২০২৫ সালের যুগান্তকারী রায়গুলো

২০২৫ সালের এমন বিচারিক সক্রিয়তা কেবল অতীতের কলঙ্ক থেকে মুক্তি দান করেনি; বরং বাংলাদেশের আগামীর গণতান্ত্রিক পথচলাকে করেছে কণ্টকমুক্ত।

২০২৫ সাল বাংলাদেশের আইন ও সাংবিধানিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। টানা দেড় দশকের বেশি সময় আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র শাসনের অবসানের পর, বিচার বিভাগ তার হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। সেই সাথে পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বিচারিক প্রক্রিয়ায় যে বিকৃতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছিল, তা নিবিড়ভাবে পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অতীতের সব অন্যায়ের প্রতিকার হয়তো রাতারাতি করা সম্ভব হয়নি, তবে আদালত বেশ কিছু সাহসী এবং সংশোধনমূলক রায়ের মাধ্যমে বিচারিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। সময়ের আবর্তে এখন বছর বিদায়ের লগ্ন, তাই সময় হয়েছে ২০২৫ সালের সেই ঐতিহাসিক বিচারিক সিদ্ধান্তগুলোর দিকে ফিরে তাকানো।

এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাস

আওয়ামী লীগ শাসনামলে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ছয়জন রাজনীতিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ স্রেফ তার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনের প্রচলিত ধারা বদলে দিয়েছিলেন। যদিও ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে আন্তর্জাতিক আইনের প্রাসঙ্গিকতার কথা স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, তবু বাংলাদেশের সেই বিচারিক প্রক্রিয়া থেকে আন্তর্জাতিক আইনকে একপ্রকার নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের ২৭ মে এ টি এম আজহারুল ইসলাম বনাম চিফ প্রসিকিউটর মামলায় আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায়ে আওয়ামী লীগ আমলে দেয়া ছয়জন বিরোধী রাজনীতিকের মৃত্যুদণ্ডের আইনগত ভিত্তি কার্যত বাতিল করে দেন।

আদালত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিমালাগুলো বিবেচনায় নিতে আদালত ব্যর্থ হয়েছিল। এর ফলে বিচারিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা হয়নি। একইসাথে একটি গুরুতর বিচারিক বিভ্রান্তি (গ্রেভ মিসক্যারেজ অব জাস্টিস) সংঘটিত হয়েছে। এ রায়ের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিকটি ছিল, আদালতের আত্মসমালোচনামূলক বা ‘অনুতপ্ত সুর’। আদালত আগের মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক চরিত্র যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন। এর মাধ্যমে আদালত শুধু আইনি নয়, নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায়টি অবশেষে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে সর্বজনীন ও প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের মূলধারায় ফিরিয়ে আনল।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬-এর মূল বিষয় পুনঃস্থাপন

২০২৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের ওপর এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ নং অনুচ্ছেদকে তার আদি ও অকৃত্রিম রূপ, তথা ১৯৭২ সালের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এ রায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে আরো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ রায়ের আগ পর্যন্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত ছিল, যা কেবল ‘সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে’ প্রয়োগ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের খবরদারির এক আইনি হাতিয়ার। এর ফলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি কার্যত সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় পরিণত হয়েছিল। এটি কেবল ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতিকে ভূলুণ্ঠিত করেনি, বরং বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবকে স্থায়ী রূপ দিয়েছিল। হাইকোর্ট বিভাগ তার যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং শৃঙ্খলাসংক্রান্ত যাবতীয় পূর্ণ কর্তৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন- ঠিক যেমনটি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অভিপ্রায় ছিল। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে সংবিধান এখন প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির সাথে একাত্ম হলো এবং অধস্তন আদালতগুলো অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের প্রকৃত অভিভাবকত্বের ছায়াতলে আশ্রয় পেল।

ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়

২০২৫ সালের ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনঃস্থাপন করেন। ফলে পুনরুজ্জীবিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এ রায়ের মাধ্যমে আদালত ২০১১ সালে তার নিজের দেয়া সেই বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি বাতিল ঘোষণা করেন, যা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বিলুপ্ত করে গত দেড় দশক ধরে সাংবিধানিক কাঠামো থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এ টি এম আজহারুল ইসলাম মামলার পূর্ববর্তী রায়ের সাথে একত্রে মিলিয়ে দেখলে, রায়টি ২০২৫ সালের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দু’টি বিচারিক সিদ্ধান্তের একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, যে সিদ্ধান্তগুলো পদ্ধতিগতভাবে সেই বিচারিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে, যার ওপর ভর করে শেখ হাসিনার অধীনে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার সংহতি ও বিস্তার সম্ভব হয়েছিল।

সংক্ষিপ্ত মৌখিক আদেশে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার বিধানগুলো রায়ের তারিখ থেকে কার্যকর করেন। এর ফলে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনগুলো (যার কোনোটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি) সাংবিধানিকভাবে বৈধ রয়ে গেল। আদালতের এ বিচক্ষণতা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার প্রতি অঙ্গীকার প্রকাশ করে; যাতে বিগত সংসদ, সরকার এবং আইনগুলো কোনো আইনি অনিশ্চয়তায় না পড়ে, অথচ একই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও নিশ্চিত হয়। পুনঃস্থাপিত এই তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা কার্যকর হবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর। যখন চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হবে, তখন বাংলাদেশ ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে তার প্রথম নবজাত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেখা পাবে।

জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন পুনর্বহাল

২০২৫ সালের ১ জুন বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে আরো একটি মাইলফলক অর্জিত হয়, যখন আপিল বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পুনর্বহাল করেন। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চলা এক আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল ২০০৯ সালে জামায়াতের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দায়ের করা একটি রিট পিটিশনের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বিশেষ বেঞ্চ ২-১ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দলটির নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করে। সেই বেঞ্চের একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী বিচারক এম. মোয়াজ্জেম হোসেন আইনি নীতির ওপর রাজনৈতিক বিবেচনাকে স্থান দিতে অস্বীকার করে রিটটি খারিজ করে দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্ররোচনায় নিবন্ধন বাতিলের আদেশ দেয়া সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।

২০২৩ সালে জামায়াতের আপিল আবেদনটি শুনানির কোনো সুযোগ না দিয়ে খারিজ করে দেয়া হয়েছিল। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং আপিল বিভাগ পুনর্গঠিত হওয়ার পর, আপিলটি পুনরায় সচল হয়। সেই সাথে গুণগত মানের ভিত্তিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৫ সালের রায়ে আপিল বিভাগ বিচারপতি মোয়াজ্জেম হোসেনের সেই সংখ্যালঘু মতটি গ্রহণ করে জামায়াতের রাজনৈতিক নিবন্ধন সগৌরবে ফিরিয়ে দেন।

সীমানা নির্ধারণ মামলার রায়

২০২৫ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে হাইকোর্ট বিভাগের সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন, যেখানে নির্বাচন কমিশনের একটি গেজেটকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই গেজেটের মাধ্যমে ২০২৬ সালের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে বাগেরহাটের চারটি সংসদীয় আসন কমিয়ে তিনটি করা হয়েছিল এবং গাজীপুরে একটি নতুন আসন (গাজীপুর-৬) তৈরি করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ নিশ্চিত করেন, নির্বাচন কমিশনের এ সীমানা বিন্যাস ছিল সাংবিধানিক ও জনতাত্তি¡ক যুক্তিবহিভর্ূত। এ রায়ের ফলে বাগেরহাটের চারটি আসন পুনঃস্থাপিত হয় এবং গাজীপুরের পাঁচটি আসন অপরিবর্তিত থাকে। বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রায়টি প্রমাণ করল যে, জনসংখ্যার সমতা, আইনি পরিপালন এবং প্রতিনিধিত্বের ন্যায্যতা নিশ্চিত করার স্বার্থে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের ওপর ‘বিচারিক তদারকি’ সম্ভব। হাইকোর্ট বিভাগ তার পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণে নির্বাচন কমিশন কোনো স্পষ্ট বিধি বা নির্দেশিকা অনুসরণ করেনি। আদালত দেখতে পান, কোন আসনটি বিলুপ্ত হবে আর কোনটি নতুন তৈরি হবে- সে সিদ্ধান্তে কমিশন চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছে। এটি আমাদের সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘ দিনের প্রথা থেকে এক আমূল বিচ্যুতি; কারণ ২০২৫ সালের আগে আদালত কখনো নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেনি। এ রায়ের অন্তর্নিহিত বার্তাটি অত্যন্ত পরিষ্কার : এখন থেকে সীমানা পুনর্নির্ধারণে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

সমাপনী বিশ্লেষণ

২০২৫ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রাতিষ্ঠানিক সাহস ও আত্মবিশ্বাসের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। দশকের পর দশক ধরে শিকড় গেড়ে বসা আইনি মতবাদগুলোর পুনর্বিবেচনা এবং প্রয়োজনে উল্টে দেয়ার মাধ্যমে আদালত প্রমাণ করেছেন যে, তারা ন্যায়ের পথে আপসহীন। আদালত এটি মেনে নিয়েছেন যে, জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার বিপ্লব কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়; বরং ছিল একটি সাংবিধানিক রূপান্তর, যা আমাদের এক নতুন আইনি ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ যুগান্তকারী রায়গুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়- আইন কখনো স্থবির হতে পারে না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সময়ের বাস্তবতা ও জনগণের নবজাগ্রত সাংবিধানিক আকাক্সক্ষার আলোকে আইনকে পুনর্মূল্যায়ন, সংশোধন ও সঠিক পথে ফেরানো অপরিহার্য। ২০২৫ সালের এমন বিচারিক সক্রিয়তা কেবল অতীতের কলঙ্ক থেকে মুক্তি দান করেনি; বরং বাংলাদেশের আগামীর গণতান্ত্রিক পথচলাকে করেছে কণ্টকমুক্ত।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি