১০ অক্টোবর স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাসস্থানে ফিরতে শুরু করেছেন। আলজাজিরা জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ইতোমধ্যে অন্তত ১৪৩টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ দিকে যুদ্ধবিরতির মধ্যে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ১৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ট্রাম্পের সর্বশেষ এ উদ্যোগে সত্যিই কি ইসরাইলি বর্বরতার অবসান ঘটবে? ফিলিস্তিনে কি এবার শান্তি ফিরে আসবে?
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার দ্বিতীয় বার্ষিকীর প্রাক্কালে মিসরে আলোচনা শুরু হয় এবং বেশির ভাগ ইসরাইলি এ আলোচনার প্রতি তাদের সমর্থন জানান। ট্রাম্পের এ পরিকল্পনায় হামাসের প্রতি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব জীবিত ও মৃত ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। হামাস ঘোষণা করে, তারা পরিকল্পনাটি সতর্কতার সাথে গ্রহণ করেছে। তারা গাজা থেকে ইসরাইলি প্রত্যাহার ও ট্রাম্পের নেতৃত্বে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন শাসকগোষ্ঠীসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ বিষয়ে তাদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়।
কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনার ব্যাপারে উভয় পক্ষের আপত্তি আছে বলে মনে হলেও বাস্তবতা হলো- এই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগতভাবে গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে কমপক্ষে ৬৭ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও এক লক্ষাধিক আহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে গাজার ৮০ শতাংশের বেশি অবকাঠামো ধ্বং হয়ে গেছে। পরিকল্পনাটিতে বিস্তারিত কিছু না থাকলেও এতে কিছু শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন- ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি ও গাজার স্থায়ী ইসরাইলি দখলদারিত্ব টেবিল থেকে সরিয়ে নেয়া। এখন এটি সত্য যে, ট্রাম্প ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছেন। এটিও মনে হচ্ছে যে, ট্রাম্প দু’সপ্তাহ আগে নিউইয়র্ক আরব ও মুসলিম নেতাদের সাথে যে মূল নথিটি শেয়ার করেছিলেন, তাতে কিছু সংশোধনী আনার ব্যাপারে তাকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল।
এটিও লক্ষণীয়, ট্রাম্পের গৃহীত পরিকল্পনার প্রতি হামাসের ‘হ্যাঁ কিন্তু’ প্রতিক্রিয়া একটি ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়েছে। উল্লেখ্য, ট্রাম্প তার জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকে পরোক্ষভাবে আলোচনার তদারকি করতে মিসরে পাঠান। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, নেতানিয়াহু হামাসের শর্তসাপেক্ষ প্রতিক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখেছিলেন। তবু ট্রাম্প ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীকে শার্ম আল শেখে তার প্রতিনিধিদল পাঠানোর জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
ট্রাম্প প্রথমে নেতানিয়াহুর গাজা দখলের পরিকল্পনা সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তারপর তিনি হঠাৎ করে অবস্থান পরিবর্তন করেন। এ ছাড়া আরব ও মুসলিম নেতাদের সাথে বৈঠকের আহ্বান জানান। তিনি সেখানে যুদ্ধের অবসান ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন।
ট্রাম্পের এ মনোভাব পরিবর্তনে পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় থাকতে পারে। গত মাসে দোহায় মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার করতে যখন হামাস নেতারা জড়ো হয়েছিলেন সেখানে ইসরাইলের নির্লজ্জ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হামলা ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে দুই-রাষ্ট্র সমাধান সমর্থন করতে সৌদি আরব ফরাসি উদ্যোগ ও সম্ভাব্য আরেকটি কারণ হতে পারে- যার পরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, মূল কারণ ছিল ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ মহল স্বীকার করতে শুরু করেছে, নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি ইসরাইলের জন্যও ব্যক্তিগত দায় হয়ে উঠেছেন। ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ তেলআবিবকে বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীনভাবে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যুদ্ধের ব্যাপারে মার্কিন অবস্থান তার নিকটতম মিত্রদের অবস্থানের বিরোধী।
তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক জনমতের জোয়ার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে, বিশেষভাবে উভয় দলের তরুণদের মধ্যে এটি দেখা গেছে। এমনকি আমেরিকান ইহুদিরাও এখন দ্ব›েদ্ব ভুগছেন। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১০ জন মার্কিন ইহুদির মধ্যে চারজন একমত, ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে।
আরব ও মুসলিম মিত্ররা গাজায় রক্তপাত বন্ধের ট্রাম্পের ওপর চাপ প্রয়োগ করার যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। ট্রাম্পের পরিকল্পনা আদর্শ নয় এবং এর বিস্তারিত বিবরণ দেখলে মনে হয়- নেতানিয়াহুকে সময় বের করে তা প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। তার চরম ডানপন্থী কোয়ালিশনের অংশীদাররা তিনি গাজা থেকে প্রত্যাহারে রাজি হলে এবং যুদ্ধের অবসান ঘটালে পদত্যাগ করার হুমকি দিচ্ছেন। এখন তিনি দেখতে পাচ্ছেন, হামাস যেসব জিম্মিকে মুক্তি দেবে বলেছে, কথাটি তারা বাস্তবায়ন করে কি না।
তবে নেতানিয়াহু ট্রাম্পের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। ট্রাম্প এখন এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। অন্যান্য জটিল বিষয় পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন আরো জটিল করে তুলবে। এর মধ্যে প্রধান হলো নিরস্ত্রীকরণের বিষয়, পরিচালনা পরিষদ, সেখানে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরপর হলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভবিষ্যৎ ভূমিকা, যদি থাকে, গাজা থেকে সম্পূর্ণ ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার, পুনর্গঠন ও পশ্চিমতীরের ভবিষ্যতের সাথে সংযোগ।
আরেকটি জটিল বিষয় হলো- গাজায় একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতি, যেটি হবে একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী। অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে এ ধরনের একটি বাহিনী মোতায়েনের ঘটনা এটিই হবে প্রথম। এ ধরনের বাস্তবতা নেতানিয়াহু এবং তার অংশীদারদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নের কারণ হবে। এটি একদিন পশ্চিমতীরের জন্যও প্রস্তাব করা হতে পারে।
এটি একটি ভালো খবর যে, সমঝোতা অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, চুক্তিটি যেহেতু কার্যকর হচ্ছে- আশা করা যায়, গাজায় নির্বিঘেœ ত্রাণ সহায়তাও প্রবেশ করতে পারবে।
ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা হলো- মধ্যপ্রাচ্যের ধারাবাহিক পরিকল্পনা খুব কম তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করে থাকে। তারা যেমন বলে, শয়তান খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে। আর নেতানিয়াহু যেকোনো চুক্তিতে সূ²ভাবে কোনো কিছু লিখতে সময় নষ্ট করবেন না। এখানে উল্লেখ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- হামাস এ ভূখণ্ড পরিচালনায় কোনো ভূমিকা না রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর অর্থ হলো- ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে একপর্যায়ে কিছু বিষয়ে অবশ্যই
পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এটি ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র স্বীকৃত সংস্থা।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকা ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন থেকে সরে এসেছিল। এর একটি কারণ ছিল : নেতানিয়াহু এ ভূমিকা পথভ্রষ্ট করেছিলেন।
বর্তমানে ট্রাম্প আমেরিকাকে আবার চালিকাশক্তির আসনে বসিয়েছেন এ আশায় যে, গাজা যুদ্ধবিরতি একটি বৃহত্তর চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো- ট্রাম্প এখন তার মুসলিম মিত্রদের কথা শুনছেন বলে মনে হচ্ছে। যদি তিনি তার নতুন উদ্যোগের ব্যাপারে দৃঢ় থাকেন; তাহলে একটি নতুন শান্তি প্রক্রিয়ার ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে। অবশ্যই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে।



