বাংলাদেশের সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি ব্যতীত সুপ্রিম কোর্টের অপরাপর সব বিচারক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। এসব বিচারকের মধ্যে অতিরিক্ত বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক এবং আপিল বিভাগের বিচারক অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানে যদিও সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে- প্রধান বিচারপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ পদে নিয়োগের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।
সংবিধানে বর্তমানে বিচারক নিয়োগে যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হলো- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে; সুপ্রিম কোর্টের অন্যূন ১০ বছরকাল আইনজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে; বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকতে হবে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ পেতে আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী সর্বপ্রথম সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ২০০৮ সালে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়। কমিশন গঠন বিষয়ে বলা হয়- ৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং সদস্যরা হবেন আইনমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দু’জন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সংসদ নেতা মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, সংসদের বিরোধী দলের নেতা মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, সভাপতি-সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং সচিব, আইন মন্ত্রণালয়, যিনি কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবেও কাজ করবেন।
এ অধ্যাদেশ প্রণয়ন-পরবর্তী এটি প্রণয়ন বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের করা হলে তা অগ্রাহ্য হয়। অধ্যাদেশটি প্রণয়নকালীন সংসদ না থাকায় কার্যত এটি সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশনে পরিণত হয়। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত না করায় তা কার্যকারিতা হারায়। অধ্যাদেশটি কার্যকর থাকাকালীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন শুধু একবার উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের কার্য সমাধানের সুযোগ পায়। সেবারের তালিকা থেকে কমিশনের সুপারিশকৃত ছয়জনকে রাষ্ট্রপতি উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক পদে নিয়োগ দেন। এ ছয় জনকে স্থায়ী করার প্রশ্ন দেখা দিলে আওয়ামী লীগ সরকার সে সময়কার আইন উপদেষ্টা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অদক্ষদের নিয়োগ দিয়েছেন- এই অভিযোগে পাঁচজনকে স্থায়ী করা থেকে বিরত থাকে।
৫ আগস্ট ২০২৪ সাল, ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করলে নতুন সরকার গঠনের আবশ্যকতা দেখা দেয়। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ওপর ভিত্তি করে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথগ্রহণ করে। অতঃপর বিদ্যমান সংবিধানের বিধানাবলির আলোকে ২৩ জনকে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত বিচারক পদে ৮ অক্টোবর ২০২৪ সালে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্তরা ৯ অক্টোবর শপথগ্রহণ-পূর্বক বিচারক পদে কার্যভার শুরু করেন। এই ২৩ জনের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন আইনজীবী এবং সাতজন অধস্তন আদালতের বিচারক, যার মধ্যে একজন চাকরিরত এবং অন্য ছয়জন চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগবিষয়ক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, দুই শ্রেণীর ব্যক্তিকে উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে। একটি, সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় অন্যূন ১০ বছর নিয়োজিত ব্যক্তি অথবা বিচারকর্ম বিভাগে অন্যূন ১০ বছর চাকরিরত ব্যক্তি। দুই শ্রেণীর ব্যক্তিকে যোগ্য করায় স্বভাবত ধারণা করা হয়, যখন বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভ‚ত হবে তখন উভয় শ্রেণী থেকে সমানুপাতিক হারে নিয়োগের সুযোগ ঘটবে। এ যাবৎকাল যখন উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে; তখন জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যতীত অপরাপরদের সময় অধস্তন আদালতের বিচারকের তুলনায় আইনজীবীদের মধ্য থেকে নিয়োগের হার ছিল ৩০:৭০ থেকে ২০:৮০।
বিচার বিভাগের নি¤œতম পদ সহকারী জজ। ম্যাজিস্ট্রেট নামক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিশিষ্ট কোনো পদ নেই। বিচার বিভাগের সহকারী জজ, যুগ্ম জেলা জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজরা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
সহকারী জজ পদে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা- এলএলবি বা এলএলএমসহ পূর্ববর্তী সব পরীক্ষায় ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণী বা সমমানের গ্রেডপ্রাপ্ত। অতীতে সহকারী জজরা সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পেতেন। বর্তমানে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পান। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগসংক্রান্ত কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় ৬০ শতাংশের নিচে নম্বরপ্রাপ্ত হলে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৯ অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী যে স্বীকৃত নিয়ম তা হলো- সুপিরিয়র শ্যাল কন্ট্রোল দ্য ইনফিরিয়র।
পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ইতঃপূর্বে প্রায় প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবীদের মধ্য থেকে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন বা হয়েছিলেন তাদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার বিভাগের সর্বনিম্ন পদে নিয়োগ পেতে নির্ধারিত যোগ্যতার চেয়ে নিম্নের ছিল বা আছে।
২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাইপূর্বক প্রধান বিচারপতির রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়। অধ্যাদেশটি অবলোকনে প্রতীয়মান হয়, এটিতে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ কাউন্সিলের প্রধান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং সদস্য হিসেবে থাকবেন আপিল বিভাগে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে কর্মে প্রবীণতম বিচারক; হাইকোর্ট বিভাগে (বিচারকর্ম বিভাগ থেকে নিযুক্ত ব্যতীত) কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে কর্মে প্রবীণতম বিচারক; বিচারকর্ম বিভাগ থেকে নিযুক্ত হাইকোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারক; প্রধান বিচারপতির মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক; বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত একজন আইনের অধ্যাপক বা আইন বিশেষজ্ঞ।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল পদাধিকার বলে কাউন্সিলের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন; তবে শর্ত থাকে যে- রেজিস্ট্রার জেনারেল নিজে বিচারক পদে প্রার্থী হলে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে তার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কাউন্সিলের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
অধ্যাদেশটিতে বলা আছে- কাউন্সিলের বিবেচনায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় তথ্য কাউন্সিল নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করতে পারবে। তা ছাড়া ফরমে প্রার্থীদের কাছ থেকে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরখাস্ত আহ্বান করবে। অধ্যাদেশটির সাথে সংযুক্ত যে ফরম দেয়া হয়েছে তাতে আবেদনকারীর নাম, ঠিকানা, জন্মস্থান ও জন্মতারিখ ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে।
অধ্যাদেশটিতে আবেদনকারীদের বয়স ৪৫ এর নিম্নে হবে না মর্মে উল্লেখ রয়েছে। বয়স ৪৫ যথার্থ বিবেচিত হলেও কোনো কোনো মহল থেকে দাবি উঠেছে- বয়স ৩৫ নির্ধারণ। আবার কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে- বয়স ৫০ নির্ধারণ।
অধ্যাদেশটি অবলোকনে স্পষ্ট প্রতিভাত যে, প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত বিচারক নিয়োগে মুখ্য হিসেবে বিবেচিত। যে সাত সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলের কথা অধ্যাদেশটিতে বলা আছে এর চারজন বিচার বিভাগের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। একজন বিচার বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অপর দু’জনের একজন দেশের মুখ্য আইন কর্মকর্তা এবং অপরজন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আইনের অধ্যাপক বা আইন বিশেষজ্ঞ। আইনের অধ্যাপক বা আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ না থাকায় আইন কলেজে যারা অধ্যাপনা করেন এমন ব্যক্তি বা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী না হয়েও আইন বিষয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করেন এমন ব্যক্তিরও বিশেষজ্ঞ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রয়েছে।
অধ্যাদেশটি প্রণয়ন-পরবর্তী বিচারক নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আশা করা যায়, অচিরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ পেতে কাউন্সিলের সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন। সুপারিশপ্রাপ্তরা পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির দ্বারা নিয়োগ পাবেন; যদিও অধ্যাদেশটিতে আইন মন্ত্রণালয় বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের কোনো উল্লেখ নেই, তবে সংবিধানের বিধানাবলি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, উভয় কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতা ব্যতীত নিয়োগকার্য সমাধা সম্ভব নয়।
আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগেও হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত জ্যেষ্ঠদের কথা উল্লেখ রয়েছে। কাউন্সিল যে সাতজন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত হবে তারা সবাই রাজনৈতিক সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা কতটুকু কার্যকর থাকবে বা আদৌ কার্যকর থাকবে কি না- প্রশ্নটি উপেক্ষা করা যায় না। জনমনেও এমন আশঙ্কা রয়েছে- কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে সচেতন। সুতরাং তারা তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বিসর্জন দিয়ে কতটুকু নিরপেক্ষ হতে পারবেন ওই প্রশ্ন উদয় হওয়া স্বাভাবিক।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে যে রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবে; তারা এ অধ্যাদেশ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা-ও কিন্তু বিবেচনার বিষয়। তাই স্বচ্ছতা ও বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উভয় শ্রেণী থেকে সমানুপাতিক হারে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী এবং রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হলে নিয়োগপ্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ গণ্যের অবকাশ তৈরি হবে। অন্যথায় পূর্বেকার অধ্যাদেশের মতো এটির পরিণতি ভিন্নতর হবে না- এমনটি প্রতিভাত।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক