মো: রফিকুল ইসলাম
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলায় নারী-জাগরণের এক অসামান্য ও মহীয়সী পথিকৃতের জন্ম হয়েছিল। তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। একেবারে পশ্চাৎপদ ও রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের গভীর থেকে তিনি কিভাবে এত আধুনিক নারীবাদী চেতনা লাভ করলেন তা আজও বিস্ময়। শৈশব-কৈশোরের চার দেয়ালে আবদ্ধ, অধিকারবিহীন নারীজীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাই সম্ভবত তাকে নারীর স্বাধীন মর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন করেছিল।
গভীর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন, নারীর উন্নয়ন বা মুক্তি কারো দয়া বা পুরুষের দানে আসবে না; নারীকেই নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। পুরুষের সমান অধিকার ও সমমর্যাদা নারীর জন্মগত অধিকার এই দাবি তুলে রোকেয়া বাংলার মুসলিম সমাজে নারীমুক্তির সংগ্রামের সূচনা করেন। এ বিষয়ে আজীবন সোচ্চার ও সক্রিয় থেকেছেন।
১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দের এক জমিদার পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম। ক্ষণজন্মা এই নারী মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তার বাবা জহির মোহাম্মদ আবু আলী সাবের ছিলেন জমিদার। তার দুই ছেলে আবুল আসাদ ইব্রাহিম সাবের ও খলিল সাবের এবং তিন মেয়ে করিমুন্নেসা, রোকেয়া ও হুমায়রা। রোকেয়ার দুই ভাই কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। তারা ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের ব্যক্তিগত তত্ত¡াবধানে করিমুন্নেসা ও রোকেয়া ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন।
আনুমানিক ১৩ বছর বয়সে বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে রোকেয়ার বিয়ে হয়। স্বামী ছিলেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। রোকেয়ার যখন জন্ম সেই সময়টি ছিল ভারতীয় মুসলিম সমাজের জন্য চরম সঙ্কটময় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইংরেজ সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন-১৭৯৩, লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ আইন-১৮২৮ এবং অন্যান্য পদক্ষেপ মুসলমানদের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর ছিল মারাত্মক আঘাত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ এটি ছিল লাখেরাজ সম্পত্তির ওপর নির্ভরশীল।
প্রকৃত শিক্ষার অভাবে মুসলমান সমাজ ধর্মের নামে নানাবিধ অধর্ম ও কুসংস্কারের বেড়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে ইসলামের আদর্শ তথা সাম্যবাদ ও ভ্রাতৃত্বের নীতি থেকে ভারতীয় মুসলিম, বিশেষত বাঙালি মুসলিম সমাজ অনেক দূরে সরে যায়। রক্ষণশীলতা ও পশ্চাৎমুখিতা সবদিক দিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে গ্রাস করে।
মুসলিম সমাজে প্রচলিত অবরোধ প্রথার কঠোরতা উপলব্ধির জন্য বেগম রোকেয়ার নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটিই যথেষ্ট- ‘শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ভরা সন্ধ্যার সময় এক ভদ্রলোক ট্রেনের অপেক্ষায় পায়চারি করিতেছিলেন। কিছু দূরে আর একজন ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাহার পার্শ্বে একগাদা বিছানা ইত্যাদি ছিল। পূর্বোক্ত ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ ক্লান্তি বোধ করায় উক্ত গাদার উপর বসিতে গেলেন, তিনি বসিবা মাত্র বিছানা নড়িয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সভয়ে লাফাইয়া উঠিলেন। এমন সময় সেই দণ্ডায়মান ভদ্রলোক দৌড়াইয়া আসিয়া সক্রোধে বলিলেন, ‘মশাই করেন কি? আপনি স্ত্রীলোকদের মাথার উপর বসিতে গেলেন কেন?’ বেচারা হতভম্ব হইয়া বলিলেন, ‘মাফ করবেন মশাই! সন্ধ্যায় আঁধারে ভালোমত দেখিতে পারি নাই, তাই বিছানার গাদা মনে করিয়া বসিতেছিলাম। বিছানা নড়িয়া উঠায় আমি ভয় পাইয়াছিলাম যে, একি ব্যাপার!”
এ থেকে বোঝা যায়, পর্দার আবরণে কিভাবে মেয়েদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। জাতির এমনই ক্রান্তিলগ্নে অন্ধকারে আলোর দিশারি হিসেবে আবির্ভূত হন বেগম রোকেয়া। একাধারে সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক, নারী জাগরণের অগ্রদূত ইত্যাদি বহুবিধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। তার চিন্তাশক্তি ছিল পরিপক্ব ও দূরদর্শিতা, লেখা ছিল যুক্তিপূর্ণ ও সাহিত্যরসে ভরপুর।
রোকেয়া মনেপ্রাণে অনুধাবন করেছিলেন, শিক্ষা পেলে নারীমনে সচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠতে পারে এবং সমাজে নারী তার নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হতে পারে। এই লক্ষ্যে তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা নেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। এটিই কলকাতার বুকে স্থাপিত প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। একজন মহিলার পক্ষে কলকাতার মতো এত বড় শহরে স্বামী প্রদত্ত ১০ হাজার টাকা দিয়ে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা কত বড় সাহসের কাজ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রবল সামাজিক বিরোধিতা, সরকারি অনুদানের অভাব ইত্যাদি বহুবিধ প্রতিকূলতার মুখেও এই মহীয়সী ক্ষণজন্মা দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে গেছেন শুধু নারী সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য।
বেগম রোকেয়াকে বুঝতে হলে তার সময়ের প্রেক্ষাপটে তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। যেহেতু অবরোধ প্রথার কারণে সে সময়ে মেয়েরা চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হতো, তাই রোকেয়া পর্দা রক্ষা করেই মেয়েদেরকে শিক্ষার্জনে আগ্রহী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ- তিনি পুরুষদেরকে অবজ্ঞা করে মেয়েদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন, ব্যাপারটি এমন নয়। কাজী নজরুল ইসলামের অভূতপূর্ব কাব্যিক ছন্দের প্রতিধ্বনিতে বিদুষী নারী বেগম রোকেয়ার জীবন আদর্শে বাস্তব রূপ দেখতে পাই-
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’
‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পুরুষের তরবারি;
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়াল²ী নারী।’
কাজী নজরুল ইসলামের এই কালজয়ী বাণী সমাজে খুব সহজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। অথচ নারী পুরুষের সমতার দাবি জানিয়ে বহু আগেই কলম ধরেছিলেন বেগম রোকেয়া।
নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে আপন ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়ে বেগম রোকেয়া লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে, পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ সবই হইব।’ তিনি আরো বলেন, ‘আয় করিব না কেন? আমাদের কি হস্ত নেই, কদম নেই, না বুদ্ধি নেই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহস্থালি কার্যে ব্যবহার করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবস্থা করতে পারিব না? আমরা যদি পাতশাহী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ... কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও নিজের অন্ন, বস্ত্র নিজে আয় করুক।’
বেগম রোকেয়া সমাজে নারীর অবনত অবস্থার জন্য সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, নারী-পুরুষের মধ্যকার বিরাজমান সামাজিক বৈষম্যসহ নারীর সমান সুযোগের অভাবকে যেমন দায়ী করেছেন, তেমনই নারীর অসচেতনতা, নিষ্ক্রিয়তা, দায়িত্বহীনতা ও মানসিক দৃঢ়তার অভাবকেও দায়ী করেছেন।
তিনি শিক্ষাকে নারীর শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘এ শক্তি লাভ করলে নারীর উন্নয়ন ঘটবে। পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে তার ক্ষমতায়ন হবে।’ এটি ছিল তার নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার যুগান্তকারী আহ্বান।
১৯১৬ সালে তিনি গঠন করেন ‘আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ (বাংলা মুসলিম মহিলা সমিতি)। এর মাধ্যমে নারীশিক্ষা, বিধবা পুনর্বিয়ে, বহুবিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বর্তমান বাংলাদেশের নারীশিক্ষায় ও নারীসমাজ সম্পর্কে রোকেয়া যা চেয়েছিলেন, তার অনেকটাই আমরা অর্জন করেছি। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৪ অনুযায়ী, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। আজ নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পুরুষের মতো অবদান রাখছে। নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারও কাজ করে চলেছে। নারী ও মহিলা-বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা উন্নয়নমূলক কাজ করে চলেছে।
বেগম রোকেয়া ১০০ বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার বড় অংশ পূরণ হয়েছে। চব্বিশের জুলাই যুদ্ধে ছেলেদের অগ্রভাগে মেয়েরা অংশ নিয়েছে। বর্তমানে নারীরা নিজেদেরকে সুশিক্ষিত করে সমাজের সর্বস্তরে অবদান রাখছে। ‘শিক্ষা হলো নারীর মুক্তির চাবিকাঠি’ বলেছিলেন বেগম রোকেয়া। সেই চাবি আজ আমাদের নারীদের হাতে।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা


