বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী, গবেষক, ধর্মতাত্ত্বিক, লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভিসি প্রফেসর ইমেরিটাস আল্লামা ড. এম শমশের আলী (১৯৩৭-২০২৫) যিনি আমৃত্যু (২ আগস্ট ২০২৫) বিশ্বাস করতেন, ‘অন্যের জন্য কাজ করলেই প্রকৃত সুখ অর্জন করা সম্ভব, কারণ সুখ নিজের জন্য খোঁজা নয়, সুখ অন্যের জন্য কাজ করায়। শুধু নিজের জন্য কাজ করে মানুষ কখনো সুখী হতে পারে না। সুখী হতে হলে তাকে অন্যের কথাও ভাবতে হয়, অন্যের জন্য কাজ করতে হয়। এটিই সত্যিকার সুখের পথ।’ বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের সমন্বয় সাধনে তৎপর ও নিষ্ঠাবান নিবেদিতপ্রাণ এই মনীষী ‘মৌনতা ও ধ্যান’ শীর্ষক আলোচনায় তুলে ধরেছিলেন তার উপলব্ধি- ‘আমরা শুধু চোখ দিয়েই দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু চোখ বন্ধ করে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলে তার চেয়ে আরো বেশি দেখা যায়, বোঝা যায় বিশ্বজগৎরূপী নাট্যমঞ্চে কিভাবে একের পর এক দৃশ্যপট বদলায়। প্রকৃতি যেহেতু নীরবে সচল থাকে, তাই নীরবতা বা মৌনতা অবলম্বন করলেই অনুধাবন করা যায় প্রকৃতির মধ্যে নিহিত প্রজ্ঞাকে। মানুষের যে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি প্রয়োজন, তা-ও উপলব্ধি করা সম্ভব হয় মৌনতার মধ্যেই।’ বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য, বিশেষত পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র ও তত্ত্বের সহজবোধ্য ব্যাখ্যা এবং এর সাথে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম ও জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলোর সাদৃশ্য তিনি সাধারণের সামনে উপস্থাপন করেছেন। বিজ্ঞানের আলোকে কুরআন ব্যাখ্যায় তার সুগভীর ও সহজাত পাণ্ডিত্য সর্বজনস্বীকৃত। এ ছাড়াও আন্তঃধর্মীয় ও সর্বজনীন সম্প্রীতি রচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
ড. এম শমশের আলীর জন্ম ১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারায়। পৈতৃক সূত্রে তিনি যশোর সদর থানার সিঙ্গিয়া (বর্তমানে বসুন্দিয়া) গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা মরহুম আমীর আলী এবং মা মরহুমা রহিমা খাতুন। স্ত্রী শিক্ষাবিদ ও মারী কুরী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ সাকেবা আলী এবং দুই ছেলে জীশান আলী ও জেহান আলীকে নিয়ে তার পরিবার।
ড. এম শমশের আলীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় ইউসুফ মাস্টারের স্কুলে। পিতার চাকরির সুবাদে একপর্যায়ে তারা সপরিবারে চলে যান ভারতের চব্বিশ পরগনার রানাঘাটে। সেখানে তিনি দু’বছর লেখাপড়া করেন লালগোপাল স্কুলে। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর তারা ফিরে আসেন যশোরে। সেখানে যশোর জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে আইএসসি পাস করেন। কলেজ-জীবন শেষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পছন্দের বিষয় পদার্থবিজ্ঞানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে কৃতিত্বের সাথে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৬০ সালে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে তখন পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ বয়সে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে পুনরায় ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই থিওরেটিক্যাল নিউক্লিয়ার ফিজিক্স বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও তার অবদান
১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে সায়েন্টিফিক অফিসার পদে যোগ দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত সায়েন্টিফিক অফিসার, ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
কর্মদক্ষতার জন্য তিনি ১৯৭০ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে আণবিক শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘অনারারি প্রফেসর অব ফিজিক্স’ সম্মাননায় ভ‚ষিত করে। পরবর্তী সময়েতে ১৯৮২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ড. আবদুস সালামের আমন্ত্রণে ও আগ্রহে তিনি ইতালির ট্রিয়েস্ট্রিতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট, সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ও অনারারি অ্যাসোসিয়েট হিসেবে গবেষণা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে অধ্যাপনাকালে গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে তিনি শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স, নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ম্যাথেমেটিক্যাল মেথডস অব ফিজিক্স ইত্যাদি।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তিনি। দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের কাছে মানসম্পন্ন শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই যাত্রা শুরু করে ব্যতিক্রমী এ বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভিসি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। পরে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০২-১০ পর্যন্ত।
২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী। ২৪ মার্চ ২০২৫ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রফেসর ইমেরিটাস পদে সম্মানিত করে।
অধ্যাপক শমশের আলী ছিলেন ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো (১৯৮৯ সাল থেকে) এবং একই অর্গানাইজেশনের সেন্ট্রাল অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান কাউন্সিল মেম্বার (২০১৯-২২), দ্য ইসলামিক ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো (১৯৮৬ সাল থেকে) এবং একই অর্গানাইজেশনের কাউন্সিল মেম্বার (১৯৮৯-৯৪), বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো (১৯৭৮ সাল থেকে)। বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটি এবং বাংলা একাডেমিরও ফেলো ছিলেন তিনি। ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সায়েন্টিস্টস অ্যান্ড সায়েন্টিফিক প্রফেশনালসের জেনারেল সেক্রেটারি (১৯৭৮-৮১)। বাংলাদেশ সায়েন্স মিউজিয়ামের বোর্ড অব গভর্নরস এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব বাংলাদেশের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিনি বিটিভিতে ‘বিজ্ঞান বিচিত্রা’ ও ‘নতুন দিগন্ত’ নামে দু’টি শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন দীর্ঘ দিন। তার এ দু’টি অনুষ্ঠান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞান-সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। আশির দশকে বিটিভিতে ধর্ম ও বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘উজ্জীবন’ পরিচালনা করতেন তিনি। এ ছাড়াও বিবিসিতে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ে সিরিজ লেকচার দিতেন ড. এম শমশের আলী।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়টি জনপ্রিয় করে তোলার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে তিনি ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেস কর্তৃক সম্মাননায় ভ‚ষিত হন। ১৯৯০ সালে ইতালির থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক অব সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশনের সম্মাননা লাভ করেন। ২০০৯ সালে তিনি মালয়েশিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি লিডারশিপ কলোকিজ কর্তৃক আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন। নোবেলজয়ী ড. গেন সিবর্গ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশনের সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসেবে অনারারি ফেলোশিপ অর্জন করেন ২০১৩ সালে। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হরিপ্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স স্বর্ণপদক, জগদীশচন্দ্র বসু স্বর্ণপদক, আকরম খাঁ স্বর্ণপদক, মওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক, ২০০৪ সালে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ স্বর্ণপদকসহ বহু গুরত্বপূর্ণ সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রথমসারির সায়েন্টিফিক জার্নালগুলোতে নিয়মিত তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তিনি বিজ্ঞান, গণিত ও ইসলাম নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী বোডমারের নামে একটি আলফা-আলফা পোটেনশিয়াল জ্যোতির্বিজ্ঞান গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এটি সুপারনোভা নিউক্লিও সিনথেসিস, বোস কনডেন্সেশন, আলফা ক্লাস্টার মডেলসহ পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে ৫৭ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হাইপারনিউক্লিয়ার ফিজিক্সে তার গবেষণার অবদান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।
ড. এম শমশের আলী ছিলেন আমৃত্যু বিজ্ঞানচর্চায় নিবেদিত। বিজ্ঞানে যেমন শেষ কথা বলে কিছু নেই, তেমনি তিনিও জ্ঞানের বহুধারায় অবগাহন করেছেন প্রতিনিয়ত। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য, সঙ্গীত, ধর্ম, দর্শন, সমাজচিন্তা, আধ্যাত্মিকতাসহ বিচিত্র বিষয়ে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি চেনা ছকের বাইরে এসে মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখতে জানতেন। বন্ধু ও কাছের মানুষরা তাকে A man with a large antenna বলে অভিহিত করতেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের বহুবিধ শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাকে একজন বিশিষ্ট ও অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল।
লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান