ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এ শহরে ধারণক্ষমতার তুলনায় জনসংখ্যা বহুগুণ বেশি। সরকারের প্রায় সব প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থান ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ঢাকায় আসে। বাসস্থান সঙ্কট ও সীমিত জমির কারণে লোকজন ছোট এলাকায় গাদাগাদি করে বসবাস করতে বাধ্য হয়। এতে নাগরিক জীবনমান অত্যন্ত নিচু এবং নগরব্যবস্থাপনা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
অতিরিক্ত জনসংখ্যা মানে প্রতিদিন রাস্তায় অতিরিক্ত যানবাহন। ক্রমবর্ধমান গাড়ির হার শহরে স্থায়ী যানজটের সৃষ্টি করছে। প্রতিদিন অফিস-আদালতের যাতায়াতে কয়েক ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়, যা জাতীয় উৎপাদনশীলতা কমায়। জরুরি পরিস্থিতিতেও (হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স বা দমকলের গাড়ি) দ্রুত যাতায়াত কঠিন। যানজটের কারণে বছরে হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
বায়ু, শব্দ, বর্জ্য : ঘনবসতিপূর্ণ শহরের বড় চ্যালেঞ্জ হলো দূষণ। যানবাহন, ইটভাটা, নির্মাণকাজ সব মিলিয়ে ঢাকা শহরের বায়ু অত্যন্ত দূষিত। জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপে শব্দের মাত্রা বিশ্বস্বীকৃত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন উৎপন্ন বিশাল পরিমাণ বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকার রাস্তা, সেতু, ড্রেনেজ, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সবই সীমিত সক্ষমতায় তৈরি। অতিরিক্ত জনসংখ্যা এই সেবাব্যবস্থার ওপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি করে। বৃষ্টির দিনে পানি জমে যাওয়া, পানি নিষ্কাশন না হওয়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সঙ্কট প্রতিনিয়ত। নগর পরিকল্পনার অভাব ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে।
সচিবালয়, সব প্রধান অফিস ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। সরকারি কমিশন, নিরীক্ষা ও আইন প্রণয়নসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সবই রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। এতে করে দেশের সব জেলা, উপজেলা, বিভাগ এমনকি বাসিন্দাদের মৌলিক সরকারি কাজও ঢাকামুখী হয়ে পড়ে। ফলে ঢাকার ওপর অস্বাভাবিক প্রশাসনিক ভিড় ও চাপ তৈরি হয়। সেবাপ্রদান ধীর ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। সব সিদ্ধান্ত ঢাকায় বসে নিতে হয়, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ছোট ছোট অনুমোদন পেতে ঢাকায় যোগাযোগ করতে হয়। একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্যও ঢাকায় বহু দফতর ঘুরতে হয়। জটিলতা বাড়ে, সময় ও অর্থের অপচয় হয়। মাঠ প্রশাসন স্বায়ত্তশাসন কম পায়, কেন্দ্রীকরণের কারণে জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় প্রশাসন অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়ন সমানভাবে এগোয় না। ঢাকায় বাসস্থানের সঙ্কট, উচ্চ ভাড়া, খোলা জায়গা ও পার্কের ঘাটতি, স্কুল-হাসপাতালের ভিড়, মানুষ দিনে দিনে মানসিক চাপ, ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তায় ভুগছে, এটি দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় কর্মক্ষমতা ও মানবসম্পদ উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। রাজধানীর প্রশাসনিক কার্যকারিতা কমে যায় যখন রাজধানী একই সাথে প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাগত, ব্যবসায়িক সব ভূমিকা পালন করে। এসব কারণেই বহু দেশে (যেমন মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, কাজাখস্তান) প্রশাসনিক রাজধানী আলাদা করা হয়েছে ।
দুর্যোগ ঝুঁকি
ঢাকা দেশের সবচেয়ে উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ শহর। এর আশপাশে সক্রিয় ফল্ট লাইন রয়েছে (বঙ্গ-মেঘনা ফল্ট ও ডাউকি ফল্ট)। শহরের ভবনগুলোর বড় অংশই ভূমিকম্প সহনশীল মানদণ্ড অনুসরণ করে তৈরি হয়নি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভবন ধসে পড়লে ব্যাপক প্রাণহানি ও কাঠামোগত ক্ষতি হতে পারে। একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও বড় বিপর্যয় তৈরি করতে পারে, আর বড় ভূমিকম্প হলে শহর কার্যত অচল হয়ে যেতে পারে।
জাপানে ভূমিকম্পরোধী (বধৎঃযয়ঁধশব-ৎবংরংঃধহঃ) বাসাবাড়ি তৈরি হয় অত্যাধুনিক প্রকৌশল, বৈজ্ঞানিক নকশা ও কঠোর বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে। জাপানের ভবনগুলো মাটির সাথে সরাসরি ‘কঠোরভাবে’ বাঁধা থাকে না বরং কম্পন শোষণ করতে পারে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ভবনের নিচে রাবার, স্টিল ও লেড-কোর বেয়ারিং বসানো হয়। ভবনের ভেতরে শক অ্যাবজর্ভারের মতো ড্যাম্পার বসানো হয়। এগুলো গাড়ির শক অ্যাবজর্ভারের মতো কাজ করে, কম্পন থামিয়ে দেয়। তাই কম্পন ভবনে সরাসরি পৌঁছাতে পারে না। ভূমিকম্পে ভবন দুললেও ক্ষতি কম হয়। ইস্পাতের কাঠামো বেশি ব্যবহার করা হয়। ইস্পাত বাঁকতে পারে কিন্তু ভাঙে না। জাপানে আধুনিক কাঠের বাড়ি জনপ্রিয়। কাঠ হালকা, নমনীয় ও দ্রুত কম্পন শোষণ করতে পারে। খুঁটি, বিম, জয়েন্টগুলো বিশেষ রিইনফোর্সড ডিজাইনে তৈরি। মেটাল প্লেট, বোল্ট, ব্রেসিং সবই টেকসইভাবে যুক্ত থাকে। ভূমিকম্পে যাতে কোন অংশ আলাদা না হয়ে যায়।
সেন্সর সিস্টেম : নতুন ভবনগুলোতে কম্পন সেন্সর থাকে। ভূমিকম্প শুরু হলে এলিভেটর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিচে নেমে দরজা খুলে দেয়। গ্যাস লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। জাপানে বিশ্বের সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প ধরে স্ট্রাকচার ডিজাইন, নিয়মিত পরিদর্শন, পুরনো ঘরকে পুনঃশক্তিশালীকরণ করা হয়।
রাজধানী হিসেবে দুর্যোগের প্রভাব আরও গভীর
ঢাকায় ভূমিকম্প হলে দেশের শীর্ষ প্রশাসন অচল হবে, জরুরি সেবা সমন্বয় ভেঙে পড়বে, জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত হবে। এটি পুরো দেশের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। দুর্যোগের পর দ্রুত উদ্ধার প্রয়োজন, কিন্তু রাস্তা সরু ও যানজটপূর্ণ। বড় যানবাহন (অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস) চলাচলে বাধা, প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা ও জরুরি শেল্টারের অভাবের কারণে ক্ষয়ক্ষতি আরো বাড়বে।
ঢাকার দূষণের প্রধান উৎস গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজ, ইটভাটা, শিল্পকারখানার বর্জ্য। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা সব নদীই দূষণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। শিল্পবর্জ্য, নোংরা পানি, পয়োনিষ্কাশন সবই নদীতে গিয়ে পড়ে। ঢাকার সুপেয় পানির ওপর চাপ বাড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমছে।
নগর তাপমাত্রা বাড়ছে কারণ ঘনবসতি, তার ওপর কংক্রিটের শহর। কংক্রিট তাপ আটকে রাখে। ঢাকার তাপমাত্রা আশপাশের অঞ্চলের তুলনায় কয়েক ডিগ্রি বেশি, গরমের সময় জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে ওঠে।
প্রতিদিন ঢাকায় বিপুল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কিন্তু সংগ্রহ, পরিবহন ও নিষ্পত্তি সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। অনেক জায়গায় খোলা বর্জ্য পরিবেশ নোংরা করে, পোকামাকড়, দুর্গন্ধ, রোগবালাই বৃদ্ধি করে। জলাবদ্ধতা হয় ড্রেনেজ দুর্বলতার কারণে। খাল ভরাট, সঙ্কীর্ণ নিকাশি ব্যবস্থা, এই কারণে বৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি জমে থাকে। এটি শুধু জনদুর্ভোগ নয় অর্থনীতি ও প্রশাসনকেও প্রভাবিত করে।
রাজধানী সরানোর চ্যালেঞ্জ
রাজধানী স্থানান্তর বিশাল ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। নতুন প্রশাসনিক শহর তৈরি করতে বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। বাংলাদেশে সম্ভাব্য নতুন রাজধানীর স্থান (গবেষণায় আলোচিত ধারণা)
১. পদ্মা সেতুর আশপাশে (জাজিরা শরীয়তপুর এলাকা) এই অঞ্চলকে সম্ভাব্য প্রশাসনিক রাজধানীর জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়। এখানে বিশাল খালি জমি ও নদীবক্ষ থাকায় পরিকল্পিতভাবে রাস্তা, সেক্টর, প্রশাসনিক এলাকা, আবাসন, সবুজ এলাকা তৈরি করা সম্ভব। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব। মেট্রো-রেলের সম্প্রসারণ, হাইওয়ে এবং রেলপথের সম্ভাবনা। পদ্মা সেতুর দুই পাশে শিল্পাঞ্চল, লজিস্টিক জোন এবং নগরায়ন দ্রুত বাড়ছে। ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জের মতো অতিরিক্ত ঘনবসতি নেই। তাই নতুন রাজধানী গড়ার জন্য আদর্শ। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রয়োজন, নদীভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা জরুরি, বড় অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় বেশি হবে।
২. গাজীপুর-কালিয়াকৈর (হাইটেক অঞ্চল) এ অঞ্চলকে ‘টেক-নগর’ বা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ভাবা হয়। হাইটেক পার্ক, এক্সপ্রেসওয়ে, রেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন সবই বিদ্যমান।
ঢাকা থেকে এটি অদূরে, কিন্তু সংযুক্ত। রাজধানী খুব দূরে সরাতে হবে না, তবে অতিরিক্ত চাপ ঢাকা থেকে সরানো যাবে। স্মার্ট সিটি গড়ার জন্য উপযুক্ত। ডিজিটাল সরকার, প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশাসন, গবেষণা উদ্ভাবন কেন্দ্র এখানে গড়ে তোলা সম্ভব। উত্তরাঞ্চল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাথে উন্নত যোগাযোগ। দেশের এই অংশগুলো বেশি সুবিধা পাবে। বনাঞ্চল ও পরিবেশ রক্ষার বিষয় রয়েছে, ঢাকার সাথে দ্রুত নগরায়ন একীভূত হয়ে যেতে পারে (ঢাকা-গাজীপুর মেগা-সিটি)
৩. মধুপুর-টাঙ্গাইল অঞ্চল। অনেক গবেষণা এই অঞ্চলকে ‘টেকসই প্রশাসনিক রাজধানী’ হিসেবে সম্ভাবনাময় মনে করে। এর সুবিধা উচ্চভূমি (ঞবৎৎধপব ষধহফ)। সমতল নয়, তুলনামূলক উঁচু এলাকা বন্যা ও নদীভাঙন কম। সিসমিক মানচিত্রে এই অঞ্চল ভূমিকম্পের মাঝারি ঝুঁকিতে, ঢাকার মতো উচ্চ ঝুঁকিতে নয়। দেশের ভৌগোলিক কেন্দ্রের কাছাকাছি। উত্তরের জেলা, দক্ষিণাঞ্চল, পূর্ব-পশ্চিম সব দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগ। বনাঞ্চল ও খোলা জায়গা : থাকায় নতুন পরিকল্পিত প্রশাসনিক শহর ও সবুজ রাজধানীর সম্ভাবনা রয়েছে। বনাঞ্চল রক্ষা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা সমন্বয় করতে হবে, রেল ও হাইওয়ে অবকাঠামো সম্প্রসারণ প্রয়োজন, জনসংখ্যা স্থানান্তর ও নতুন প্রশাসনিক শহর নির্মাণের বড় ব্যয় হবে।
সম্ভাব্য তিন বিকল্পের তুলনা সংক্ষেপে বলা যায়, পদ্মা সেতুর আশপাশের জাজিরা শরীয়তপুর অঞ্চলের বড় সুবিধা হলো বিশাল খালি জমি, নতুনভাবে রাজধানী পরিকল্পনার সুযোগ, কৌশলগত অবস্থান এবং দ্রুত অবকাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা। তবে বন্যা ও নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ এবং তীর রক্ষা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। গাজীপুর কালিয়াকৈর এলাকায় আগে থেকেই উন্নত অবকাঠামো, প্রযুক্তিনির্ভর নগর গঠনের উপযোগী পরিবেশ এবং ঢাকার সাথে শক্ত যোগাযোগ রয়েছে, কিন্তু অতিরিক্ত জনঘনত্ব, বনপরিবেশ রক্ষা এবং আরো অবকাঠামো সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা বড় সীমাবদ্ধতা। মধুপুর টাঙ্গাইলের মূল শক্তি হলো উচ্চভূমি হওয়ায় বন্যা ঝুঁকি কম, ভূমিকম্প ঝুঁকি তুলনামূলক কম এবং দেশের ভৌগোলিক কেন্দ্র হিসেবে সারা দেশের সাথে সহজ সংযোগের সম্ভাবনা; তবে এখানে বড় আকারে নতুন পরিবহন অবকাঠামো তৈরি ও সীমিত বিদ্যমান সুবিধা উন্নয়নই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি



