বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন

দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা সব সময়ই আশা করি, নির্বাচনে যেন সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীরই জয় হয়।

বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগে গুলির নিন্দা ও উদ্বেগ জানাতে হয়েছে সরকারকে। বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, সরকার তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন, হামলাকারীদের শনাক্ত ও আটক করতে যেন কোনো ধরনের শিথিলতা না থাকে এবং দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। এ-ও বলা হয়েছে, সরকার নিজ দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ থেকে সারা দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও উৎসবমুখর নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী আগেই ২৯৮টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। তার পরও আরেকবার তারা তা জানান দেবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি শিগগিরই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। বিএনপির ঘোষণাটির মূল্য আলাদা। চট্টগ্রামের ঘটনা এবং ঘটনা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতিরও একটি বাড়তি বার্তা রয়েছে। এবারের নির্বাচনে কোন বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে দেশের প্রধান দল বিএনপিকে? কোন দিকে যাচ্ছে দলটি, সরকার-ই-বা কী করবে- এসবের একটি রিহার্সেল কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। বিএনপিই সব নয় সত্য। কিন্তু অনেক কিছু। দেশের এ বৃহৎ রাজনৈতিক দলটির প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে সারা দেশে নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। আনন্দ-উচ্ছ¡াস, মিষ্টি বিতরণ, মিলাদ, দোয়া মাহফিলের মধ্য দিয়ে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। আবার মনোনয়ন না পাওয়াদের প্রতিবাদ, বিকল্প প্রার্থীর দাবিতে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে।

ভোট গণনায় জয়-পরাজয়ের আগেও একটি জয়-পরাজয় পর্ব থাকে। তা হচ্ছে মনোনয়ন পাওয়া-না-পাওয়া। মনোনয়ন পাওয়া মানেই জয়ের অনুভূতি বোধ করার রেকর্ড যেমন আছে। আর মনোনয়ন না পাওয়া মানেই পরাজয় মনে করার রেওয়াজও আছে। তা নির্বাচনের ইতিহাস লগ্ন থেকেই চলছে। এবারের ব্যাপারটি আরেকটু ভিন্ন। দেশের সর্ববৃহৎ দল বিএনপি একটু আগেভাগেই ২৩৮টি সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা ঘোষণা করেছে। মনোনয়ন স্থগিতের ঘটনাও ঘটে গেছে। দল থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হয়েছে একজন প্রার্থী বদলের কথা। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৩ নভেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ঘোষিত ২৩৭টি সংসদীয় আসনের মধ্যে অনিবার্য কারণবশত মাদারীপুর-১ (শিবচর উপজেলা) আসন ও দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম স্থগিত রাখা হলো। তার নাম কামাল জামান মোল্লা। তার নাম ঘোষণার প্রতিবাদে মাদারীপুরের শিবচরের ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করেন বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলুর কর্মী-সমর্থকরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কামাল জামান মোল্লাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা: মুরাদ হাসানের সাথে থাকা তার ছবি শেয়ার হতে থাকে নতুন করে। এর জেরে কাটা পড়ে তার নাম। প্রার্থিতা বদলসহ সামনে আরো ঘটনার আভাস রয়েছে। যার এক ঝলক ঘটল আওয়ামী লীগ আমলে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মরহুম অর্থমন্ত্রী সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়াপুত্র রেজা কিবরিয়াকে নিয়ে। তিনি হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে ধানের শীষে নির্বাচন করতে পারেন। আসনটি ফাঁকাই রেখেছে বিএনপি। গণমাধ্যমকে রেজা কিবরিয়া জানান, ইতোমধ্যে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। প্রাথমিক সদস্য ফরমও পূরণ করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি হবিগঞ্জ-১ থেকে ধানের শীষে নির্বাচন করেছিলেন তা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা না করা আসনগুলো ঘিরে রয়েছে জোট বা সমঝোতার আভাস। খালি রাখা ৬৩টি আসনের মধ্যে জোট শরিকদের জন্য ৪০টি আসন ছেড়ে দেয়া নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। এনসিপির সাথে জোট বা বোঝাপড়া হলে হিসাব-নিকাশে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। এনসিপি এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সম্মান দিয়েছে, তার আসনে কোনো প্রার্থী দেবে না বলে ঘোষণা দিয়ে। সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী নির্বাচনী জোট হলেও নিজস্ব মার্কায় নির্বাচন করতে হবে। তাই জোটের শরিক দলগুলোকে আসন ছাড় দিলেও তারা নির্বাচিত হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ঘোষিত ২৩৭ আসনেও এদিক-সেদিক হতে পারে। ঘোষণার দিনই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এটি চূড়ান্ত নয়। বিএনপি এবার এক পরিবার থেকে দু’জনকে মনোনয়ন না দেয়ার ঘোষণা বাস্তবায়ন করেছে বেশ সাফল্যের সাথে। তবে মরহুম এবং সাবেক-বর্তমান নেতাদের সন্তানদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

মনোনয়ন তালিকায় নাম রয়েছে দলটির মরহুম, সাবেক ও বর্তমান নেতাদের ২৪ জন ছেলে ও মেয়ের। এর মধ্যে ১৯ জন ছেলে, পাঁচজন মেয়ে। মরহুম দুই নেতার স্ত্রীরাও পেয়েছেন মনোনয়ন। অবশ্য পরিবার অনেকের একমাত্র পরিচয় নয়। এদের প্রায় সবাই রাজনীতিতে সক্রিয়। বাবা বা স্বামীর হাত ধরে রাজনীতিতে এসে বিএনপির কাছে সংসদ সদস্যের টিকিট চেয়েছিলেন, এমন সংখ্যা অর্ধশতের বেশি। ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও তার পুত্রবধূ নিপুণ রায় চৌধুরী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে। নাটোর-১ : এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছিলেন সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মরহুম ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুল ও ছেলে ইয়াসির আরশাদ। মনোনয়ন পেয়েছেন পুতুল। পুতুলের পক্ষে এলাকায় উৎসব আমেজ। হতাশা-ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে আরশাদের লোকজন। মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তারা। পুতুলের লোকদের মারধরও করেছেন।

বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ঢাকার সাবেক মেয়র মরহুম সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন ঢাকা-৬ আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম-৭ আসনে। চট্টগ্রাম-৫ আসনে দেয়া হয়েছে সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের ছেলে মীর হেলাল উদ্দিনকে। ঢাকা-৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী মনোনয়ন পেয়েছেন। গাজীপুর-২ আসনে সাবেক মেয়র মরহুম এম এ মান্নানের ছেলে এম মঞ্জুরুল করিম রনি, গাজীপুর-৪ আসনে সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আ স ম হান্নান শাহর ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নান, মানিকগঞ্জ-২ আসনে সাবেক মন্ত্রী মরহুম শামসুল ইসলাম খানের ছেলে মঈনুল ইসলাম খান, ময়মনসিংহ-৯ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আনওয়ারুল হোসেন খান চৌধুরীর ছেলে ইয়াসের খান চৌধুরী, শেরপুর-২ আসনে মরহুম জাহেদ আলী চৌধুরীর ছেলে মোহাম্মদ ফাহিম চৌধুরী, শেরপুর-৩ আসনে সাবেক এমপি সিরাজুল হকের ছেলে মাহমুদুল হক রুবেলও মনোনয়ন পেয়েছেন।

এ তালিকায় আছেন যশোর-৩ এ সাবেক মন্ত্রী মরহুম তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, কুষ্টিয়া-২ আসনে এমপি আব্দুর রউফ চৌধুরীর ছেলে রাগীব রউফ চৌধুরী, ঝিনাইদহ-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ মেহেদী হাসান, সিলেট-১ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম খন্দকার আবদুল মালেকের ছেলে খন্দকার আবদুল মোক্তাদির চৌধুরী, পিরোজপুর-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের ছেলে আহমেদ সোহেল মঞ্জুরও। পঞ্চগড়-১ আসনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমির।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন-নবী খান সোহেল, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান রতন মনোনয়ন পাননি। গুমের শিকার পরিবারের সদস্য, ছাত্রদল-যুবদলের নেতাদের মনোনয়ন দেয়ায় নবীন-প্রবীণের সমন্বয় হয়েছে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এ প্রার্থী তালিকাকে ‘ভারসাম্য’ রক্ষার প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এখানে পর্যবেক্ষণের অনেক কিছু রয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, দেশ কোন দিকে যাবে, গণতন্ত্রের পথে কিভাবে হাঁটবে, সেটি নির্ভর করছে আগামী সংসদ নির্বাচনের ওপর। নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারিত হবে। বিগত সময়ে নির্বাচন কমিশন, আদালত, জনপ্রশাসনসহ সব কিছুই ছিল বেদখল। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন দলীয়করণের ফলে মানুষের ভেতর একধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছিল নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি। সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের ফলে অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের দখলে চলে যায়। কাজেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটি পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।

দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা সব সময়ই আশা করি, নির্বাচনে যেন সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীরই জয় হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট