ব্রিটিশ ভারতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। যদিও ঐতিহাসিক সত্য যে, এ বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ইংরেজদের অনুকূলে তাদের দাফতরিক কাজ আঞ্জাম দিতে ইংরেজি জানা কিছু নবিস তৈরির কারখানা হিসেবে। প্রতিষ্ঠার পেছনে যাই থাকুক না কেন, একসময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই অঞ্চলের ইতিহাসে অনন্য ভূমিকা রাখেন। এখনো সে ধারাবাহিকতা চলমান। আমাদের জাতীয় জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজও গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২১; কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিদানস্বরূপ। যাকে সোজাসাপটা ভাষায় বলা যায়, সান্ত¡না পুরস্কার। অন্য অর্থে গরু মেরে জুতা দান। কেন সান্ত¡না পুরস্কার বা গরু মেরে জুতা দান, আজকের লেখায় তার একটি পরিষ্কার বা স্পষ্ট উত্তর দেয়া অবশ্যই করণীয় কাজ বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।
ব্রিটিশ ভারতে বৃহৎ বাংলা প্রদেশ আয়তনের দিক থেকেও ছিল বিশাল। ফলে এর প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন ছিল কষ্টসাধ্য। ফলে ব্রিটিশরাজ বাংলা প্রদেশ ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুযায়ী, ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করে দু’টি আলাদা প্রদেশ গঠন করা হয়। একটি পশ্চিম বাংলা এবং অন্যটি পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ। যার রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। নতুন এ প্রদেশ গঠিত হলে পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ প্রদেশ সৃষ্টির ভেতর দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বঞ্চিত ভাটি বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী শ্রেণী নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক ভাগ্য বদলের সম্ভাবনা দেখতে পায়। অন্য পক্ষে ইংরেজদের আনুকূল্যে গড়ে ওঠা হিন্দু মধ্যবিত্ত ও কলকাতায় বসবাসরত পূর্ব বাংলার জমিদার গোষ্ঠী বাংলা ভাগকে নিজেদের আর্থিক দিক থেকে ভাগ্য বিপর্যয় সাব্যস্ত করে তীব্র বিরোধিতা করে। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে তারা চরমপন্থা অবলম্বন করতেও দ্বিধা করেনি। জ্বালাওপোড়াওসহ সন্ত্রাসী সংগঠন যুগান্তর ও অনুশীলন গোষ্ঠী গড়ে তোলে। কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দু ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সশস্ত্র সেই আন্দোলনের মুখে অবশেষে ইংরেজরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাই একে আমরা পূর্ববঙ্গবাসীকে ইংরেজদের দেয়া সান্ত¡না পুরস্কার বা গরু মেরে জুতা দানের সাথে তুলনা করতে পারি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যদি পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশটি টিকে যেত, তাহলে এ জনপদে এমনিতেই উন্নয়নের ছোঁয়া লাগত। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাসপাতাল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত। অথচ বঙ্গভঙ্গ রদের ভেতর দিয়ে সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। তাই পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ যে ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যাতে এখানকার কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর সন্তানসন্ততি লেখাপড়া শিখে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তুলতে পারে। এই ঐতিহাসিক বাস্তবতায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন।
স্মরণযোগ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাও করেছিল তৎকালীন কলকাতার বর্ণ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে একটি সভার আয়োজন করা হয়। খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বঙ্গভঙ্গের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও বিরোধিতা করেন। কেন রবীন্দ্রনাথসহ কলকাতার হিন্দু কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন? আসলে তারা জানতেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মানে শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। একসময় ওই বিদ্যাপীঠ ঘিরে শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভ্যুদয় ঘটবে। সেই শ্রেণী নিজেদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির অভিমুখ বাতলে নেবে। যার অনিবার্য পরিণতি কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণ হিন্দুদের পূর্ব বাংলায় আধিপত্য খর্ব হওয়া। কার্যত হয়েছেও তাই। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পূর্ব বাংলার এ কে ফজলুল হক। সাধারণের কাছে যিনি শেরেবাংলা নামে সমধিক পরিচিত। আর ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পায় পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। পরে একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এভাবে আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়ার প্রতীক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকে পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে অনন্য ভূমিকা রাখে। শত বছরের বেশি সময়ের প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবসময় ঐতিহাসিক মুহূর্তে এর স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। জনপদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে থেকে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। বর্তমানেও সে ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ। যার সর্বশেষ নজির চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন। ভারতের তাঁবেদার ও বশংবদ শেখ হাসিনার আশ্রয় মিলেছে দিল্লিতে।
লক্ষণীয়, মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমে অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় ইতিহাসে অনন্য স্বাক্ষর রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্রেট ব্রিটেনের বিশ্ব-ইতিহাসে মহীরুহ হয়ে ওঠার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ফরাসিদের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ভিত তৈরিতে অবদান রাখছে সরবন বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর আমেরিকার বিশ্বমোড়ল হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এমআইটি, হার্ভার্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়।
উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের জাতি গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখছে। তাই তো দেখা যায়, আমাদের জাতীয় সংগ্রামের প্রতিটি বাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। আর সেই নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’ ঘিরে। যদিও ডাকসু নির্বাচন প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা; কিন্তু কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বাধায় এর ব্যত্যয় ঘটে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ডাকসুকে অভিহিত করা হয় সেকেন্ড পার্লামেন্ট হিসেবে। সবসময় ডাকসু নির্বাচন সমগ্র জাতির দৃষ্টি কেড়েছে। এ নির্বাচন সবার কাছে হয়ে উঠেছে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এবার এই ২০২৫ সালে আগ্রহের মাত্রা আরো বেশি। ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় আজ ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচন রাজনীতিসচেতন জনগোষ্ঠীর তুমুল আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
২০১৯-এর ডাকসু নির্বাচনের পর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। ছয় বছর বিরতি দিয়ে হচ্ছে এবারের ভোট উৎসব। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডাকসুর ভোট গ্রহণ জাতীয় রাজনীতির অভিমুখ-নির্ণায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে, তা সহজে অনুমেয়। ফলে দেশবাসীর মতো সব রাজনৈতিক দলের কাছেও এবারের ডাকসু নির্বাচন গুরুত্ব বহন করে। বলা যায়, এবারের ডাকসু নির্বাচন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মহড়া হিসেবে নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। ডাকসুতে সমভাবাপন্ন ছাত্র সংগঠনের সম্ভাব্য ফলাফলের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখছেন রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় নেতৃত্ব।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যেভাবে মর্যাদা ফিরে পেয়েছে, তার প্রতিফলন ঘটতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচনে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে আধিপত্যবাদী শক্তিবিরোধী ছাত্র-জনতা ব্যাপকভাবে অংশ নেয়ায় আদর্শবাদী রাজনীতির গুরুত্ব সমাজে সমাদৃত হচ্ছে। এতে সেকুলার রাজনীতির ধ্বজাধারীরা বড়ই উদ্বিগ্ন। তারা আদর্শিক রাজনীতির অগ্রযাত্রা ঠেকাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো পর্যায়ের ভোট গ্রহণে অনাগ্রহী। তা সত্তে¡ও ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। এরা অনেক কৌশল করেও ডাকসু নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এবার যদি ডাকসুতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি ধারণকারী আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের বিজয় আসে তাহলে সেকুলারদের হৃদয়ে ভীতির কম্পন শুরু হবে। এ জন্য এবারের ডাকসু নির্বাচন আমাদের জাতীয় জীবনেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাকসু নির্বাচন আগামীর জাতীয় রাজনীতির অভিমুখ ঠিক করে দেবে, যা হবে মূলত আধিপত্যবাদবিরোধী ও এই জনপদের মানুষের একান্ত চাওয়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয় মানসের অনুকূলে।
 


