেক উন্নত ও উদীয়মান দেশের ব্যাংক অতীতে প্রভিশন সঙ্কটে পড়েও ধীরে ধীরে তা পূরণ করে স্বাভাবিক স্থিতিতে ফিরেছে। ইসলামী ব্যাংকের পক্ষেও তা সম্ভব।
জাপান ও ইউরোপের ব্যাংক সংস্কারের অভিজ্ঞতা দেখায়, প্রথম কাজ হলো অনাদায়ী সম্পদের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা। ইসলামী ব্যাংকে লুকানো ঘাটতির বড় অংশ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তবে আরো গভীর সম্পদ গুণমান মূল্যায়ন (অছজ) প্রয়োজন। ক্ষতি স্বীকারের পর বাস্তবসম্মত প্রভিশন পরিকল্পনা তৈরি করা যায়। উচ্চ অনাদায়ী ঋণ ও প্রভিশন চাপ থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক আয় বাড়িয়ে ঘাটতি কমাতে পেরেছে। ইসলামী ব্যাংকের বড় আমানতভিত্তি ও নেট প্রফিটিং ক্ষমতা থাকায় রেমিট্যান্স, কস্ট-ইফেকটিভ ইসলামী ব্যাংকিং প্রডাক্ট, ট্রেড ফাইন্যান্স ও শরিয়াহভিত্তিক সঞ্চয়পণ্যে অগ্রাধিকার দিলে আয় বৃদ্ধি সম্ভব।
খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়া, সম্পদ হস্তান্তর ও জামানত বিক্রয় ব্যবহার করতে হবে। অভ্যন্তরীণ আয় বা শেয়ারহোল্ডারের মাধ্যমে মূলধন প্রবর্তন ঘাটতি পূরণে সহায়ক হতে পারে। তবে করপোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী থাকতে হবে। প্রশাসনিক ব্যয় ও অকার্যকর প্রকল্প কমিয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যালান্সশিট শক্তিশালী করা যায়। নিয়ন্ত্রক তদারকি, কঠোর শ্রেণিবিন্যাস, সময়মাফিক অডিট ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর ও স্বচ্ছ করবে।
আন্তর্জাতিক তুলনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, মালয়েশিয়া ও গালফের ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন গঠনে কঠোর নিয়ম রয়েছে। ব্যাংকগুলোকে প্রকৃত ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য করা হয় এবং ঈড়াবৎধমব জধঃরড় বজায় রাখতে হয়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তুলনামূলকভাবে দুর্বল, বিশেষ করে প্রভিশন ও ক্লাসিফাইড ঋণ ব্যবস্থাপনায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বড় প্রভিশন ঘাটতি বয়ে চললেও আয় বৃদ্ধি ও সরকারি সহায়তায় তা কমিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ভালো অবস্থানে।
ইসলামী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি শুধু সঙ্কট নয়; এটি একটি শিক্ষণীয় মুহূর্ত। সঠিক নীতি ও অভ্যন্তরীণ সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা এবং ভবিষ্যতে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী করা সম্ভব।
আশার কথা, এস আলম গোষ্ঠী বিতাড়িত হওয়ার পর বর্তমান সময়ে ইসলামী ব্যাংক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জনসাধারণের আস্থা বেড়েছে, ফলে আমানত ও ডিপোজিটের পরিমাণও বেড়েছে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের ঋণও সময়মতো পরিশোধ করেছে। জনসাধারণের আস্থা এবং নিবেদিতপ্রাণ ব্যাংকারদের প্রচেষ্টার সাথে এস আলমের সম্পদ বিক্রি, আইন ও কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে ঋণ আদায়, নতুন মূলধন আহরণ, রাইট-অফ ও আয় সম্প্রসারণ- এই পাঁচটি স্তম্ভ একত্রিতভাবে ব্যাংককে বর্তমান সঙ্কট থেকে আবার দাঁড় করাতে পারে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট



