বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। আমরা জানি, সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের পতনের পর গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল। বর্তমানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র আধুনিক সভ্যতার চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী অনেকাংশে প্রত্যাখ্যাত। এদিকে করপোরেট বা বহুজাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা ও বুর্জোয়া অর্থনীতির চরম বিকাশ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার টুঁটি চেপে ধরেছে। করপোরেট ব্যবসায়-বাণিজ্যের কারণে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের দ্রুত অবলুপ্তি ঘটছে। ফলে পুরো বিশ্বে বেকারত্বের হার বাড়ছে। অন্যদিকে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বিশেষত আমেরিকা পুরো পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক প্রভুত্ব বিস্তার করছে। তাদের অর্থনৈতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেতে ইউরোপের দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করে। এমনকি এ সংস্থার অধীনের দেশগুলো মার্কিন ডলারের প্রভুত্বের মোকাবেলায় ইউরো নামে আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অপরদিকে, চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারতসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশ মিলে প্রস্তাবিত ‘ব্রিকস মুদ্রা’ ব্যবস্থা গড়ে তুলে ডলারের অব্যাহত প্রভুত্ব খর্ব করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমেরিকা বৈশ্বিক পরিস্থিতির এ পরিবর্তন মোকাবেলায় কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভারতীয় পণ্যের উপরে ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। যার প্রভাবে ভারতীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পুরো পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের পণ্যের উপরও আমেরিকা শুল্কহার বাড়িয়েছে। যে কারণে আমেরিকার সাথে অনেক রাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তদুপরি আমেরিকা বর্তমানে ভেনিজুয়েলার সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছে। প্রতিক্রিয়ায় চীন ও ইরান প্রকাশ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে ভেনিজুয়ালাকে সমর্থন দিয়েছে। রাশিয়াও ভেনিজুয়েলার পক্ষাবলম্বন করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে অস্ত্র বিক্রির নতুন কৌশল হিসেবে ইসরাইলের মাধ্যমে আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্র বলে পরিচিত কাতারের উপর বিমান হামলা চালিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর হুঁশ ফিরতে শুরু করেছে। স¤প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসলামী সেনাবাহিনী নামক একক সেনাবাহিনী গঠনের কথা ঘোষণা করেছে। যা ইসরাইল ও আমেরিকার জন্য একটি দুঃসংবাদ।
আমেরিকা ও চীনের সম্পর্ক আগের থেকে অবনতি ঘটেছে। চীনা নৌবহর ভেনিজুয়েলার সমর্থনে আমেরিকা অভিমুখে গমন করেছে। চীন ও রাশিয়ার কিছু সাবমেরিন ভেনিজুয়েলার পক্ষে আমেরিকা উপকূলে মোতায়ন করেছে। পাকিস্তানও সর্বপ্রথম ইসরাইলে বোমা হামলার হুমকি দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থা এখন বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। মূলত বৈশ্বিক রাজনীতিতে করপোরেট বাণিজ্যব্যবস্থার মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর বাণিজ্য ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুস্পষ্ট প্রবণতা শুরু হয়েছে।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও প্রভূত পুঁজি বিনিয়োগে করপোরেট বাণিজ্যব্যবস্থার সাথে ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তারা তাল মেলাতে না পেরে ক্রমাগত তাদের ব্যবসায়িক পদ্ধতির অবনতি ঘটছে। আর প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের কিছু পরাশক্তি নামধারী দেশ তাদের অস্ত্রভাণ্ডার ক্রমাগত সর্বাধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করছে। তৃতীয় বিশ্বের তথা পৃথিবীর দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো প্রযুক্তিজ্ঞানের স্বল্পতায় ও পর্যাপ্ত পুঁজি বিনিয়োগের অভাবে উন্নত বিশ্বের সমরাস্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার উন্নত করতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে নিরাপত্তার তাগিদে উন্নত বিশ্ব থেকে চড়া মূল্যে অস্ত্র কিনতে হচ্ছে।
পরাশক্তিগুলো নিজেদের সামরিক শক্তি নিরঙ্কুশ রাখার প্রক্রিয়ায় তৃতীয় বিশ্বের তথা দরিদ্র বিশ্বের দেশগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। আমরা জানি, পারমাণবিক অস্ত্র এমন এক অস্ত্র যা দিয়ে সহজে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এ উপলব্ধি থেকে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো কখনো চায় না, পৃথিবীর অনুন্নত বা দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে তাদের সাথে শক্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হোক। এ উপলব্ধি থেকে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরাইলের মাধ্যমে বিমান হামলা করে ধ্বংস করা হয়েছিল। লিবিয়াতেও তথাকথিত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অজুহাত তুলে আমেরিকার পক্ষ থেকে আক্রমণ করা হয়েছিল। বর্তমানে ইরানের ওপর একই অভিযোগে আমেরিকা বিমান হামলা চালিয়ে ইরানের পারমাণবিক গবেষণাগারের প্রভূত ক্ষতি করেছে। অথচ এ দেশগুলো বারবার বলে এসেছে, তারা পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করতে চায়। তারা উৎপাদনের বিভিন্ন শাখায় পারমাণবিক শক্তি কাজে লাগাতে চায়। আমেরিকা বা পরাশক্তি দেশগুলো কখনো তাদের এ বক্তব্য মেনে নেয়নি। যে কারণে বছরের পর বছর পৃথিবীতে অবাঞ্ছিত যুদ্ধ বিগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম উত্তর কোরিয়া, তারা আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করেনি; বরং তার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।
ইতোমধ্যে পুরো পৃথিবীতে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো পারমাণবিক নীতির বিরুদ্ধে জনমত সোচ্চার হচ্ছে। তবু অনেক রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো থেকে তাদের বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ হতে পারে। মূল কথা, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে পারমাণবিক শক্তির ভয় দেখিয়ে আর বেশি দিন দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আগামীতে করপোরেট বাণিজ্যব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটবে বলে আশা করা যায়।
তৃতীয় বিশ্বের ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্য থেকে অনেক রাষ্ট্র বিভিন্ন কৌশলে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়। এমনকি পৃথিবীর সব পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র রাজনীতির একই বলয়ে অবস্থান করছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র দু’টি হলো আমেরিকা ও রাশিয়া। এ দু’টি রাষ্ট্র রাজনৈতিক দিক দিয়ে আদর্শিকভাবে পরস্পরের বিরোধী। সে ক্ষেত্রে এ পরস্পরবিরোধী শক্তিধর দেশ দু’টি নিজেদের বলয়ে অবস্থানরত দেশগুলোকে যেকোনো মুহূর্তে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করতে পারে। অনেকের ধারণা, আমেরিকার পক্ষ থেকে ইসরাইলকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। তা যদি সত্য হয়, তাহলে আগামীতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে মস্কোর বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করা হবে না- তার গ্যারান্টি কী? সে কারণে বলা যায়, বর্তমানে পৃথিবী বাণিজ্যিক ও সামরিক দিক দিয়ে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে তার বিস্ফোরণ হতে পারে।
লেখক : সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ