দেশের আর্থরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কারা দায়ী

বিগত ক্ষমতাসীন সরকারের সময় দাবি করা হয়েছিল, দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত প্রতিটি উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের সাথে বিএনপি-জামায়াত জড়িত।

উগ্রবাদ পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে বিপন্ন করে। উগ্রবাদের কমবেশি উপস্থিতি নেই এরূপ রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে পৃথিবীতে বিরল। উগ্রবাদ দুই ধরনের। এর একটি অভ্যন্তরীণ মদদের মাধ্যমে সৃষ্ট, আর অপরটি আন্তর্জাতিক মদদের মাধ্যমে সৃষ্ট। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মদদে সৃষ্ট উভয় উগ্রবাদ রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক অথবা ধর্মীয় উদ্দেশ্য সম্বলিত হয়ে থাকে। সামাজিক বৈষম্য এবং ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি উগ্রবাদ উত্থানে বহুলাংশে দায়ী।

সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপে স্বল্পতম সময়ে আত্মপ্রকাশে সমর্থ হয়। যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়, তা হলো- গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত থাকবে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টির ২৩ বছর আগে ভারতবর্ষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে দেশ শাসনের ভার ছেড়ে দেয়া হলে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামের আবশ্যকতা দেখা দিত না। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসীরা স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বন করে। অন্য দিকে ধর্মীয় জাতিসত্তায় বিশ্বাসীরা যে আদর্শের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজন হয়েছিল তা অটুট রাখতে চায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্মীয় জাতিসত্তায় বিশ্বাসীরা পরাভূত হলে তাদের রাজনীতির অধিকার খর্ব করা হয়। বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী পিকিংপন্থীরা, ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট স্বাধীনতাকে নিছক আধিপত্যের পরিবর্তন গণ্য করে এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এতে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিকূল পরিবেশে তাদের অনেককে অনেকটা বাধ্য হয়ে অপ্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিতে হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বের বিরুদ্ধাচরণে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নামে যে রাজনৈতিক দলটির জন্ম হয়; এটি অচিরে সশস্ত্র গণবাহিনী সৃজনপূর্বক উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিধ্বস্ত দেশ গঠনে যখন স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের সব শক্তির ঐকান্তিক সহযোগিতা অত্যাবশ্যক ছিল; ঠিক তখন গণবাহিনী ও পিকিংপন্থীদের উগ্রবাদে লিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাসহ দেশকে অস্থিতিশীল করা অভ্যন্তরীণ নাকি আন্তর্জাতিক মদদে হয়েছিল, তা দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করা হলে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে দেশকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো না। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় দল দু’টির সমর্থন তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল জাসদের অনুকূলে চলে যায়।

বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল জাসদ, মুসলিম লীগ ও জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় যে হারে দলটির ভোট প্রাপ্তি প্রত্যাশিত ছিল নির্বাচনটির নিরপেক্ষতা বিঘিœত হওয়ায় ফলে তা প্রতিফলিত হয়নি। গণবাহিনী ও পিকিংপন্থীদের অপ্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষমতাসীনদের অস্তিত্ব এবং দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। এতে শেখ মুজিবুর রহমান অন্য সব দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হন। শেখ মুজিবুর রহমানের সিদ্ধান্তটি তার নিজের ও দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। ওই বিপর্যয়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাব দলটির ওপর গিয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু-পরবর্তী বাংলাদেশ দুইবার সামরিক শাসনের কবলে পড়ে। একই সাথে সামরিক শাসকরা এ দেশে পুনঃগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ সুগম করেন; যদিও সে গণতন্ত্র কখনো স্বচ্ছতার মাপকাঠিতে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দলটিকে ক্ষমতা না দেয়ায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে গেলেও তৎপরবর্তী এ দেশে দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন গণতন্ত্র সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিজয় ঘটেছে। অন্য দিকে দলীয় সরকারবিহীন অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল পরাভূত হয়েছে।

আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ ছিল। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী মুসলিম লীগ ও জামায়াত রাজনৈতিক দল হিসেবে আবিভর্ূত হতে পারেনি। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনসংক্রান্ত বিধিনিষেধ সামরিক শাসনামলে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা রহিত হলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের পথে বাধা অপসারিত হয়। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশটি সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা অনুমোদিত হয়। এরপর দেখা গেল, ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও এগুলোর মধ্যে বিশেষত জামায়াত কখনো এ দেশের বড় দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপির সাথে অবস্থান নিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষিত করছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যে সংশোধনী আনা হয়; তাতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের পূর্বাবস্থান অনুসৃত হয়। সংবিধানে এরূপ অবস্থান বিদ্যমান থাকলে ধর্মীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বলিত দল গঠন নিষিদ্ধ হলেও অজানা হিসাব-নিকাশে তা কার্যকর হয়নি। কথাটি অনস্বীকার্য যে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হলে, একই উদ্দেশ্যে গঠিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদকে নিষিদ্ধের বাইরে রাখার সুযোগ নেই।

নব্বই-পরবর্তী আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নবযাত্রা সূচিত হলে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আবির্ভাব ঘটে। দল দু’টির পাশাপাশি অন্য যে দু’টি দলের সরব উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়; সে দল দু’টি হলো- জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংসদ নির্বাচনকালীন জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর যে জনসমর্থন ছিল, তা বর্তমানে জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে ব্যাপকহারে সঙ্কুচিত হয়েছে। তবে জামায়াতের বেলায় অক্ষুণœ রয়েছে; এমনটি পরিলক্ষিত হয় মর্মে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনায় পরিলক্ষিত হয়, বিএনপির প্রতি জামায়াতের সমর্থন এবং দলটির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ জোটটিকে অপ্রত্যাশিত সাফল্য এনে দিয়ে আগের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়। এর পর থেকে এ দেশে যেকোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাতে জয়ের ক্ষেত্রে জামায়াতের সমর্থন বড় দু’টি দলের কাছে অত্যাবশ্যক বিবেচিত হতে থাকে।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত সবসময় ওঠানামা করে। দেখা যায়, একটি নির্বাচনে যে দল বিজয়ী হয়; পরবর্তী নির্বাচনে ওই দলের বিজয়ের সম্ভাবনা সঙ্গতকারণে কমে যায়। আমাদের দেশে জনমতের যে অবস্থান, তা বিবেচনায় নেয়া হলে সুষ্ঠু নির্বাচনে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে- বিষয়টি দেশের সচেতন মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। এ কারণে আদালতের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপসাধন করে একতরফা ও অনাকাক্সিক্ষতভাবে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। অভিজ্ঞতার আলোকে দেশে ভবিষ্যতে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার ফল কী হবে- সেটি আজ আর কারো কাছে অজানা নয়। আমাদের রাজনীতির আকাশে আজ প্রধান যে সমস্যা তা হলো- একটি সরকারের মেয়াদ অবসানে কী ব্যবস্থায় পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ প্রশ্নে কারো মধ্যে ন্যূনতম সংশয় নেই, দলীয় সরকারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচন-পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হবে। আমাদের দেশে বিভিন্ন দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচন অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ছিল। অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী দলীয় সরকারের ছত্রছায়ায় যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল, তা সংবিধান অনুসৃত পন্থায় না করায় সেটি যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, তা দেশবাসী অবগত।

পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন একতরফা ছিল। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের সাথে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের পার্থক্য- ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত বিল পাস করে সে সংসদের অবলুপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্য দিকে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ তিনটি সংসদ নির্বাচন একতরফা ও ভোটারবিহীন হওয়া সত্তে¡ও সে সংসদগুলো বহাল রাখা হয়েছিল। বিদেশী কোনো শক্তির সমর্থন নিয়ে একতরফাভাবে এ নির্বাচনগুলোর অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছিল, সে বিষয়ে দেশবাসীর স্পষ্ট ধারণা রয়েছে।

আমাদের দেশে বিগত দিনে ও বর্তমানে উগ্রবাদের যে উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছিল ও হচ্ছে- এ সংশ্লেষে সংঘটিত ঘটনাগুলোর সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে তা দেশীয় নাকি আন্তর্জাতিক মদদে হয়েছিল বা হচ্ছে, বিষয়টির সুরাহা হবে। আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট কট্টর সংগঠন তালেবান, উগ্রবাদী সংগঠন আলকায়দা, আইএস প্রভৃতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমফাইভ’, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদে’র তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ ও অর্থায়নে তাদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে সৃষ্ট। বাংলাদেশে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান- পরবর্তী সংঘটিত বেশ কিছু হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জড়িত মর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করে আসছে। এসব দাবি আদৌ সঠিক কি না, তা একমাত্র নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব।

বিগত ক্ষমতাসীন সরকারের সময় দাবি করা হয়েছিল, দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত প্রতিটি উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের সাথে বিএনপি-জামায়াত জড়িত। সরকারের এ অভিযোগের ভিত্তিতে বিগত দিনে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিহত হওয়া-পরবর্তী যে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল; তাতে জঙ্গি গ্রেফতারের নামে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বেশি করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সাঁড়াশি অভিযানে যেভাবে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাতে অভিযান-পরবর্তী এ দল দু’টির কোনোরূপ উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনার সামর্থ্য না থাকার কথা। কিন্তু গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ার ঈদগাহে সংঘটিত উগ্রবাদী কার্যক্রমে দেখা যায়, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ইংরেজি মাধ্যমে পড়–য়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা উভয় ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। প্রথমোক্ত ঘটনাটি সংঘটন-পরবর্তী দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘটনা নিরসনে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানো হয়েছিল। দলটির এ আহ্বানকে তখনকার সরকারি দল প্রথমত, ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও পরবর্তীতে সে অবস্থান থেকে সরে যায়। সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডে বিদেশী কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত তা তদন্তপূর্বক বের করতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা সংঘটন হতে নিষ্কৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে যতদিন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা তদন্তাধীন থাকাবস্থায় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শীদের দোষারোপ করা হবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের এ ধরনের ঘটনা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দুষ্কর।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী জাপান। আর আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরী পোশাক ক্রয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যে দেশের নাগরিকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য, দেশটি হলো- ইতালি। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর ঘটনায় উভয় দেশের বেশ কয়েকজন নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছে। এ মৃত্যু বিষয়ে উভয় দেশ হতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। অনুরূপ শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু ঘটনা ঘিরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। এভাবে আমাদের আর্থরাজনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখছে দেশের ও বিদেশের যেসব নাগরিক, তাদের কেউ নিহত হলে তা এক দিকে আমাদের আর্থরাজনীতি বিপর্যয় ডেকে আনবে। অন্য দিকে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত করবে। আমাদের এ ধরনের আর্থরাজনৈতিক বিপর্যয় হলে বাংলাদেশের প্রতিবেশী কারা লাভবান হবে, সেটি প্রণিধানযোগ্য। আর তাই আমাদের দেশে পরিচালিত উগ্রবাদী কার্যক্রম দেশীয় নাকি আন্তর্জাতিক মদদে হচ্ছে, সেটি সুরাহার আগে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ যদি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে অবস্থান নেয়, তাতে একে অপরকে দোষারোপের রাজনীতির অবসান ঘটবে, যা প্রকারান্তরে উগ্রবাদ অবসানে দৃঢ় ভিত্তি রচনা করবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক