শিল্প খাতে স্থবিরতা টেকসই উন্নয়নে বাধা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা দেশ-বিদেশে যেভাবে রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার সুযোগ আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ সব শিল্পে গতি ফিরিয়ে আনতে হবে।

শিল্প খাতে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান ও মাথাপিছু আয় নিশ্চিত করে। শিল্প বা উৎপাদন খাতে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। কারণ শিল্প বা উৎপাদন খাত ঐতিহ্যগতভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং রফতানি প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। ২০১৩ সালে জিডিপিতে শিল্প বা উৎপাদন খাতের অবদান ছিল ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪ সালে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৪-এর প্রতিবেদনে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। শিল্প বা উৎপাদন খাতের এ ধরনের পতন দেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল। বিশেষ করে অর্থনীতির গতি জনবান্ধব করার ব্যাপারে সরকারের কার্যকর ও বাস্তবতাধর্মী পদক্ষেপের অপেক্ষায় ছিল সবাই।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুদহার বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সঙ্কটে ধুঁকছে শিল্প খাত। ভারী শিল্পের উৎপাদন, চাহিদা ও বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমায় মুনাফায়ও প্রভাব পড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন করে উৎপাদন ও আমদানিতে উৎসাহ পাচ্ছেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৪ কোটি টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় তা ৪ শতাংশ বেড়েছে সত্যি; কিন্তু শিল্প খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভারী কাঁচামালের আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এর কারণ এক দিকে অব্যাহত জ্বালানি সঙ্কট, অন্য দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ব্যাংক ঋণে মন্থর গতি : শিল্পে স্থবিরতার বড় কারণ ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি উচ্চ সুদের হার। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে এ বিষয়ে অস্থিরতা লক্ষণীয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও অস্থরিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি গত ফেব্রুয়ারিতে যে পর্যায়ে নেমেছে, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন (৬ দশমিক ৮২ শতাংশ)। গত জুলাই ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশের মতো। শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণও কমছে। বেসরকারি খাতে ঋণ কমে যাওয়া শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের স্থবিরতারই ইঙ্গিত।

জ্বালানির দামবৃদ্ধি : শিল্প খাতের স্থবিরতার অন্যতম কারণ তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। গ্যাস খাতে বর্তমানে কারিগরি ক্ষতির হার প্রায় ৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, কারিগরি ক্ষতি শূন্য দশমিক ২০ থেকে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ হওয়ার কথা। সরকারের উচিত কারিগরি ক্ষতি কমিয়ে আনা। গ্যাসের দাম বাড়ালেও সহনীয় পর্যায়ে হওয়া উচিত। হঠাৎ করে দাম বৃদ্ধি উৎপাদনের গতি মন্থর করে। এ ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা উচিত। সময় সময় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি যেন শিল্পে বৈষম্য না আনে সে দিকে নজর দেয়া দরকার।

উৎপাদনে গতি ফিরিয়ে আনা : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পে গতি ফেরাতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ব্যবসায়িক আস্থার পুনরুদ্ধার, আমদানি-রফতানির ভারসাম্য রক্ষা এবং জ্বালানি সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং নগরায়ন পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন : অর্থনীতিতে শিল্প খাতকে গুরুত্ব না দিলে দেশ কখনো অর্থনৈতিকভাবে মজবুতি লাভ করতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন। স্থল, নৌ এবং বিমানবন্দরসহ উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করা : বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (ঋউও) আকর্ষণ এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির বিকল্প নেই।

এ জন্য ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাগুলো মোকাবেলা করা এবং বেসরকারি খাতে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় খাতে যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে।

ব্যবসায়ীদের নানা ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফেরানো এবং একটি টেকসই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

রফতানি বহুমুখীকরণ : রফতানি বহুমুখী করা এবং বিকল্প খাতের মান ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ভর্তুকি কমানোর মতো সাহসী ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে, যার ফলে দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে এই কৃষি খাত ও কৃষক সমাজ। এখন এই কৃষক প্রজন্মই শিল্পকারখানায় কাজ করে বাংলাদেশকে উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি খাতের শিল্প তিন হাজার থেকে বেড়ে আজ পর্যন্ত প্রায় ৮৮ লাখ কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু কারখানার সংখ্যা বাড়লেও শিল্পকারখানায় গুণগত উন্নয়ন তেমন হয়নি। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির অনেক সম্ভাবনা থাকলেও অতীতের সরকারগুলো দেশের শিল্প বিকাশে নানা পদক্ষেপ নিলেও সেগুলো বাস্তবায়নে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও নানা অনিয়মের কারণে যতটুকু উন্নতি হওয়ার কথা, তা না হয়ে বরং আনুপাতিকভাবে উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানার সংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে কমেছে। শিল্প বিকাশ, শিল্প খাতের উন্নয়নে আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, রয়েছে কাঁচামালও। দেশে বন্ধ কারখানাগুলো চালু করতে হবে। বন্ধ জুটমিল, চিনিকলসহ যেসব কারখানা চালু করার সুযোগ রয়েছে, তা অনতিবিলম্বে চালু করা উচিত। প্রয়োজনে বিদেশী বিনিয়োগ এনে, জরুরি মেশিনারি আমদানি করে উৎপাদন চালু করতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা দেশ-বিদেশে যেভাবে রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার সুযোগ আছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ সব শিল্পে গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও গাইডের অভাবে মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে অন্য দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। আমাদের সৎ ও মেধাবী কর্মীদের মেধা ও কৌশল দেশের উৎপাদনশীল খাতে কাজে লাগাতে হবে। শিল্প উদ্যোক্তাদের শিল্প স্থাপনের পথ সহজ করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কমিটমেন্টের ওপরও দেশী- বিদেশী বিনিয়োগ আসা এবং শিল্পের বিকাশ অনেকটা নির্ভর করে।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার