২০২৫ সালের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, যার মাধ্যমে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এর মাধ্যমে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় কার্যকর হলো। এটি এ আদালতের ২০১১ সালের সিদ্ধান্তের বিপরীত একটি রায়, যা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেই রায় অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে প্রায় পনেরো বছর ধরে তা সংবিধানের কাঠামো থেকে অপসৃত করে রাখা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে প্রদত্ত রায়টি পূর্ববর্তী এ টি এম আজহারুল ইসলাম মামলার রায়ের সাথে যুক্ত হয়ে আপিল বিভাগের দু’টি যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের একটিতে পরিণত হয়েছে, যে সিদ্ধান্তগুলো পদ্ধতিগতভাবে ওই বিচারিক স্থাপত্য ভেঙে দিয়েছে, যা দীর্ঘ দিন শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতা দিয়েছিল। এ প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আপিল বিভাগের এই রায়ের আইনগত ও রাজনৈতিক তাৎপর্য কী এবং এ প্রক্রিয়া বাংলাদেশের নির্বাচনী ভবিষ্যতের ওপর কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব ফেলতে পারে।
এক সংক্ষিপ্ত মৌখিক আদেশে আপিল বিভাগ ঘোষণা করেছেন যে, সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধিগুলো ভবিষ্যৎ কার্যকারিতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এর অর্থ হলো, রায়ের তারিখ থেকে, অর্থাৎ ২০ নভেম্বর ২০২৫, থেকে ব্যবস্থাটি কার্যকর হবে। এর মাধ্যমে আদালত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, পুনর্জীবিত ওই বিধানগুলো অতীত সময় থেকে কার্যকর হবে না, মানে- কোনোরূপ পশ্চাৎমুখী প্রভাব থাকবে না। ফলে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচন, যেগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি, ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সেগুলো অসাংবিধানিক হয়ে পড়বে না। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আদালত যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে পূর্ববর্তী তারিখ থেকে কার্যকর করতেন, তবে তা দেশে ব্যাপক আইনি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করত। এর ফলে অতীত সংসদগুলোর বৈধতা, গত পনেরো বছরে প্রণীত আইনগুলোর কার্যকারিতা এবং নির্বাচনের পর ক্ষমতা প্রয়োগকারী সরকারগুলোর সাংবিধানিক অবস্থান সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হতো। আপিল বিভাগ সেই পথে না হেঁটে বরং স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ রায়ের আওতা থেকে ওই তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের সব কার্যক্রম সুরক্ষিত রাখেন। কেবল আগামী নির্বাচনগুলোর জন্য এ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে, আদালত এ মর্মে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, তার উদ্দেশ্য বিশৃঙ্খলা তৈরি করা নয়, বরং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
এখন, গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন সবার মনে যে আলোড়ন সৃষ্টি করছে, তা হলো : আপিল বিভাগের এ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থানকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? সংক্ষেপে বলা চলে, এর প্রভাব নেই বললেই চলে। আদালতের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত ভিত্তি ও বৈধতা কোনোভাবে স্পর্শ করেনি। গত এক বছরে একাধিক প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছি যে, অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত হয়নি। এর ক্ষমতা কোনো সাংবিধানিক বিধান থেকে উৎসারিত নয়, বরং এটি সংবিধানের কাঠামোর বাইরে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যভাবে বললে, এর বৈধতা নিহিত রয়েছে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা ও ক্ষমতায়, সংবিধানের লিখিত পাঠে নয়। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ প্রণয়নের সময় অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিল যে, তাদের কর্তৃত্বের উৎস একমাত্র জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, উভয়ের কাঠামোয় প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীর সহায়তায় পরিচালিত হওয়ার বিধান থাকায় কিছু বাহ্যিক সাদৃশ্য দেখা যায়, কিন্তু সেই সাদৃশ্য এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। উদ্দেশ্য, উৎস এবং ক্ষমতার পরিধির দিক থেকে বিচার করলে সবকিছুতে এরা ভিন্ন। অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেট হলো রূপান্তরমূলক। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একনায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের স্থলাভিষিক্ত হতে। সেই সাথে এমন কাঠামোগত সব সংস্কার বাস্তবায়ন করতে; যা নিশ্চিত করবে কেন্দ্রীভূত ও নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতা যেন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। এ কারণে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক, পুলিশ, নির্বাচন ও বিচারবিভাগীয় সংস্কারে একাধিক কমিশন গঠন করেছে। অন্য দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের বিধান থেকে সৃষ্টি। এর ভূমিকা সীমিত। এটি একটি নিরপেক্ষ, প্রশাসনিক সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যার একমাত্র কাজ হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সংস্কার কার্যক্রমে এ সরকারের কোনো ধরনের এখতিয়ার নেই। এটার মূল দায় হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন নয়, বরং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। উদ্দেশ্যের এ মৌলিক ভিন্নতা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আপিল বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়টির বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অস্তিত্ব বা কর্তৃত্বের ওপর কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব বিস্তার করছে না।
সুতরাং, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা এবং নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রশাসনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। আপিল বিভাগ ২০ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে রায় প্রদান করেছেন, তা সাথে সাথে কার্যকর হচ্ছে না। পদ্ধতিটি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার সম্পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার পর কেবল এটি সক্রিয় হবে। এর অর্থ হলো, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক সরকার গঠিত হবে, তারা পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করবে। সে মেয়াদের শেষে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার সরকারের কাছে, যার একমাত্র দায়িত্ব হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। একই সাথে নির্বাচিত পরবর্তী সরকারের কাছে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা। পুনর্বহাল করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে বাংলাদেশ প্রথমবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কার্যরত দেখবে যখন দেশটি চতুর্দশ সংসদীয় নির্বাচনের আয়োজনের প্রস্তুতি নেবে।
সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করা জরুরি, তা হলো আপিল বিভাগ এখনো ২০২৫ সালের ২০ নভেম্বর প্রদত্ত রায়ের লিখিত পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেননি। আশা করা হচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ লিখিত অনুলিপিটি সেই বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপরও আলোকপাত করবে, যা দীর্ঘ দিন ধরে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার একটি আস্থাশীল ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানির সময় বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিচারিক আচরণের তীব্র সমালোচনা করেন। তাদের জোরালো অভিযোগ ছিল যে, তিনি উন্মুক্ত আদালতে যে রায় ঘোষণা করেছিলেন, ওই রায়ের সাথে তার চূড়ান্ত লিখিত রায় ছিল ভিন্ন, যা বিচারিক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। আজ বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কারাগারে রয়েছেন, এ কারণে যে, তিনি রায় ঘোষণার পর তা পরিবর্তন করেছিলেন। তাকে রায়ের বিষয়বস্তুর জন্য নয়, বরং রায় প্রদানের পদ্ধতির জন্য তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন বিচারিক দুঃসাহসিকতা রোধ করতে আপিল বিভাগের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট সতর্কতা জারি করা প্রয়োজন।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি



