রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতার ধারণাটি বেশ পুরনো। ১৭৪৮ সালে মনীষী হিউম তার বিখ্যাত রচনা ‘সমঝোতার মূল চুক্তি’ (Of The Original Contract)-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘ক্ষমতার’ তাৎপর্য ও গুরুত্ব তুলে ধরেন। তবে তারও আগে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি পঞ্চদশ শতাব্দীতে ক্ষমতাকে ধর্ম ও নৈতিকতা থেকে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেন। ক্ষমতাকে তারা দখল ও বিজয় এই উভয় অভিধায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তারা বৈধতা ও জনগণের স্বাভাবিক আনুগত্যকে অপরিহার্য মনে করেননি। ক্ষমতাকে এরা অভিবাসন, উপনিবেশীকরণ এবং সামরিক বিজয়ের কারক হিসেবে বর্ণনা করেন। হিউম প্রশ্ন করেন যে, রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে শক্তি (Force) এবং ভায়োলেন্স ব্যতীত অন্যকিছু বলা যায় কি? তিনি বলেন, Politics is seen to be about might rather than right । বাংলায় এর সমার্থক বাক্য হচ্ছে ‘জোর যার মুলুক তার’। সমাজবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন যে, ক্ষমতা প্রকারান্তরে রাজা, রাজ্য, রাজধানী এর জন্ম দেয়। ক্ষমতা বৈধ অথবা অবৈধ রাষ্ট্রব্যবস্থায় তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ক্ষমতা কর্তৃত্বের ভিত্তি তৈরি করে। ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
বারট্রান্ড রাসেল ক্ষমতাকে আপেক্ষিকতা এবং একে অপরের ওপর প্রাধান্যের বিষয় বলে মনে করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ক্ষমতার মদমত্ততা অবশেষে জনতার অধিকারে পরিণত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা যখন আমরা চিন্তা করি তখন রাষ্ট্রের উপাদান হিসেবে ভূখণ্ড, সরকার, সার্বভৌমত্ব ছাড়িয়ে জনগণকেই মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রাকৃতিকভাবে বিরাট ভূখণ্ড রাষ্ট্র নয়। মরুভূমি অথবা বরফ আচ্ছাদিত ভূখণ্ড যেখানে জনবসতি নেই তা রাষ্ট্র নয়। জনগণ থাকলেই প্রকারান্তরে সরকার গঠিত হয়। সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। ইতিহাস পরম্পরায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা জনগণের কাছে অর্পিত হয়। জনগণের এই অর্জন সহজে বা স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ম্যাগনাকার্টা-১২১৫, মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রাম-১৭৭৬, ফরাসি বিপ্লব-১৭৮৯, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব-১৯১৭ এবং ১৯৮৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মতো দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে হাজারো বিপ্লব ও আন্দোলন পেরিয়ে তবেই বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজতন্ত্র বনাম প্রজাতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্র বনাম সাধারণতন্ত্র- এভাবে পৃথিবীর ইতিহাস এগিয়ে গেছে। ক্ষমতার ভিত নির্মিত হয়েছে জনতাকে ঘিরে। পৃথিবীর এই অঞ্চলের মানুষের রাষ্ট্রতান্ত্রিক সংগ্রাম এভাবেই প্রবাহিত হয়েছে রাজতন্ত্র থেকে উপনিবেশতন্ত্রে। উপনিবেশ অবসানে গণতন্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষা রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গণমানুষের গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা স্বৈরতন্ত্র দ্বারা পদদলিত হয়েছে। মানুষের নিরন্তর গণতন্ত্রের সংগ্রাম স্বৈরতন্ত্রকে পরাভূত করেছে বারবার।
ইতিহাসের এই অনিবার্য বিবর্তন ধারায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়নি জনগণেরতন্ত্র। বিগত অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে মোকাবেলা করতে হয়েছে বাকশাল একনায়কত্ব, সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রকে। ২০২৪ সালে আরেকটি রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি সংস্কার বিপ্লবের তাড়না, স্বৈরতন্ত্রের বিচার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের আকাক্সক্ষায় অতিবাহিত হয়েছে একটি বছর। সংস্কারের ধারাবাহিকতায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মৌলিক জাতীয় বিষয় জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছে। Trial and error এর মধ্য দিয়ে গত এক বছরে ঐকমত্য কমিশন বেশকিছু রাষ্ট্রিক বিষয়ে ঐকমত্য অর্জন করেছে। বলা হয়ে থাকে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তেমনি অর্জিত ঐকমত্য বাস্তবায়ন নিয়ে বাস্তব সমস্যা মোকাবেলা করছে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ জাতিগোষ্ঠী।
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট এবং পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের মতো বিষয়াবলি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক, বিভেদ লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের ক্ষমতার এই কেন্দ্রিকতা তারা জনগণের দোহাই দিয়ে জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা বলে প্রতিভাত করার অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। যখনই কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বা জোট কথা বলছে, তারা জনগণকে বা জনতাকে জিম্মি করছে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি জাতীয় সনদ রাষ্ট্রিক ঘোষণাকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের কাছে অর্পণ করতে চায়। অপর দিকে আরেকটি বড় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী জাতীয় সংসদ এবং প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ চাচ্ছে। ২০২৪ সালের গণবিপ্লবের আকাক্সক্ষার ধারক বলে দাবিকৃত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি জুলাই জাতীয় সনদের রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি চাচ্ছে নির্বাচনের আগেই। গণভোট নিয়েও তাদের নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে। এভাবে এই সময়ে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদের মধ্যে ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় সরকার এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সভা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের উদ্যোগে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিক ও নির্দেশনা দেয়ার আহ্বন জানানো হয়। এ জন্য সাত দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে। ফলে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য থেকে তাদের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানালেও ওই পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। তাদের যুক্তি হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এভাবে সময়সীমা বেঁধে দেয়ার এখতিয়ার রাখে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ছিল না। তবে কৌশলগতভাবে বিপাকে ফেলেছিল রাজনৈতিক দলগুলোকে। সরকারের সিদ্ধান্ত দেয়ার পর যদি রাজনৈতিক দলগুলো আবারো তা প্রত্যাখ্যান করে তাহলে সঙ্কট বাড়তে পারে।
জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য আরো বেশ কয়েকটি দল সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে একমত নয়। সুশীলসমাজ বলছে, সংস্কার আটকে গেলে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হবে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। এই অবস্থায় জনগণের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সঙ্গতভাবেই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তবে হতাশার মধ্যে আশার ক্ষীণ আলো হলো এই যে, সরকারের মধ্যস্থতায় অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আপসের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাস্তব পরিস্থিতি রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকার জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন একই দিনে করছে। ছোট-বড় সবাইকে তুষ্ট করে চলার চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এনসিপিকে তুষ্ট করার জন্য সরকার ইতোমধ্যে শাপলা কলি প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। তবে দলটি এখনো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। সাম্প্রতিককালে এনসিপি এবং সরকারের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অথচ লোকজন এনসিপিকে সরকারি দল তথা কিংস পার্টি মনে করে। আশা করা যায়, এনসিপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দূরত্ব গৃহীত উদ্যোগের ফলে মীমাংসিত হবে।
দৃশ্যমানভাবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই দূরত্ব দূরীকরণ উভয় পক্ষের দায়িত্ব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথাগত পন্থা বা উপায় পাঁচটি। যেসব কৌশল ও বিধিব্যবস্থা দ্বারা রাষ্ট্র তথা সরকার এসব দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব দূর করতে পারে তা হচ্ছে- ১. নিয়ন্ত্রণ (Control) : নিয়ন্ত্রণ প্রকৃত অর্থে ব্যক্তিক নিয়ন্ত্রণ নয়; বরং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ। ব্যক্তি বা সমষ্টিকে সম্মতি ও আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ। ভয়ভীতি ও বাধ্যবাধকতা ছাড়াই যখন নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রতি সতত আনুগত্য প্রদর্শন করে তখনই নিয়ন্ত্রক হিসেবে সরকারব্যবস্থা সার্থক হয়ে ওঠে। ২. অব্যাহত চেষ্টা (Persuasion) : Persuasion কৌশল সেই উপায় বা কলাকৌশল যার মাধ্যমে নাগরিক একজন শাসককে সমীহ করে। শাসকও নাগরিক সাধারণকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে। ৩. কর্তৃত্ব (Authority) : কর্তৃত্বের অর্থ হচ্ছে বৈধ ক্ষমতা। এটির অন্য অর্থ হচ্ছে আদেশদানের অধিকার। অর্থবিত্তের ন্যায়ানুগ বণ্টনও কর্তৃত্বের বৈশিষ্ট্য। এটি যখন ক্ষমতার প্রয়োগ ছাড়া অনুসৃত হয় তখনই কর্তৃত্বের স্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪. শক্তি প্রয়োগ (Coercion) : ভয়ভীতি ও নানারকম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে। ভীতির মাধ্যমে ক্ষমতাকে প্রয়োগ করার কৌশল। ৫. কৌশলে নিয়ন্ত্রণ (Manipulation) : এটি হচ্ছে ভীতি বা অর্থের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। এটি হচ্ছে ক্ষমতায় থাকার একটি বড় ধরনের কৌশল। ক্ষমতাকে বিশেষজ্ঞরা দেখেন পরস্পরের বন্ধন হিসেবে। Politics is about power-এর অপর নাম ক্ষমতার বিন্যাস।
বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অচলাবস্থায় উপরোক্ত নীতি কৌশলগুলো প্রয়োগযোগ্য কি না তা এখন প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো অনড় অবস্থানের কারণে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিজ দায়িত্বে নিজ কৌশলে এই অচলায়তন ভাঙার কাজে অগ্রসর হতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা পক্ষগুলোকে তাড়িত করুক। এই অবস্থায় নাগরিক সাধারণের প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কি?
লেখক : অধ্যাপক (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



