শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ : শক্তি, সংস্কার ও স্বশাসনের কাঠামো

সুলতান সর্বদা একটি সুশৃঙ্খল ও বহুমাত্রিক প্রশাসনিক চক্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, যেখানে প্রতিটি স্তর কার্যকারিতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে। এই কাঠামো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতি নিশ্চিত করত। এর দিশা তৈরি হয় শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের আজাদির ধারাবাহিকতায়।

আল জাজিরা

১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বঙ্গদেশে প্রথম মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজ্য বিভক্ত ছিল নানা ইকতা বা প্রশাসনিক অঞ্চলে। পরে যখন গিয়াসুদ্দীন বলবনের (১২৬৬ থেকে ১২৮৭ সাল) বংশধররা শাসনভার নেন, তখন তারা রাজ্যের নাম দেন ইকলিম লখনৌতি। পূর্ববঙ্গকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হতো আরসাহ বঙ্গালাহ নামে।

সেন যুগে বাংলার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন বঙ্গ, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিখেল, চন্দ্রদ্বীপ, তাম্রলিপ্ত ইত্যাদি। প্রতিটি অঞ্চলের পৃথক রাজা ছিলেন। তেমনি একটি অংশ গৌড়ের রাজা ছিলেন ল²ণ সেন। গৌড় বলতে মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো বোঝাত। বঙ্গ বলতে বোঝা হতো ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলকে। পুণ্ড্র হলো বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর অঞ্চল। একটি অংশকে বরেন্দ্র বলা হতো, এখন রাজশাহী জেলার অন্তর্গত। রাঢ় বলতে বোঝাত ভাগীরথির পশ্চিম তীরের অঞ্চলগুলোকে। সমতট হলো দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং কুমিল্লøা ও নোয়াখালী জেলা। চন্দ্রদ্বীপ বলতে যে অঞ্চল বোঝাত, সেটি বর্তমানে বরিশাল জেলার অন্তর্গত। তাম্রলিপ্ত হলো সমগ্র মেদিনীপুর জেলা, এই মেদিনীপুর একসময় উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিল।

বখতিয়ার খিলজির বিজয় ছিল কেবল গৌড়ে। পরে ধীরে ধীরে তার রাজ্যসীমা প্রসারিত হয়। তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক (১৩২০-২৫) বাংলায় দিল্লির আধিপত্য কায়েম করেছিলেন এবং বহুধাবিভক্ত বাংলাকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করেছিলেন। ক. ল²ণাবতী; খ. সাতগাঁও বা সপ্তগ্রাম; গ. সোনারগাঁও। এই তিন প্রদেশের রাজধানীও ছিল আলাদা এবং শাসনকর্তা ছিলেন তিনজন। এরা ছিলেন দিল্লির অধীন এবং এই তিনজন শাসনকর্তার মধ্যে বিরোধ অব্যাহত ছিল। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার জনপদগুলো একীভূত করতে চাইলেন। বাংলার তিনটি প্রদেশ জয় করে বাংলার ভূমিগুলো একই রাষ্ট্রসীমায় যুক্ত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ উপাধি গ্রহণ করেন। বাংলার ইতিহাসে বাংলা এই প্রথম ‘বাঙ্গলা’ নামে পরিচিত হলো। এর আগে কখনো বাংলা নামে বাংলার ভূমিগুলো একক রাষ্ট্রকাঠামোতে আসতে পারেনি।

পুরো বাংলার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ইলিয়াস শাহ শুরু করেন বাংলার সীমানা সম্প্রসারণের প্রয়াস। দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তখন নানা বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত। সুলতান ইলিয়াস শাহ একে মোক্ষম সুযোগ হিসেবে নিলেন। তিনি বিহারে সাফল্যজনক অভিযান চালান। এরপর নেপাল জয় করেন ১৩৪৬ সালে। কাঠমান্ডু শহরে জয়রাজ দেবকে পরাস্ত করে বাংলার রাজ্যসীমায় একে যুক্ত করেন। এরপর উড়িষ্যা আক্রমণ করে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হন, যদিও শেষ অবধি উড়িষ্যা দখলে নিতে পারেননি।

ইলিয়াস শাহের সাফল্যে দিল্লি প্রকম্পিত হচ্ছিল। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৩৫৩ সালে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইলিয়াস শাহকে দমন করতে বঙ্গ অভিযানে আসেন। ইলিয়াস শাহ তার সুরক্ষিত একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজশাহ পাণ্ডুয়া দখল করে একডালা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন। বহু চেষ্টা করেও দুর্গটি দখল করতে ব্যর্থ হয়ে ১৩৫৪ সালে সন্ধি স্থাপন করে দিল্লিতে ফিরে যান।

১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীন সুলতানদের অধীনে পুরো বাংলা বিকাশ ও সমৃদ্ধির বিশেষ মাত্রা লাভ করে। এই সময় থেকে ইকতার পরিবর্তে ব্যবহার শুরু হয় ইকলিম শব্দের। ইকলিমের উপবিভাগ ছিল অরসহ, আর সাহিত্যিক রচনায় উপবিভাগকে বলা হতো মুলুক বা মুল্ক। আবার কোথাও কোথাও এরও ঊর্ধ্বস্তর হিসেবে তকসিম শব্দ পাওয়া যায়।

শহরের প্রকৃতি নির্ভর করত দুর্গের উপস্থিতির ওপর। দুর্গহীন শহরকে বলা হতো কশবাহ, আর দুর্গযুক্ত শহরকে খিততাহ। সীমান্ত সুরক্ষায় স্থাপন করা হতো থানা।

সুলতানি বাংলার রাজস্ব মূলত দুই ধরনের- গনিমাহ (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) ও খারাজ (খাজনা)। যুদ্ধলব্ধ সম্পদের পাঁচ ভাগের চার ভাগ দেয়া হতো সৈন্যদের আর অবশিষ্ট এক ভাগ জমা পড়ত রাজকোষে।

রাজস্ব আদায়ে দায়িত্ব দেয়া হতো বিশেষ কর্মকর্তাকে- যারা পরিচিত ছিলেন মোকতা নামে। রাজধানীতে রাজস্ব পৌঁছে দেয়ার কাজে থাকত আরিন্দা। রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন সর-ই-গুমাশতাহ।

শুল্ক ব্যবস্থাও ছিল বিস্তৃত। নদীর ঘাটে শুল্ক আদায় হতো, যেগুলো পরিচিত ছিল কুতঘাট নামে। প্রচলিত করের মধ্যে ছিল হাটকর, ঘাটকর, পথকর। তবে বাংলার সুলতানরা অমুসলমানদের ওপর জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।

নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগের কেন্দ্রে ছিলেন সুলতান। সুলতানের প্রাসাদ থেকেই তা পরিচালিত হতো। সুলতান ও রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে যে প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টিত হতো, তার মধ্যে আছে হাজিব (অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়ক), সিলাহদার (বর্ম রক্ষক), শরাবদার (পানীয়ের দায়িত্বে), জমাদার (পোশাকের তত্ত্বাবধায়ক) ও দরবান (প্রহরী)।

চিকিৎসকের দায়িত্বে থাকতেন সাধারণত মুসলিম হাকিম ও হিন্দু বৈদ্য, যাদের উপাধি ছিল অন্তরঙ্গ। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের হিন্দু সভাপণ্ডিতও ছিলেন। সুলতানের সচিবকে বলা হতো দবির, আর প্রধান সচিব ছিলেন দবির খাস। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও তার উত্তরসূরিদের আমলে প্রশাসন পরিচালিত হতো একাধিক দফতর প্রধানের মাধ্যমে। দিল্লি সুলতানাতের মতো ‘উজিরে আজম’ এখানে পাওয়া যায়নি। বাংলার সুলতান নিজেই ছিলেন চূড়ান্ত কর্তৃত্ব।

সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন পরিচালিত হতো খান, মালিক, উমারা, সদর, আকাবির ও মায়ারিফদের মাধ্যমে। খান, মালিক ও আমিররা ছিলেন জায়গিরের অধিকারী। তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। কেউ কেউ পেতেন বিশেষ উপাধি- খান মজলিস, মজলিস-অল-আলা, মজলিস-অল-আজম প্রভৃতি।

সুলতানি প্রশাসনে অভিজাত শ্রেণী বহুবিধ উপাধি লাভ করতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আমির, মালিক, ওয়াজির, খান-ই-জাহান, আমির-উল-উমারা। উমারা ছিলেন প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তা। নিয়মিত প্রশাসনিক কাজ বা নির্বাহী বিভাগের পরিচালনা করতেন তারা, সামরিক কাজকর্মও পরিচালিত হতো তাদের নেতৃত্বে। সুলতান সর্বদা খান বা ‘মালিক’দের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। এই অমাত্য শ্রেণীর সবাই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত থাকতেন। এরা যুদ্ধ, শান্তি বা অন্যান্য কাজে সুলতানকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন এবং সক্রিয়ভাবে এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন। সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্বাচন প্রশ্নে এই শ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।

বাংলার সেনাবাহিনী ছিল চার ভাগে বিভক্ত- ক. পাইক বা পদাতিক; খ. তীরন্দাজ; গ. গোলন্দাজ; ঘ. অশ্বারোহী; ঙ. হাতি বাহিনী ও নৌবহর। অভিযাত্রী বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন সর-ই-লস্কর, আর ছোট দলের নেতৃত্ব দিতেন সর-ই-খইল। জঙ্গদার বলতে সম্ভবত সাধারণ সেনাদের বোঝাত। তারা ছিল এক অস্ত্রধারী এবং তারা যুদ্ধে অংশ নিত। সর-ই-খইল এর অধীনে ১০ জন অশ্বারোহী সেনা থাকত। তার ওপরে সর-ই-লস্কর, তার উপরে উজির-ই-লস্কর। নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন মীর বহর। সৈন্যদের বেতন প্রদানের দায়িত্বে ছিলেন আবিজ-ই-লস্কর।

সমরকৌশল নির্ধারণ ও সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এবং সামরিক অভিযানের নেতৃত্বে থাকতেন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নিজেই। তিনি ছিলেন সব বাহিনীর প্রধান। জিয়াউদ্দীন বারানির ভাষ্যে দেখা যায়, বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহের জন্য স্থানীয় পাইক (পদাতিক) সৈন্যরা জীবন দিতেও প্রস্তুত। এমনকি বেতনভুক সামরিক শক্তির পাশাপাশি বাংলার হিন্দু রায়রাও (জমিদার) দিল্লির বিরুদ্ধে ইলিয়াস শাহের পক্ষে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। ইয়াহিয়া বিন আহমেদ সরহিন্দি তারিখ-ই-মুবারক শাহিতে দেখান, সুলতানের সেনাবাহিনীতে হিন্দুরা ছিলেন বড় পরিমাণে। তিনি দিল্লির বিরুদ্ধে সুলতানের যুদ্ধে নিহত সহদেবের বিবরণ দিয়েছেন, যিনি ছিলেন সুলতানি সেনাবাহিনীর উচ্চকর্তা। সুলতানি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত হতো ধনুক, বর্শা, বল্লম ও বারুদ। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে বাংলার সৈন্যরা কামান ব্যবহার শুরু করে এবং ১৫২৯ সাল নাগাদ এ বিষয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে।

রাজস্ব দফতর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রধানের পদবি ছিল সর-ই-গোমস্তা। তার কাজ ছিল ভূমি রাজস্ব আদায়, কর ব্যবস্থাপনা, জমিদারি বা ইকতা নিরীক্ষণ ও অর্থভাণ্ডার রক্ষণ। পরগনার আমিল, গ্রামের মুকাদ্দাম, পাটোয়ারি ও চৌধুরী রাজস্ব আদায় করতেন। ইকতা ছিল এক ধরনের সামরিক প্রশাসনিক বিভাগ, এর পরিচালক ছিলেন ইকতাদার বা মুকতি। তিনি সুলতানের নির্ধারিত ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় করতেন। তার তরফে এ বিষয়ের দেখভাল করতেন খাজা পদবির কেন্দ্রীয় কর্মকর্তা।

সুলতানি বাংলার অর্থনীতি ছিল বিস্তৃত, সমৃদ্ধ ও বহুমাত্রিক। রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল- গনিমাহ, ভূমি কর, বাণিজ্য শুল্ক ও আবগারি। ভূমি করের ব্যবস্থা ছিল সুসংগঠিত। গ্রামের পঞ্চায়েত, মুকাদ্দাম, পাটোয়ারি ও চৌধুরী গ্রামজীবনেরই অংশ। তাদের ভূমিকা প্রশাসনিক হায়ারার্কির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তা বাস্তব জীবনকে ধারণ করত। ইকতা বা সামরিক প্রশাসনিক ইউনিটের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেত।

বাণিজ্য বাংলা অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। নদীমাতৃক ভূখণ্ড এবং ঘাট ও নদীপথ ব্যবহারের কারণে শুল্ক আদায়ের জন্য স্থাপন করা হয় কুতঘাট। নাবিকদের আগমনে বাংলার রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। মূল পণ্য ছিল চাল, রেশম, তুলা, মসলিন কাপড়, নৌযান ও কাঠ।

সুলতানি শাসন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সফল ছিল। সমৃদ্ধ নদীমাতৃক বাণিজ্য শৃঙ্খল, শুল্কনীতি, নদী ও স্থলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাকে দক্ষ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করেছিল।

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের আমলে বাংলায় একটি স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ ছিল। সুলতানের অধীনে দৈনন্দিন বিচারের ভার কাজির ওপর ন্যস্ত ছিল। শহরে ও গ্রামে কাজি নিযুক্ত হতেন। আলেম বা জ্ঞানীরা বিচার বিষয়ে কাজিদের সাহায্য করতেন। ওলামা ছিলেন স্বাধীন। তাদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানী ও ন্যায়বিচারক ছিলেন।

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নিজের বিরুদ্ধেও কাজির বিচার মেনে নিতেন। দেশরক্ষা ও রাজস্ব আদায় ছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে গ্রামগুলো পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত ছিল। গ্রামের পঞ্চায়েতই গ্রামের শান্তি রক্ষার এবং সামাজিক ক্রিয়াকলাপের ভার নিত। এসব ব্যাপারে সামাজিক আইন চালু ছিল, বিশেষ করে হিন্দুদের সামাজিক ব্যাপারে হিন্দু আইন প্রচলিত ছিল।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পরিচালিত হতো। গুরুত্বপূর্ণ দু’টি প্রশাসনিক ইউনিট ছিল ইকলিম ও আরছা। ইকলিমকে বর্তমান সময়ের বিভাগ এবং আরছাকে বর্তমান সময়ের জেলার সাথে তুলনা করা যায়। ইকলিম ও আরছার ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের পদবি একই রকমের। বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ থেকে জানা যায়, উজির, সর-ই-লস্কর, জামাদার-ই-গাহির মুহুল্লি নামক পদবিধারীরাই ইকলিম ও আরছার শাসক ছিলেন। লিপি ও মুদ্রাসূত্রে শহর, কসবা ও খিত্তা নামের আরো কয়েকটি প্রশাসনিক ইউনিটের নাম পাওয়া যায়। তবে এ তিনটি নাম প্রায় সমার্থক।

শহর শব্দের অর্থ শহর বা নগর; কসবা এমন এক নগর যার রক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় নয় এবং খিত্তা যার রক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ়। তবে মনে হয় শহরের সাথে কসবা ও খিত্তার পার্থক্য এই যে, শহর ব্যবসায়কেন্দ্র, কসবা এবং খিত্তা সামরিক কারণে গঠিত নগর বিশেষ। এই হিসেবে কসবা ও খিত্তাকে সামরিক ছাউনির সাথে তুলনা করা যায়। শহর, কসবা ও খিত্তা উজির এবং সর-ই-লস্করের অধীনে ছিল। এই আমলের আরেকটি প্রশাসনিক ইউনিট ছিল থানা, থানাও সর-ই-লস্করের অধীনে ছিল। আবার কয়েকটি মহালের সমন্বয়ে শিক গঠিত হতো। শিকের শাসনকর্তাকে বলা হতো শিকদার।

সুলতানি বাংলার প্রশাসনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল স্পষ্ট। সৈন্যবাহিনী, জমিদারি ও প্রশাসনে উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সক্রিয় ছিলেন। এ ধরনের অংশগ্রহণ সুলতানকে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রদান করত; কিন্তু ভোতুরিয়ার জমিদার গণেশের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র গঠন করে ফেলে এই প্রক্রিয়ার ভেতর। যার ফলে স্বাধীন সুলতানি আমলে বহু সুলতানকে প্রাণ হারাতে হয়, রাষ্ট্রে আসে দুরবস্থা। কিন্তু তখনো সমাজ-সংস্কৃতি তার স্থিতি বজায় রাখছিল। এভাবে সুলতানি প্রশাসন প্রশাসনিক কাঠামো, সামরিক শক্তি, অর্থনীতি ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে মিলিতভাবে পরিচালনা করত।

সুলতানি বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো ছিল বহুমাত্রিক ও বিকশিত। প্রাথমিকপর্যায়ে ইকতাভিত্তিক সামরিক প্রশাসন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ইকলিম ও আরছা ইউনিট পর্যন্ত তা ধাপে ধাপে সুসংগঠিত রূপ পায়। সুলতান ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, তবে উমারা, খান, মালিক প্রমুখ অমাত্যরা প্রশাসনিক ও সামরিক দায়িত্বে সক্রিয় ছিলেন। রাজস্ব, সামরিক ও বিচার বিভাগে ছিল পৃথক কর্মকর্তা ও কার্যকরী কাঠামো, যা বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক শক্তিকে সুদৃঢ় করেছিল। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিকাশ যেমন সীমান্তরক্ষা ও যুদ্ধক্ষেত্রে সক্ষমতা এনে দেয়, তেমনি সমৃদ্ধ বাণিজ্য ও শুল্কনীতি অর্থনীতিকে প্রসারিত করে। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত অংশগ্রহণ এবং গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন সুলতানি প্রশাসনকে বহুমাত্রিক ও বাস্তবভিত্তিক কাঠামোতে রূপ দেয়। সুলতান সর্বদা একটি সুশৃঙ্খল ও বহুমাত্রিক প্রশাসনিক চক্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, যেখানে প্রতিটি স্তর কার্যকারিতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে। এই কাঠামো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এবং সমৃদ্ধ অর্থনীতি নিশ্চিত করত। এর দিশা তৈরি হয় শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের আজাদির ধারাবাহিকতায়।

লেখক : কবি, গবেষক