ডিম দিয়ে আক্রোশ মেটানো

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ফৌজদারি আইন অনুযায়ী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য জেলও হতে পারে, শারীরিক আঘাত হলে শাস্তি আরো কঠিন হয়। জাতিসঙ্ঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট ইন্টারন্যাশনালি প্রোটেক্টেড পারসন্স, ইনক্লুডিং ডিপ্লোমেটিক এজেন্টস, ১৯৭৩ অনুযায়ী, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত কোনো ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালালে, হুমকি দিলে হামলায় সহযোগিতা বা অংশ নিলে প্রতিটি দেশকে তাদের নিজস্ব আইনে একে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ডিম, টমেটো ও পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা নতুন নয়। হাঁস বা মুরগির ডিম খাওয়ার টেবিলের একটি সাধারণ খাবার হলেও রাজনীতি ও প্রতিবাদের মঞ্চে প্রতীকী অস্ত্র হিসেবে এটি একটি অস্ত্র। অতীত দিনেও দেখা গেছে, রাজনীতিবিদদের দিকে ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মানুষ ডিম ছুড়ে মেরেছে।

১৯৬৩ সালে রোমান গভর্নর ভেসপাসিয়ানকে প্রজারা শালগম ছুড়ে মেরেছিল। যদিও মধ্যযুগে ডিম প্রবেশ করে এ তালিকায়। তখন বন্দীদের প্রকাশ্যে এক সাথে বেঁধে ডিম ছুড়ে মারা ছিল নিয়মিত ঘটনা। এলিজাবেথীয় যুগে নাট্যমঞ্চে খারাপ অভিনয়ের প্রতিবাদে দর্শকরা পচা ডিম ছুড়ত। হাঁস বা মুরগির ডিমকে অনেকে রসিকতা করে ব্যাচেলর ফুড নামে ডাকে। অথচ পুষ্টিগুণে ভরপুর এ ডিমকে ছুড়ে মেরে পুষ্টিটি বরবাদ করা হয় অহরহ। ডিম নিক্ষেপে মাথা ফাটার সম্ভাবনা কম থাকে, সহজে ফেটে যায় এবং ঠাস করে ছোট্ট একটি শব্দ হয় ও রস বের হয়। যে ছুড়ে মারে সে আনন্দ পায়। যাকে ছুড়ে মারা হয় তিনি বিব্রতবোধ করেন।

বাংলাদেশের আদালত চত্বর ডিম ছুড়ে মারতে দেখা গেছে। সস্প্রতি সুদূর নিউ ইয়র্কে এনসিপি নেতা আক্তার হোসেনকে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সভাকে ঘিরে ড. ইউনূস ও তার সরকারের সদস্যদের ওপর আওয়ামী লীগের আক্রোশ প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা নিউ ইয়র্কে জড়ো হন। প্রাক-মহড়া হিসেবে জ্যাকসন হাইটসে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল-মিটিং, হাতাহাতি-মারামারি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ যেখানে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের দেশের সমস্যা নিয়ে হাজির হন। দেশের পক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরের সামনে মানববন্ধন করেন। আমরা হলাম বিপরীত। ডিমের শিকার এনসিপি নেতা আক্তার হোসেন বলেছেন, এতে তিনি ভয় পাননি। যেমন ভয় পাননি শেখ হাসিনার বুলেট-বোমাকে।

ডিম ছুড়ে মারার পাশাপাশি ডিম থেরাপি বলে একটি বিষয়ও আছে, যা অনেক দেশে এখনো রোগ সারানোর পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত আছে- এটি ‘ডিম থেরাপি’ নামে পরিচিত। কিন্তু আজকাল আমাদের দেশে ডিম থেরাপি শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। অনেকেই দাবি করেন, রিমান্ডে নেয়া আসামিদের কাছ থেকে অপরাধের তথ্য বের করার জন্য প্রশাসনের লোকেরা তাদের ডিম থেরাপি দিয়ে থাকেন।

ডিম ছোড়া দুনিয়া জোড়া চলে আসছে বহুকাল ধরে।

রাজনীতিতে এমন সংস্কৃতি এলো কোথা থেকে। প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে খাবার ছুড়ে মারার ইতিহাস বহু আগের। কথিত আছে, মধ্যযুগে বন্দীদের জড়ো করে শাস্তি হিসেবে তাদের ওপর ডিম মারা হতো। তবে লিখিতভাবে ডিম নিক্ষেপের কাহিনী পাওয়া যায় ১৮০০ সালের দিকে। সেই সময় ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের সাথে সম্পর্কিত স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপাঞ্চল আয়েল অব ম্যানয়ে মেথোডিস্টদের ওপর ডিম ছোড়া হয়। ডিমের শিকার হয়েছিলেন হলিউড অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনিগারও। ২০০৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর ভোটের প্রচারণা চালানোর সময় তার দিকে ডিম ছোড়া হয়। অবশ্য তিনি সিনেমার নায়কের মতোই নির্বিকারভাবে হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দেন ভাঙা ডিমের অংশবিশেষ। ২০০৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ফেডোরোভিচ ইয়ানুকোভিচকে বিরোধীদের ছোড়া ডিমে আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। ২০১১ সালে আফগানি বিক্ষোভকারীরা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ইরানি কনস্যুলেটদের দিকে ডিম ছোড়ার ঘটনা মুছে যায়নি। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে রাজা তৃতীয় চার্লসের ওপর ডিম ছোড়ায় অভিযুক্তকে আদালতে সাজা দেয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৯১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউজকে এক জনসভায় ডিম ছুড়ে আঘাত করা হয়েছিল।

ব্রিটেনে ২০০১ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী জন প্রেসকটকে একজন তরুণ কৃষক ডিম ছুড়লে প্রেসকট নিজেই ঘুষি মেরে প্রতিক্রিয়া দেখান। মুহূর্তটির ছবি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ১৭ বছর বয়সী উইল কনলি, যিনি ‘এগ বয়’ নামে পরিচিত, বিতর্কিত বক্তব্য দেয়া সিনেটর ফ্রেইজার এনিংয়ের মাথায় ডিম ছোড়েন। ওই ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। কনলির প্রতি অনেকেই সমর্থন প্রকাশ করে, এমনকি অনুদানও তোলা হয়। ১৮৩৪ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ারের কনকোর্ডয়ে মার্কিন কবি জর্জ হোয়াইটার দাসত্ববিরোধী বক্তৃতা দেয়ার সময়, তাকে লক্ষ করে ডিম ছোড়া হয়।

বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বিচারাধীন বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-নেতাদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানে কিছু দিন আগে ডিম ছুড়ে মারেন বিভিন্ন আইনজীবী সদস্যরা।

খাবার ছুড়ে মারাকে সাধারণত অহিংস প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের এনসিপি নেতাকে ডিম ছোড়ার ঘটনায় যুবলীগের এক কর্মীকে জ্যাকসন হাইটস থেকে পাকড়াও করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। জামিনে ছেড়েও দেয়া হয়েছে। কাণ্ডকীর্তি হিসেবে হালকা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ডিম ছোড়া অপরাধ। সেখানে কোনো ব্যক্তিকে যেকোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করা অপরাধ। বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয়, ঘটনাটি মজার ছলে করা হয়েছে, না ঘটনাটি কারো প্রতি ঘৃণা থেকে করা হয়েছে? অথবা বড় কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে কি না? অভিযুক্ত ব্যক্তির মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, সেটি পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত হতে হয়।

এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ফৌজদারি আইন অনুযায়ী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য জেলও হতে পারে, শারীরিক আঘাত হলে শাস্তি আরো কঠিন হয়। জাতিসঙ্ঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট ইন্টারন্যাশনালি প্রোটেক্টেড পারসন্স, ইনক্লুডিং ডিপ্লোমেটিক এজেন্টস, ১৯৭৩ অনুযায়ী, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত কোনো ব্যক্তির ওপর আক্রমণ চালালে, হুমকি দিলে হামলায় সহযোগিতা বা অংশ নিলে প্রতিটি দেশকে তাদের নিজস্ব আইনে একে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। বাস্তবে নিউ ইয়র্কে এ অপরাধটি গুরুতর নয়। সাধারণত এসব অপরাধে প্রবেশনমূলক শাস্তি হয়ে থাকে এবং মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অঙ্গীকার নেয়া হয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ আর করবেন না। যুবলীগ নেতা তা-ই করেছেন।

যাই হোক, ডিমের দামের হিসাব দিয়ে শেষ করা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৮ দশমিক ৫০ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা এক হাজার ৩৪ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ে প্রায় ৮৬ টাকা। আর বাংলাদেশে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হয়ে যাওয়া এই ডিম এখন সাড়ে ১২ টাকা মূল্যে কিনতে হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]