বিচারে বিলম্ব : দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) প্রসঙ্গে

এককথায়, দেওয়ানি মামলা বিচারে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণের যেসব আইনি কারণ বিদ্যমান ছিল এই সংশোধনীতে সেগুলো যথাসম্ভব দূর করা হয়েছে। তাই যুগের পর যুগ ধরে বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়ায় দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫, বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

মতিউর রহমান

আমাদের সমাজে মানুষ যেসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তার বেশির ভাগের মূলে রয়েছে সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিরোধ। বেশির ভাগ ফৌজদারি মামলার উৎপত্তি হয়ে থাকে দেওয়ানি মামলা ঘিরে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সম্পত্তি-সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে সমাজের অনেক বিরোধ কমে যাবে।

জমিজমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেওয়ানি কার্যবিধি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। দেশে বিদ্যমান দেওয়ানি কার্যবিধি আইনটি শত বছরের পুরনো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে প্রণীত আইনটি বাংলাদেশের দেওয়ানি মামলার মূল আইন। একই সাথে পদ্ধতিগত আইন হিসেবেও বিবেচিত হয়। দেওয়ানি কার্যবিধি প্রণীত হয়েছিল ১৯০৮ সালে। সে হিসাবে আইনটির বয়স ১১৬ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে সমাজ সভ্যতা ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন হলেও কালের প্রেক্ষাপট ও চাহিদার নিরিখে আইনটি সে মাপে উন্নীত করা হয়নি। এর আগে বেশ কয়েকবার দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে; কিন্তু জনহয়রানি রোধ ও দ্রুত মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে সংশোধনীগুলো খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ফলে দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালত মিলে দেওয়ানি মামলার পাহাড় জমে উঠেছে।

বছরের পর বছর ধরে চলমান এসব মামলায় আদালতের বারান্দায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নে অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মামলাজট একটি বড় বাধা। আমার বিচারঙ্গনে দেড় দশকের বেশি সময়ে এমন কিছু দেওয়ানি মামলা পেয়েছি, যা দায়ের হয়েছে আমার জন্মেরও আগে। জমি নিয়ে দাদার দায়ের করা মামলা নাতির আমলে এসে নিষ্পত্তি হয়েছে এমন মামলাও পেয়েছি। এগুলো বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা নয়, আমার মনে হয়, প্রত্যেক বিচারকের এ রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে।

দেওয়ানি মামলা বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং সময়ক্ষেপণের মূলে শত বছরের এ পুরনো এই আইনকে তাই দূষছেন অনেকে। পুরনো এ আইন বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত বিচার নিশ্চিতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই স্বল্প সময়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন এ আইন সংস্কার করা খুব প্রয়োজন ছিল। এসব দিক বিবেচনা করে দেওয়ানি বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে ২০২৫ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে।

দেওয়ানি মামলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সমনজারি নিয়ে। বিদ্যমান আইনে বিবাদির প্রতি সমন জারি করা হতো আদালতের পেয়াদা বা জারিকারকের মাধ্যমে। সেই সাথে সমনের কপি ডাকযোগেও পাঠানো হতো বিবাদির ঠিকানায়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কখনো এ সমন ফেরত আসতে বছরেরও বেশি লেগে যায়। দীর্ঘ সময় পরও সমন ফেরত না আসার বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, উপদেশ নসিহত হয়েছে বিস্তর। তারপরও অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। নতুন সংশোধনীতে সমন জারির পদ্ধতিতে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ফোন, এসএমএস, ভয়েস কল ও ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং সার্ভিস। এ ছাড়া মামলা করার সময় মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং ই-মেল (যদি থাকে) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আগে মোকদ্দমার বাদি ও বিবাদি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে পুরো আর্জির বর্ণনা দিতেন মৌখিক সাক্ষ্যে। বিচারককে তা লিখতে হতো পাতার পর পাতা। কখনো বড় বাটোয়ারা মামলায় বাদির সাক্ষ্য গ্রহণ করতে বিচারকের লেগে যেত দুই-তিন দিন। এভাবে বিবাদির জবাবও পুরোটা সাক্ষ্য আকারে লিখতে হতো। যে কথাগুলো আরজি ও জবাবে লেখা আছে সেই একই কথা পুনরায় বিচারককে দিয়ে লেখানোতে আদালতের ব্যয় হতো অনেকসময়। এ ঝামেলা আর থাকছে না, এখন মামলার বাদি-বিবাদিকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দী দিতে হবে না। লিখিত জবানবন্দী আদালতে জমা দিতে হবে হলফনামা আকারে। এতে বেঁচে যাবে অনেক সময়।

অর্থ আদায়ের মামলায় রায় প্রাপ্তির পর জারি মামলা নামে পৃথক একটি মামলা দায়ের করতে হতো। এখন থেকে আর জারি মামলা করতে হবে না। মূল মামলাতে জারি-সংক্রান্ত দরখাস্ত দাখিল করে অর্থ আদায় করা যাবে। এ ছাড়া এ-সংক্রান্ত মামলায় দেওয়ানি আদালত ডিক্রিহোল্ডারের আবেদন মোতাবেক বিবাদিকে সর্বোচ্চ ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি আটকাদেশ দিতে পারবে। এক কথায় আগে আদালতের রায় ও ডিক্রি কার্যকর করতে পৃথক মামলা করতে হতো। এখন আর্থিক ডিক্রিসহ কিছু ডিক্রি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। দেওয়ানি আদালতে যেসব মামলা দায়ের করা হয় তার বেশির ভাগ ঘোষণামূলক মামলা। বিদ্যমান আইনে আদালত শুধু ব্যক্তির বৈধ অধিকার বা স্বত্ব ঘোষণা করেন। সে অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো নির্দেশ দেন না। এখন থেকে দেওয়ানি আদালত রায় ও আদেশ কার্যকর করতে পুলিশসহ যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিতে পারবেন। এ সুযোগ আগে ছিল না।

কোনো ব্যক্তি আদালতের রায়, আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ভায়োলেশন মামলায় আদালত তাকে আটক করার নির্দেশ দিতে পারেন। এ ধরনের মামলায় ইতোপূর্বে বিবাদিকে জেলখানায় আটক রাখার খরচ বাদিকে বহন করতে হতো। ফলে আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলেও খরচ বহনের ভয়ে ভায়োলেশন মামলা করতেন না অনেকে। নতুন এ সংশোধনীতে বিবাদিকে জেলখানায় থাকার খরচ সরকার বহন করবে। ফলে আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার প্রবণতা কমে যাবে আশা করা যায়।

আপিল দায়েরের পর আপিলকারী বা প্রতিপক্ষের অনুপস্থিতিতে আপিল মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হতো। এখন শুনানির তারিখে পক্ষদ্বয় উপস্থিত না থাকলেও আদালত রায় ঘোষণা করতে পারবেন। এভাবে আপিল মামলা বিলম্বের সুযোগ কমে যাবে।

দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তিতে বড় বাধা ছিল সময়ের আবেদন। আগের আইনে ছয়বার পর্যন্ত মুলতবি চাওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে অসংখ্যবার নানা অজুহাতে পক্ষদের সময় নিতে দেখেছি। এ সংশোধনীতে মামলা বিলম্বিত করতে সময়ের আবেদন করার সুযোগ কমছে। এককথায়, সময়ের আবেদনের গলায় ঘণ্টা বেঁধে দেয়া হয়েছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, এখন চারবারের বেশি সময় চাওয়া যাবে না। এতে মামলা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে। মামলা শুনানির সময় বিবাদির অনুপস্থিতিতে আদালত বাদিপক্ষে একতরফা রায় দেন। আগের আইনে বিবাদি নানা অজুহাতে একতরফা রায় বাতিল করতে একাধিকবার আবেদন করতে পারতেন। এটি ছিল একপ্রকার সাপ-লুডুর খেলার মতো। এখন থেকে বিবাদি একবারের বেশি এ ধরনের আবেদন আর করতে পারবেন না।

দেওয়ানি আদালতে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করলে জরিমানা হতে পারে। বিবাদির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক হলে, আদালত মামলা দায়েরকারীকে জরিমানা করতে পারেন। মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়েরে সর্বোচ্চ জরিমানা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে এখন ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। আশা করা যায়, এতে হয়রানিমূলক মামলা অনেকাংশে কমবে।

এককথায়, দেওয়ানি মামলা বিচারে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণের যেসব আইনি কারণ বিদ্যমান ছিল এই সংশোধনীতে সেগুলো যথাসম্ভব দূর করা হয়েছে। তাই যুগের পর যুগ ধরে বিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়ায় দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫, বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ অধ্যাদেশে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতা থেকে মুক্তি পাবেন। একই সাথে আদালতে মামলার জট কমবে বলে আশা করা যায়।

লেখক : সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত